প্রায় ৫০০ বছর যে মসজিদ থেকে ভেসে আসত সুললিত আজানের ধ্বনি সেখানে এখন বাজে গির্জার ঘণ্টা। কালের ঘূর্ণাবতে ইউরোপে মুসলমানদের সেই গৌরবাজ্জল সময় হারিয়ে গেলেও কোর্ডোভার সেই মর্মর শ্বেত পাথরের নিষ্প্রভ চাহনি আজও বহন করে চলেছে সে ইতিহাস।
‘’মস্ক দ্য ক্যাথেড্রাল’’ – মসজিদ ও গির্জা; নামটা কেমন আজিব না? হাজার বছরের মসজিদ হিসেবেই যে স্থাপনা পরিচিত ছিল তার নাম সরকার পরিবর্তন করে শুধু গির্জা রাখতে চেয়েছিল। এমনকি গুগল ম্যাপ থেকেও মুছে দেয়া হয়েছিল মসজিদের নাম। এরপর ২০১৪ সালে মুসলমানরা একটা পিটিশন করে এবং মুহূর্তের মধ্যে ২০,০০০ সাইনও হয়ে যায় পিটিশনে। এরপর আবার বাধ্য হয় নাম পরিবর্তন করতে ও গুগল সার্চে নাম ফিরিয়ে আনতে। এরপর মস্ক বা মসজিদ নামটাই যুক্ত করা হয়। আমরা দেখেছি ওইখানের লোকাল মানুষজন এখনো মসজিদ নামেই চিনে।
মস্ক দ্যা ক্যাথেড্রাল বর্তমান স্পেনের আন্দালুসিয়ার অঞ্চল কর্ডোভায় অবস্থিত। মুসলমানরা আন্দালুসিয়ায় শাসন প্রতিষ্ঠার পর উমায়েদ খেলাফতের খলিফা প্রথম আব্দুর রাহমান ৭৮৪ খ্রিস্টাব্ধে (প্রায় ১২০০ বছর পূর্বে) প্রথম মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন, প্রায় দুই বছরে মসজিদের প্রাথমিক নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। এর পর অন্যান্য খলিফারা পর্যায়ক্রমে মসজিদের পরিবর্ধন করেন। নির্মাণের পর ১২৩৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বছর এই মসজিদে নামাজ আদায় হয়েছে। শুধু নামাজ নয় ইসলামিক শিক্ষা, শরিয়া আইন, সালিশ ঘর, ব্যাবস্থাপনা কার্যাবলী ঐ মসজিদ থেকে সম্পাদন হত।
১ লাখ ১০ হাজার ৪০০ বর্গফুটের মসজিদের রয়েছে ৯ টি বাহির এবং ১১ টি অভ্যন্তরীণ দরজা। মসজিদের মোট থাম রয়েছে ৮৫৬ টি। থামগুলো নির্মিত হয়েছে মার্বেল, গ্রানাইট, জেসপার, অনিক্স পাথরের সমন্বয়ে এবং পরে স্বর্ণ, রৌপ্য ও তামাসহ সব মূল্যবান ধাতু ব্যবহার করা হয় সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য। মসজিদের অশ্বখুরাকৃতির লাল দাগ কাটা আর্চ বা খিলানগুলো প্রমাণ করে মুসলিম স্থাপত্যশৈলী এবং স্থাপত্য পাণ্ডিত্যের বহরকে। মসজিদের ইউনিক আর্চগুলো দেখলেই যে কেউ বুঝে যাবে মসজিদটি যে কর্ডোভার বিখ্যাত মসজিদ।
মসজিদের মিহরাব বা মিম্বরটি আজও সংরক্ষিত রয়েছে। দৃষ্টিনন্দন মেহরাব তৈরি করা হয়েছে সূক্ষ্ম কারুকাজ সম্বলিত দক্ষ হাতের সুনিপুণ চোঁয়ায়। মিম্বরে আজও সেঁটে আছে আরবি ক্যালিগ্রাফির হরফগুলো। অনিন্দ্য সুন্দর ও আকর্ষণীয় মিহরাবগুলো স্থাপিত ছিল পাথরের নির্মিত এক হাজার ৪১৭টি স্তম্ভের ওপর। মিহরাবের কাছে একটি উঁচু মিম্বর ছিল হাতির দাঁত ও ৩৬ হাজার বিভিন্ন রং ও বিভিন্ন কাষ্ঠ নির্মিত। সেগুলোর ওপর ছিল হরেক ধরনের হীরা-জহরতের কারুকাজ। দীর্ঘ সাত বছরের পরিশ্রমে মিম্বরটি নির্মাণ করা হয়।এই মিম্বরে দাঁড়িয়েই একসময়ে অনলবর্ষী খুতবা প্রদান করতেন মুনযির ইবনে সাঈদ, ইমাম কুরতুবি (রহ.) এর মত স্কলারগন।
সমগ্র মসজিদে ছোট বড় প্রায় ১০ হাজার জাড়বাতির মধ্যে ৩ টি জাড়বাতি ছিল রৌপ্য নির্মিত। বড় আকারের ঝাড়বাতিগুলোতে প্রায় ৫০০ এর মত বাতি প্রজ্বলন করা যেত এবং বড় তিনটি ঝাড়বাতিতে একাই লাগত প্রায় ৩৬ সের তেল।
মসজিদটি এতই বিশাল, এতই বিশাল যে না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস হবেনা। হাজার বছর পূর্বে এত বড় আয়তনের এত সৌন্দর্যে ভরপুর, অনন্য সাধারণ স্থাপত্য ও শিল্পকর্মে নির্মিত আড়ম্বরে ভরপুর একটি মসজিদ কল্পনা করা যায়? এতে খুব সহজে অনুমান করা যায় তৎকালীন মুসলিম স্থাপত্যের মুনশিয়ানার ব্যাপারে।
‘লা মেজিকেতা’ বা ‘দ্য গ্রেট মস্ক অব কর্ডোভা’ শুধু নামাজ পড়ার স্থান হিসেবেই ব্যবহৃত হত না। এটি ছিল শিক্ষা, গবেষণা, আইন প্রণয়ন, রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হত। এখানে বসে শিক্ষার আলো ছড়াতেন ইমাম ইবনে আরাবি (রহ.), ইমাম বাকি ইবনে মাখলাদ (রহ.), ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহিয়া আন্দালুসি (রহ.), ইবনে হাজাম জাহেরিসহ (রহ.) অসংখ্য জগদ্বিখ্যাত আলেম ও সুফিরা। তাইতো কর্ডোভা হয়ে উঠেছিল তৎকালীন ইউরোপের বাতিঘর।
যাই হোক কোন সাম্রাজ্য বা কারো ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। মুসলমানরা ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করল ইউরোপ থেকে। একটা একটা শহর করে চলে যেতে লাগল খ্রিঠানদের দখলে। কর্ডোভাও এর ব্যাতিক্রম ছিলনা। ১২৩৬ সালে রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা কর্ডোভা দখলে নিয়ে এই মসজিদকেও গির্জায় পরিণত করে। এরপর মসজিদের অনেক অবকাঠামো পরিবর্তন করা হয়। কিছু অংশ ভেঙ্গে গির্জায় পরিণত করা হয়। যে মিনারটি ব্যবহৃত হত আজানের জন্য সে মিনারে এখন ঝুলছে গির্জার ঘণ্টা।
বর্তমানে মসজিদে নামাজ সম্পূর্নরূপে নিষিদ্ধ, মসজিদ দখলের ৭০০ বছরে মসজিদে আর কোন নামাজ হয়নি। এমনকি কেউ হাঁটু গেড়েও বসতে পারবেনা। শুধুমাত্র ১৯৩৩ সালে বিখ্যাত লেখক আল্লামা ইকবাল কর্ডোভা মসজিদ সফরে গেলে উনাকে বিশেষ অনুমতি দেয়া হয় নামাজ আদায়ের জন্য। কড়া নিরাপত্তায় তিনি মসজিদের ভেতর ঢুকে আজান দিয়ে নামাজে দাঁড়ান। নামাজরত অবস্থায় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে উনি যে মোনাজাত করেন তা একটি কবিতায় পরিণত হয়। ‘’বালে জিবরীল’ নামক কবিতাটিই ছিল সেই মোনাজাত।
সর্বশেষ ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ১৯৭৪ সালে নামাজের অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল।
মসজিদটির একাংশ এখন ক্যাথেড্রাল বা গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং দর্শনার্থীদের জন্য দর্শন উন্মুক্ত রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মসজিদটি দেখতে ভিড় জমায়। সময় পেলে আপনিও ঘুরে আসুন। নিজের চোখে না দেখলে কখনো অনুভবই করতে পারবেন না যে এই লেখা দ্বারা কি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
লেখা ও ছবিঃ ওমর এফ নিউটন
প্রধান বার্তা সম্পাদক
আইরিশ বাংলা টাইমস