আইরিশ রাজনীতিতে বাঙ্গালি রাজপুত্তুর

0
513
১৯ জুন ২০২৩ আয়ারল্যান্ডস্থ বাংলাদেশিদের জন্য একটি গৌরবময় দিন। এক যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টির দিন। এ দিনে বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার কৃতি সন্তান জনাব আজাদ তালুকদার লিমরিক সিটি কাউন্সিলের কাহার্লক (লিডার অফ দ্যা সিটি, যাকে আগে সিটি মেয়র বলা হতো) পদে নির্বাচিত হয়ে কেবোল নিজের নন গোটা বাঙ্গালি জাতির মুখ উজ্জ্বল করেন।
তাঁর এমন বিজয় কৃতিত্বে সুকান্তের সেই “দুর্মর” কবিতাটির কথা আবারও মনে পড়লো-
” সাবাস, বাংলা দেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়:
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।”
সত্যি, আজাদ তালুকদারকে সেদিন মাথা নোয়াতে হয়নি। বরং বীরের বেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে লিমরিক সিটি ও কাউন্টি কাউন্সিল চেম্বার হলে। সাবাস আজাদ তালুকদার। সাবাস বাংলাদেশ।
.
আজাদ তালুকদার আজ কেবোল একটি নাম নয়, ইতিহাসও বটে। আইরিশ স্থানীয় সরকারের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজ থেকে ২০/২২ বছর আগে এ দেশে এসেছিলেন নিতান্তই জীবিকার তাগিদে। ভালো জীবনের প্রত্যাশায়। বছর বছর ওয়ার্কপার্মিট নবায়ন করে থাকতে হয়েছে বেশ ক’বছর। সে সময়টা ছিলো বেশ কঠিন। কোম্পানি ওয়ার্ক পার্মিট নবায়নে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেই দেশে ফিরে যাবার ভয়। অর্থাৎ সে আমলে বলতে গেলে পায়ের নীচে মাটি ছিলোনা। এ দেশে আদৌ কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা হবে কি-না, স্থায়ী ভাবে বসবাস করা যাবে কি-না তার কোন নিশ্চিত গ্যারান্টি ছিলোনা। তাই যে লোকটি একদিন এ দেশে তার স্থায়ীত্ব নিয়ে চিন্তিত থাকতেন, আগামিকালের সূর্যোদয়টা কেমন হবে সেটা নিয়ে যাকে প্রতিনিয়ত ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো সেই তিনি আজ ওই দেশে একটি বৃহৎ নগরীর কাহার্লক। ফলে তিনি আজ নিজের কথা ভাবতে পারেন না। তাকে এখন ভাবতে হয় গোটা শহরের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন নিয়ে। ভাবতে হয় ওই শহরে বসবাসরত সকল মানুষের সুস্থ, নিরাপদ ও প্রাঞ্জল জীবনযাপন নিয়ে।
.
সাধারণত ওই জাতীয় নির্বাচনে বহিরাগতদের উপস্থিত থাকার রেওয়াজ খুব বেশি একটা নেই। কিন্ত ওইদিন জনাব আজাদ তালুকদারের বিশেষ আমন্ত্রনে গোটা আয়ারল্যান্ড থেকে প্রায় ৬০/৭০ জন বাঙ্গালি লিমরিক সিটি ও কাউন্টি কাউন্সিল চেম্বার হলে জড়ো হন। তন্মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। নিজেকে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে সংযুক্ত করার সৌভাগ্য হলো। সে এক আবেগঘন পরিবেশ। ফিনাফল কাউন্সিলর (সাবেক মেয়র) মি জেমস কলিন্স তার অন্যতম সহকর্মী মিস ক্যাটরিন স্লাটারির সমর্থনে জনাব তালুকদারকে কাহার্লক পদে আসীনের প্রস্তাব ঘোষণা করলে এর বিপরীতে কাউন্সিলর মি শন হার্টিগানের প্রস্তাবনায় এবং এলিনা সিকাসের সমর্থনে মিস শাসা নোভাকের নাম চলে আসে। অর্থাৎ একই পদের জন্য দুজন প্রার্থীর মনোনয়ন ঘোষিত হলে নির্বাচনের আশ্রয় নিতে হয়। ফলে চেম্বার হলে উপস্থিত একুশজন কাউন্সিলরের চাক্ষুষ ও প্রত্যক্ষ ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
.
অভূতপূর্ব এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। কর্মকর্তাদের একজন নির্বাচন পরিচালনা করছিলেন। তিনি মাইক্রোফোনে প্রত্যেক কাউন্সিলরকে সরাসরি ভোট দেয়ার আহ্বান জানালে তাদের অধিকাংশই জবাব তালুকদারকে ভোট দিচ্ছিলেন। ভোট দিতে গিয়ে তাদের কেউ কেউ যখন “টালূকদার” “অ্যাজাদ” কিংবা “তালুকদার” উচ্চারণ করছিলেন তখন আমার রক্তধমনীতে একটি ছন্দিত আবেগ প্রবাহিত হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এ যেনো কেবোল আজাদের নামটি নয়, বরং গোটা বাংলাদেশের নামটি তাদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। সত্যি বলতে, বাংলাদেশের ক্রিকেট দল বিদেশ বিভূইয়ে অন্য কোনো দলের সঙ্গে খেললে বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে হৃদয়ে জাতীয়তাবাদের যে বোধ বা অনুভূতি জেগে ওঠে, আমার বিশ্বাস ওইদিন উপস্থিত প্রতিটি বাঙ্গালি হৃদয়েই তেমন একটি বোধ বা অনুভূতি জেগে উঠেছিলো। 
.
নির্বাচন শেষে যখন জানা গেলো তেরো ভোট পেয়ে ছয় ভোটের ব্যবধানে আজাদ তালুকদার জয় লাভ করলেন তখন লিমরিক কাউন্টি কাউন্সিল হলটি যেমন উল্লাসে ফেটে পড়ছিলো তেমনি আমাদের অনেকেরই আবেগাশ্রুকে দমিয়ে রাখতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো।
.
আনুষ্ঠানিক বিজয় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক মুহূর্তে সদ্য বিদায়ী কাহার্লক জনাব আজাদ তালুকদারকে উষ্ণ অভিনন্দন।
নবনির্বাচিত সিটি মেয়র

ও স্বাগত জানিয়ে তাঁর চেয়ারে নিয়ে বসান। চেয়ারে বসে তিনি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রতিক্রিয়ামূলক স্বাগতিক বক্তব্য প্রদান করেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে এ অনুষ্ঠানের মূল পর্ব।

এরপর শুরু হয় ছবি ও সেলফি তোলার পর্ব। বিজয় আনন্দে উদ্বেলিত বাঙ্গালি নবনির্বাচিত কাহার্লকের সাথে যখন একের পর এক ছবি তুলছিলো তখন দুই ভদ্রলোক কানাকানি করে ন্যাক্কারজনক কিছু কথা বলে। পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন এক ভদ্রমহিলা, আমাদেরই ভাবী। তাদের ওই ইঙ্গিতসূচক কথাবার্তা তার কানে বাজে। তিনিও ছবি তুলে সেখানে গিয়ে দাঁড়ান মাত্র। অদূরে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবী আমার কাছে এলেন এবং ওই দুই ‘কানামাছি” খেলার খেলোয়াড়ের কথোপকথন বেশ অভিযোগের স্বরেই আমাকে জানালেন। পরিবেশের সৌন্দর্য হানি ঘটতে পারে ভেবে আমি তাকে বিনয়ের সাথে নীরব থাকার অনুরোধ জানাই।

বস্তুত ওইখানে উপস্থিত প্রতিটি বাঙ্গালিই ছিলো আজাদ সাহেবের আমন্ত্রিত অতিথি। তাদের কাউকে বাঁকা কথা বলা বা হেয় প্রতিপন্ন করা পরোক্ষ ভাবে জনাব আজাদকেই ছোট করার সামিল। তা ছাড়া তাদের হেন আপত্তিজনক কথাবার্তায় ক্ষেপে গিয়ে কেউ কেউ যদি ওদের মুখের উপর জুতো ছুঁড়ে মারতো কিংবা তাদের কালার চেপে ধরতো তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতি কি আদৌ সামাল দেয়া যেতো! আর সামাল দিতে না পারলে সাদা আইরিশদের কাছে কি বার্তা পৌঁছাতো! আজাদ তালুকদার বা গোটা বাঙ্গালির গায়ে যে কলঙ্ক তিলকের দাগ লাগতো তা-কি আমাদেরকে অকুন্ঠ ভাষায় তীব্র ভাবে তিরস্কৃত করার জন্য আরও সহায়ক হয়ে উঠতোনা!

কথায় আছে “চোরে চোরে মাসতুতো ভাই”। অর্থাৎ উল্লেখিত দুই ব্যক্তি একই পথের পথিক। বন্ধুর পোশাক পরে কৌটিল্যের কূটচাল আঁটতে ওরা দুজনেই বেশ পারদর্শী। এর আগেও এদের মাঝে এমন প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০১৯ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর আজাদ তালুকদার বিজয়তৃপ্তির আনন্দ প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে গোটা আয়ারল্যান্ডের অভিবাসন কমিউনিটি নিয়ে এক ভুরিভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পানাহার শেষে ওই দুই মহারথীর একজন ইনজামুল হক জুয়েল (বর্তমানে কর্ক নিবাসী) ও আমার সামনে একটি বিশেষ দলের সাফাই গাইতে গিয়ে বলে বসলো, “আজাদ ভাইতো আমাদের দলের লোক, তার বিজয় মানে আমাদের বিজয়।” তার এমন কান্ডজ্ঞানহীন বেসামাল মন্তব্য শুনামাত্রই আমি ও জুয়েল দুজনই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলি, “এসব হিংসাত্মক, বিভাজন ও উস্কানিমূলক কথা বলে দয়া করে আজাদ ভাইয়ের কোনো ক্ষতি করবেন না। কারণ, বিশেষ দলের ব্যক্তি হিসেবে কেউ আজাদ ভাইকে ভোট দেয়নি। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাকে ভোট দিয়েছে বা তার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে কেবোল তিনি একজন বাঙ্গালি, একজন বাংলাদেশি।”

দ্বিতীয় মহারথী ঠিক একই ভাবে একদিন শ’খানেক মুসুল্লির সামনে বেশ তাচ্ছিল্যভরে বললেন, ” অ্যারে সে কিসের কাউন্সিলর! এখনোতো সে ওই কাজটিই করে।” তার পেশাগত কর্মের প্রতি এমন অসম্মানসূচক অঙ্গলি হেলন সত্যি দুঃখজনক। ওদের কুচিন্তার কাছে সকল ভালো কাজই যেনো হার মানে। পরের মন্দ খোঁজা ও ক্ষতি করে বেড়ানোর এদের এই কুৎসিত স্বভাব একদিন যে এদেরকেই কামড় দেবে তা তারা কখনও বুঝে উঠতে চায়না। ফলে এরা আরও কৌশলী হয়ে উঠে। তাইতো দেখা যায় আজাদ সাহেবের সামনে এরা শুদ্ধ মানুষ(!), তার পা চাঁটে, প্রশংসায় মুখে ফেনা তোলে। অগোচরে ছিদ্র খোঁজে বেড়ায়। সুতারাং জনাব আজাদকে বলবো, তিনি যেনো বন্ধু বেশধারি এসব দুমুখা বিষধর সাপের ব্যপারে আরও বেশি সতর্ক হোন।

আজাদ তালুকদার ২০১৯ সালে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০২১ সালে কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। এবার একই ভাবে সিটি মেয়র বা কাহার্লক নির্বাচিত হয়েছেন। এই যে তার অর্জন ও সফলতা তা মোটেও ছেলের হাতে মোয়া নয়। আলাদিনের চেরাগ বা কারো দয়া দাক্ষিন্য কিংবা করুণার উপর ভর তিনি এতো দূর এগিয়ে আসেননি। এ জন্য তাকে রাতদিন যন্ত্রের মতো কাজ করতে হয়েছে। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা সাধন করতে হয়েছে। আয়ারল্যান্ডে আজাদ তালুকদারের বসবাস শুরু মাত্র ২০/২২ বছর আগে। এর মধ্যে নিজের জীবন ও সংসার গোছানো তথা পায়ের নীচে মাটি ঠেকাতেই চলে গেছে ১০/১৫ বছর। বাকি যে কয়েক বছর তা নিজেকে নায়কোচিত সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য মোটেও যথেষ্ট সময় নয়। কিন্ত তিনি তার বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা, চৌকষ গুণাবলী, সহযোগি ও বন্ধুবাৎসল্য মনোভাব, পরিচ্ছন্ন ও পরীশীলীত জীবন যাপনের মাধ্যমে অবিশ্বাস্য ভাবে এ অল্প সময়ের মধ্যেই আইরিশ রাজনীতিতে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এ অবস্থান যে কেবোল তার নিজের দলেই সীমাবদ্ধ তা নয়, অন্য দলের নেতাকর্মীদের সাথেও রয়েছে তার বেশ সখ্যতা ও ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক। কাহার্লক নির্বাচনে স্বীয় দল ফিনাফল ছাড়াও অন্যান্য দলের কাউন্সিলরদের একচেটিয়া ভাবে ভোট প্রাপ্তিই এর বড়ো প্রমাণ।

প্রতিটি গোত্রে, প্রতিটি সমাজে, প্রতিটি দেশে বা জাতিতে রেসিজমের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। কোথাও একটু বেশি, কোথাও একটু কম। কোথাও স্থূল, কোথাও সূক্ষ্ম। আজাদ সাহেব যে প্ল্যাটফর্মে আছেন সেখানেও যে রেসিজমের কোনো অস্তিত্ব নেই তা হলফ করে বলা যাবেনা। ভিন্ন ধর্মী, ভিনদেশি ও ভিন্ন সংস্কৃতিমনা একজন মামুলি আজাদ তালুকদার লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠবে আর স্থানীয় আইরিশরা চেয়ে চেয়ে দেখবে ও আনন্দভরে তাকে মাথায় নিয়ে নাচবে, বিষয়টা মোটেও সে রকম নয়। এখানেও হীনমন্যতা আছে, হিংসা-প্রতিহিংসা আছে। বিদ্বেষ আছে। আছে সূক্ষ্ম রেসিজমও। এতো সব প্রতিকুলতা, প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উপরে উঠার জন্য যে প্রজ্ঞা, অঙ্গীকার বা যোগ্যতা থাকার প্রয়োজন তার সবই আজাদ তালুকদারের রয়েছে। সত্যি বলতে, আইরিশ রাজনীতিতে যোগ দিয়ে এতো অল্প সময়ে সফলতার যে জাদু আজাদ তালুকদার দেখিয়েছেন তাতে তাকে রাজনীতির রাজপুত্তুর বললেও অত্যুক্তি হবেনা। তবে এ রাজপুত্তুরের পথ মোটেও মসৃণ নয়। তাকে টেনেহিঁছড়ে নিচে নামানোর লোকের অভাব নেই। নিজ দলে ও অভিবাসন কমিউনিটিতে যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ওই বন্ধুবেশদারি ধূর্তদের মাঝেও। সুতরাং আইরিশ রাজনীতিতে ওই বাঙ্গালি রাজপুত্তুরের ধারাবাহিক জাদুকরী সফলতাকে ধরে রাখতে হলে প্রতিটি বাঙ্গালিকে যেমন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে স্বচ্ছ হৃদয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে তেমনি একজন সচেতন কাণ্ডারির মতো আজাদ তালুকদারকেও পা ফেলতে হবে বেশ মেপে মেপে।

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
কবি ও কলামিস্ট, লিমরিক
২৭ জুলাই ২০২৩
Facebook Comments Box