ফেনীতে চীন ফেরত ছাত্র ইউনুস বাবু (২৩) হত্যা মামলায় তাসফিয়া ভবনের কেয়ারটেকার মোজাম্মেল হক শাহীনের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এ সময় আদালতে চীন ফেরত বাংলাদেশি ছাত্র খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয় কেয়ারটেকার।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী শহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সুদ্বীপ রায় সোমবার দুপুরে মোজাম্মেল হক শাহীনের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এ সময় আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ইঞ্জিনিয়ার বাবুকে হত্যার কারণ জিজ্ঞাসা করলে মোজাম্মেল হক শাহীন জানায়, পূর্ববিরোধের জেরে ডেকে এনে শাহীন ও ফেনী পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি রাকিবসহ তাদের সহযোগীরা ইঞ্জিনিয়ার বাবুর বন্ধু শাহরিয়ারকে হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়ি কোপায়। এ সময় বাবু এগিয়ে এসে বাধা দিলে তাকেও কুপিয়ে হত্যা করে। পরে দুইজনকে হাত-পা বেঁধে সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেয়া হয়।
শনিবার রাত ১টার দিকে ফেনী শহরের শফিকুর রহমান সড়কের তাসফিয়া ভবনের সেপটিক ট্যাংক থেকে ইঞ্জিনিয়ার বাবুর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
বাবুর মা রেজিয়া বেগমের ধারণা- বাবুর কাছে একটি দামি আইফোন এবং তার বন্ধু শাহরিয়ার কাছে থাকা মোটরসাইকেল আত্মসাৎ করতে বাবু ও শাহরিয়ারকে পরিকল্পিতভাবে উপর্যুপরি কুপিয়ে সেপটিক ট্যাংকে ফেলা হয়েছে। তিনি দ্রুত রাকিবকে আইনের আওতায় এনে হত্যা রহস্য উন্মোচন করে ন্যায়বিচারের দাবি জানান।
এদিকে বাবুর মায়ের আহাজারি কোনোভাবেই থামাতে পারছেন না আত্মীয়স্বজনরা। তিনি প্রিয়সন্তানকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। জ্ঞান ফিরলেই শুধু বাবুকে খুঁজছেন।
নিহত ইউনুস বাবু সোনাগাজীর বগাদানা ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের সওদাগর বাড়ির মো. আবু ইউছুফের ছেলে। বাবু ফেনী আইসিএসটি থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে স্কলারশিপ নিয়ে দেড় বছর যাবত চীনের আহট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
নিহত বাবুর মা রেজিয়া বেগম জানান, করোনার সময়ে ছেলে দেশে এসে বাবা-মায়ের সঙ্গে ফেনী শহরের একটি বাসায় থাকত। তার নানাবাড়ি সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের চরসোনাপুর তিনবাড়িয়া গ্রামে। ২০১৩ সালে সোনাগাজী আল হেলাল একাডেমি থেকে বাবু এসএসসি পাস করেছিল।
গত ৮ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে বন্ধু ইউনুস নবী রাকিব ও শাহরিয়ার বাবুকে বাসা থেকে ডেকে এনেছিল। একই দিন ভোর ৪টার দিকে তাসফিয়া ভবনের মালিকের স্ত্রী তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য উঠলে সেপটিক ট্যাংকের ভেতর থেকে আল্লাহ আমাকে বাঁচাও ডাক শুনতে পান। এ সময় তিনি আরও দেখতে পান বাড়ির কেয়ারটেকার তার ভাগ্নে মোজাম্মেল হক শাহীন মেঝেতে পড়ে থাকা রক্ত পরিষ্কার করছেন। তাৎক্ষণিক বিষয়টি তার কাছে সন্দেহজনক মনে হলে কেয়ারটেকারকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন।
সেই একই সেপটিক ট্যাংক থেকে অজ্ঞান অবস্থায় বাবুর বন্ধু শাহরিয়ারকে উদ্ধার করা হয়। গলা কাটাসহ তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি কোপের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
শাহরিয়ার ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের আমানউদ্দিন ভূঞাবাড়ির কামাল উদ্দিনের ছেলে। তাকে প্রথমে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ও পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার সামান্য জ্ঞান ফিরলে বন্ধু বাবুকে খুঁজতে থাকে।
এদিকে বাবুর মা বন্ধু ইউনুস নবী রাকিবকে নিয়ে একাধিকবার থানায় গিয়ে এসআই বিকাশ দাসের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং সেপটিক ট্যাংকে তল্লাশি চালাতে বলেন। তিনি সেপটিক ট্যাংকে তল্লাশিতে অনীহা প্রকাশ করে শাহরিয়ারকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় বাবু জড়িত আখ্যা দিয়ে তাকে উল্টো ভয় দেখান এবং তার ছেলে শাহরিয়ারকে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করা হয়।
ওই মামলায় কেয়ারটেকার মোজাম্মেল হক শাহীনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাবু ও মোজাম্মেল হক শাহীনসহ শাহরিয়ারকে হত্যাচেষ্টার স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। শাহরিয়ারের জ্ঞান ফিরলে বাবুকে খোঁজার রহস্য জানতে বাবুর মা পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন।
এক পর্যায়ে নিজে ও তার স্বামী নেমে হলেও সেপটিক ট্যাংক তল্লাশি করার জন্য দিনভর বাড়িওয়ালি ও ফেনী থানার এসআই বিকাশ দাসের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন। ইউনুস নবী রাকিব ওই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে দিনভর আড্ডা দিলেও রহস্যজনক কারণে তিনি তাকে আটক বা গ্রেফতার করেননি।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাড়িওয়ালির অনুমতি নিয়ে বাবুর মা-বাবা সেপটিক ট্যাংকের তালা ভেঙে টর্চ লাইট মেরে তল্লাশি করলে প্লাস্টিকের পলিথিন মোড়ানো কি যেন দেখতে পেয়ে পুনরায় থানা পুলিশকে ঘটনাস্থলে ডেকে নেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের দল পুলিশ ও স্থানীয় জনতার চেষ্টায় শনিবার রাত ১টার দিকে বাবুর লাশ উদ্ধার করে। এই ফাঁকে রাকিব আত্মগোপনে চলে যায়।