দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিঃ লাগাম টেনে ধরুন
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
উন্নত বিশ্বে বিশেষ বিশেষ মওসুমে বা বিশেষ বিশেষ প্রেক্ষাপটে জিনিস পত্রের দাম হ্রাস পেয়ে থাকে। সাধারণত বাজারে যে জিনিসটির চাহিদা ষতো বেশি সে জিনিসটি ততো কম দামে বিক্রি হয়। একটা উদাহরণ টানলে বিষয়টা সহজ হবে। আমি যেহেতু আয়ারল্যান্ডে থাকি তাই এ দেশটির কথাই বলি।
আয়ারল্যান্ড একটি শীত প্রধান দেশ। গরম বলতে নেই বললেই চলে। তবু বছরের একটি অংশকে তারা গ্রীষ্মকাল (Summer) হিসেবে বিবেচনা করে। এ সময়ে তাপমাত্রা সাধারণত ১৫/১৬ ডিগ্রি থেকে সর্বোচ্চ ২৫/২৬ ডিগ্রি হয়ে থাকে। ফলে বছরের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এ সময়টাতে সফ্টড্রিংসের চাহিদা বেড়ে যায়। ইচ্ছে করলে ব্যবসায়ীরা এ সময় রমরমা ব্যবসা করতে পারেন, কিন্তু তারা তা করেননা। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পানীয়ের দাম বাড়িয়ে দেননা। বরং ক্রেতারা যাতে সহজেই স্বল্প মূল্যে কেনাকাটা করতে পারে সেই সুবিধার কথা বিবেচনায় এনে তারা অর্ধেকের চেয়েও কম দামে বিক্রি করে থাকেন। শুধু তাই নয়, শীতকালে শীতের বস্ত্র , গরম কালে গরম কাপড় চোপড়ের উপর ব্যাপক হারে ছাড় দেয়া হয়। ইস্টার, ক্রিসমাস, হ্যালুইন, সেইন্ট পেট্রিকস ডে, নিউইয়ার প্রভৃতি জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিকে কেন্দ্র করে থাকে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা। নিত্য নৈমিত্তিক জিনিস পত্র সহ ইলেকট্রনিক ও পোশাকাদির উপর বিরাট মূল্যহ্রাস করা হয়। ক্রিসমাসের সময় সব্জি, ফলমূল, পেঁয়াজ, রসুন প্রভৃতি জিনিস গুলো নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে। বস্তুত ওই বিশেষ সময় গুলোতে তারা কোনো লাভের চিন্তা করেনা। যেহেতু সারা বছরই কমবেশি লাভ করে এবং জনগণকে দিয়েই তাদের ব্যবসা তাই ওই জনগণকে বিশেষ ভাবে খুশি করে রাখাটাও তাদের একটা দায়িত্ব বলে তারা মনে করেন। আর এ জন্যই কখনো তারা ভোক্তা ও সাধারণ জনগণের বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেননা। উপরন্তু সাধারণ জনগণের কথা ভেবে আরও বেশি মানবিক হয়ে ওঠেন। সাধারণ ভোক্তা শ্রেণী বা জনগণ যাতে অতি সহজেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করে বিশেষ দিবস বা অনুষ্ঠানাদি আনন্দের সাথে পালন করতে সক্ষম হয় হয় সে প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ী মহল সহমর্মিতার দরজা খুলে দেন।
অথচ আমাদের দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় ঠিক উল্টো চিত্র। ঝোপ বুঝে কোপ মারাই যেনো আমাদের অধিকাংশ ব্যবসায়ীদের ধর্ম। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মনোবাসনাই তাদেরকে তাড়া করে ফিরে। সুযোগ পেলেই সিন্ডিকেটের কামড় বসিয়ে দিতে মোটেও দ্বিধাবোধ করেনা। বিশেষ বিশেষ সময়ে তাদের উৎপাত আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে প্রতি বছরই রোজা এলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি হয় পাগলা ঘোড়ার মতো। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। গতকাল বড়ো ভাইয়ের সাথে কথা হয়। তিনি আক্ষেপ করে বললেন, রোজা আসার আগেই সব জিনিস পত্রের দাম বেড়ে গেছে। উপরন্তু চলছে লকডাউন। এ লকডাউনের অজুহাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা আরও বেসামাল হয়ে পড়ছে। যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে মধ্যবিত্ত ভোক্তা শ্রেণীর উপর।
মানুষ এখন আর করোনাকে ভয় করেনা। বরং করোনাকে নিয়তি ভেবেই অধিকাংশ মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। কাজেই লকডাউনের নিছক বেড়াজালে তারা আর বন্দী থাকতে চায়না। তাছাড়া যে লকডাউনের ফলে জিনিস পত্রের দাম আকাশচুম্বি হয়ে যায়, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ক্রোর হাসি হাসার সুযোগ পায় একটি অংশ, রুটিরুজির পথ বন্ধ হয়ে যায় সিংহ ভাগ মানুষের, যে লকডাউনের নামে হাজার হাজার ঘরমুখী মানুষ নিরাপদ দূরত্ব অগ্রাহ্য করে গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরে কি দরকার এমন খামখেয়ালিপনা লকডাউনের। এতে কেবল শ্রমজীবী মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। তারা না করতে পারে কাজকর্ম, না পারে উর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে।
লকডাউনের ঠিক আগের দিন খবর পেলাম, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহের হাওরাঞ্চল ঝলসে গেছে এক ‘আশ্চর্য রকমের এক’ তীব্র গরম বাতাসে। এমন “রাক্ষসী” বাতাস এর আগে কেউ কখনো দেখেনি। ইতিপূর্বে প্রচন্ড খরায় ধান নষ্ট হওয়ার অনেক নজির থাকলেও এভাবে গরম হাওয়ায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার কোনো বেদনা বিধুর স্মৃতি কারো নেই। কয়েক ঘণ্টার তীব্র গরম হাওয়া ও ঝড়ে ধান গাছের শীষ নষ্ট হয়ে গেছে। আমার এক স্থানীয় সাংবাদিক বন্ধুর ভাষ্য মতে, কোথাও ধান চিটা হয়েছে। কোথাও পরাগায়ণ হতে পারেনি। কোথাও ধানের শীষের রঙ কালো আবার কোথাও সাদা হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে ধানের। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলেই ক্ষতিটা বেশি হয়েছে। সুনামগঞ্জের শাল্লাতেও ক্ষতি হয়েছে বোরো জমিনের। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির বোরো মওসুমের ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে কৃষিবিভাগ। তাই ক্ষতিগ্রন্থ কৃষকদের কান্না ও আহাজারিতে হাওড়াঞ্চলের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় এসব অসহায় দরিদ্র কৃষক সহ শহরের সাধারণ মানুষকে যদি বাজারের আগুন রূপ দেখতে হয় তবে তা হবে মরবে উপর খরার ঘা।
গতকালও পত্রিকাতে দেখলাম জিনিস পত্রের দাম আগুন। বরাবরের মতো রোজা উপলক্ষে এবারও শাকসবজি সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে আবার যোগ হয়েছে লকডাউনের অজুহাত। একটি প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিকের তথ্যানুযায়ী, বাজারে সবজির কোনো কমতি নেই। লকডাউনেরও কোনো প্রভাব নেই। সেই হিসেবে পন্যদ্রব্যের দাম স্বাভাবিক থাকার কথা ছিলো। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। কোনো রকম অজুহাত পেলেই হু হু করে দাম বাড়িয়ে দেন বিক্রেতারা।
এই যে বাড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা বা কালচার এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যারা সিন্ডিকেট করেন, যেসব ব্যবসায়ীরা অসৎ পথ অবলম্বন করে দ্রুত বড়ো হয়ে যেতে চান তাদেরকে বলবো, দয়া করে উন্নত বিশ্বের দিকে তাকান, উন্নত বিশ্বের ব্যবসায়ীদের মতো নিজেদের চরিত্রকে উন্নত করতে পারোন আর না পারোন, অন্তত পক্ষে উন্নয়নশীল দেশের ব্যবসায়ী হিসেবে চরিত্রের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হোন। পক্ষান্তরে সরকারকে বলতে চাই, সিন্ডিকেটকারী যেই হোক তার বিষদাঁত ভেঙ্গে দিতে হবে। রোজা চলছে। সামনে আসছে ঈদ। এভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে চলতে থাকলে জনগণের পিত্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। তাই এখনি দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরতে হবে এবং সিন্ডিকেটকারীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
লিমরিক, আয়ারল্যান্ড
লেখক – কবি ও প্রাবন্ধিক