ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর চেয়ে চারগুণ বেশি অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে হবে ব্রিটেনকে, এমন পূর্বাভাস দিয়েছে ইউরোপীয়ান কমিশন।
ব্রিটেনের সাথে নতুন সম্পর্কের এক মাসের মাথায় ইউরোপীয় সংস্থাটি বলেছে, বরিস জনসনের সরকার যেসব শর্তের ভিত্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেড়িয়ে গেছে, সেগুলোর কারণে দেশটি ২০২২ সাল শেষে বর্তমানের তুলনায় ২.২৫ শতাংশ জিডিপি ঘাটতিতে পড়বে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য একই সময়ে এই ক্ষতির হার হবে ০.৫ শতাংশ।
সংস্থাটি বলছে, গত ডিসেম্বরে ১১ ঘণ্টায় সম্পাদিত শেষ মুহূর্তের বাণিজ্য চুক্তির ফলে বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হলেও দুই বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে অন্তত ৪০ বিলিয়ন ইউরোর সমপরিমাণ এবং এই চুক্তির বিষয়ে এখনো কিছু বাধা রয়েছে, যা ব্রিটেনের জন্য আরো বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে সংস্থাটি মনে করছে।
শীত মৌসুম নিয়ে এক অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে ইউরোপীয়ান কমিশন বলেছে, ব্রিটেন ও ইইউ’র মধ্যে চুক্তিহীন বিচ্ছেদের চেয়ে মুক্তি বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) অপেক্ষাকৃত ভালো হলেও, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে যতটা সুবিধা পায় সেটি পাবে না ব্রিটেন।
শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের বেশির ভাগই ইতোমধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছেন যে, ব্রেক্সিটের ফলে ইইউ’র চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্রিটেন। তবে ইউরোপীয়ান কমিশন এবার যে হিসাব দিয়েছে সেটি ব্রেক্সিট কার্যকরের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম আনুষ্ঠানিক হিসাব।
নতুন আইন চালু হওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের ওপর যে চাপ অব্যাহত রয়েছে সেটির কথা মাথায় রেখেই ব্রিটেনের ক্ষতির এই হিসাব দেয়া হয়েছে। তার ওপর ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো সতর্ক করে দিয়েছে যে, চলতি বসন্তের শেষে সীমান্তে বাড়তি তল্লাশি চালু হলে আরো বেশি সমস্যার মুখোমুখী হবে বাণিজ্য খাত।
লন্ডন ও ব্রাসেলসের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তাতে দুই পক্ষের মাঝে শুল্কবিহীন পণ্য বেচাকেনার কথাও রয়েছে। তবে নতুন কাগজপত্র, কাস্টমস তল্লাশি ও নতুন আইন নিয়ে দ্বিধার কারণে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত খরচ ও বিলম্বের শিকার হচ্ছেন। যে কারণে ইউরোপীয়ান কমিশন বলছে, তথাকথিত এই শুল্কহীন বাণিজ্যের প্রভাবে কখনো কখনো আমদানির ওপর ট্যাক্স বেড়ে দাড়ায় ইইউ’র জন্য ১০.৯ শতাংশ এবং ব্রিটেনের জন্য ৮.৫ শতাংশ। সংস্থাটি আরো বলছে, আয়ারল্যান্ডের মতো যেসব দেশের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে পণ্যের বিশাল বাজার রয়েছে, তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার সেবাখাত বিষয়ে কোন চুক্তি না হওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ব্রিটেন, কারণ দেশটির অর্থনীতির ৮০ শতাংশই সেবাখাত নির্ভর। ইউরোপের যেসব দেশের অর্থনীতিতে সেবাখাতের বড় অবদান রয়েছে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তবে সব কিছুর পরেও শেষ মুহূর্তে একটি ব্রেক্সিট চুক্তি উভয় পক্ষকেই বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছে বলে ইউরোপীয়ান কমিশন মনে করছে। তাদের ২০২১ সালের শীতকালীন অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে দেখানো হয়েছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিতে যথাক্রমে ৩.৭ ও ৩.৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটবে। চলতি বছরের শুরুর দিকে লকডাউনের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কারণে সেটি হয়তো পুষিয়ে যাবে বছরের শেষ দিকে। আর ২০২২ সালে অর্থনীতি আবার মহামারী পূর্ব অবস্থার মতো জায়গায় ফিরে আসবে। এবং সেটি যতটা ভাবা হয়েছিল তার চেয়েও দ্রুত ঘটবে।
ইউরোপীয়ান কমিশন বলছে, কিছু দেশ যেমন ইতালি ও স্পেনের অর্থনীতি আগের অবস্থায় ফিরতে ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত লেগে যাবে, বিশেষ করে দক্ষিণ ইউরোপে যাদের অর্থনীতি পর্যটন খাত নির্ভর।
ইউরোপীয়ান কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২১ সালে আয়ারল্যান্ডের প্রবৃদ্ধি ৩.৪ শতাংশ ও ২০২২ সালে ৩.৫ শতাংশে গিয়ে দাড়াবে। তবে গত মাসে প্রকাশিত দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাসে চলতি সালে ৩.৮ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৪.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ভবিষ্যতবাণী করেছে যে, চলতি বছরের শেষ দিকেই জিডিপি মহামারী পূর্ব অবস্থার মতো জায়গায় ফিরলে ২০২১ সালে ব্রিটেনের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ শতাংশ আর ২০২২ সালে সেটি গিয়ে দাড়াবে ৭.২৫ শতাংশে। কোভিড ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনায় ব্রিটেন দক্ষতার পরিচয় দেয়ার কারণে এমনটি ঘটবে বলে ধারণা ব্যাংকটির।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান ১১/০২/২০২১