কল্পনার জীবন – মামুন আলম
দ্বিতীয় পর্ব: আজকাল প্রায় সময়েই প্রস্রাবে রক্ত পড়ে অনিমেষের। কিডনি খারাপ হয়ে গেছে। ভালো চিকিতসার জন্য প্রয়োজন অনেক টাকার। কাউকে অসুখের কথা বলতে ভালোও লাগে না। নয়ন অবশ্য খানিকটা বুঝতে পারে। তাদের গুরুদেব সুস্থ নেই। নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়ে গেছে। ছেলেরা আলম সাহেবের সঙ্গেও আলোচনা করেছে। টাকার জোগাড় প্রায় হয়ে গেছে। এবার দিনক্ষণ দেখে ভেল্লোরে যাবে সবাই মিলে। অনিমেষকে হারানো চলবে না।
অনিমেষের খুব ইচ্ছে ছিল আমেরিকা ঘুরতে যাওয়ার। কিছু টাকা জমিয়েও রাখা আছে। শরীরের জন্য আর হয়ে উঠবে না। অনিমেষ একদিন ছেলেদের অগোচরে ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে আনে। তারপর প্রায় প্রতিদিনই ভালোমন্দ খাবারের আয়োজন করতে থাকে। ছেলেগুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অনিমের বুদ্ধিদৃপ্ত সরল ও প্রতিভাময় মুখের দিকে। কি অবিচল, মুখে কি দারুন নির্মল হাসি।
সকল অসুখ যেন হার মেনে গেছে। অনুপম বেঙ্গালোরে পড়াশোনা করে। অনিমেষের অস্বাভাবিক আচরণের কথা শুনে গতকাল ফিরেছে বাড়িতে। দিব্যেন্দু, আলোক, মতিন সকলেই খুব চিন্তিত। কিন্তু মুখ ফুটে কেউ জিগ্যেস করতে সাহস করে না। পরশু ভেল্লোরে নিয়ে যাওয়া হবে অনিমেষকে। অনিমেষ তা জানে না। টিকিট, হোটেল বুকিং, ডাক্তার এপয়েনমেন্ট সব করে রেখেছে ছেলেরা। আলম সাহেবের পরিবার এবং ছেলেরা মোট ১১ জনের টিম।
আজ সকাল যেন অনিমেষের কাছে বিশেষ দিন। আজ সকলের অগোচরে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে অনিমেষ। মানব শরীরের বেঁচে থাকার দিনক্ষণ শেষ হয়ে এলেও মানুষ বাঁচার জন্য চেষ্টা করে। অনিমেষের বাঁচার ইচ্ছে নেই। কি হবে বেঁচে থেকে ? জীবন তো একদিন থমকে যাবেই। তা নিয়ে বিচলিত হওয়া ঠিক নয়।আজ অনিমেষ পরিপাটি। সেভ করেছে। স্নান করে সুগন্ধি মেখেছে।
কার্লমাক্সের জীবনী গ্রন্থটি প্রায় দশ মিনিট বুকে জড়িয়ে ধরে সুগন্ধ নিয়েছে। চে গুয়েভারার ছবিতে হাত বুলিয়ে সরিয়ে দিয়েছে ধুলোর আস্তরণ। মলাটের কাগজ খুলে গেছে লালনগীতি বইয়ের। বইটি শেষবারের মতো হাতে তুলে দেখে নিলেন একপলক। তারপর ঝড়ের বেগে পা চালিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পৃথিবীর পথে। রাস্তায় কারও সঙ্গে কথা বললেন না। কারো কথার প্রত্যুত্তর করলেন না। স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনটিতে উঠে পড়লেন উদ্ভ্রান্ত অনিমেষ।
এদিকে রীতিমতো হৈচৈ লেগে গেছে। ছেলেরা এসে দেখছে দরজা খোলা। ভেতরে অনিমেষদা নেই। বাইরেও কোথাও নেই। আলম সাহেব ছেলেদের নিয়ে সারাদিনমান ঘুরাঘুরি করে কোনো হদিস পেলেন না। না খেয়ে, সারাদিন ঘুরে ফিরে ক্লান্ত ছেলেরা অনিমেষের বাড়ি ফিরে এলো। না, অনিমেষ নেই। এখনো ফেরেনি সে। বড়োবাবু সব শুনে বিচলিত হলেন। খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। এমেলে এলেন, এমপি এলেন। মুখ্যমন্ত্রী উদ্বিগ্নতা জানালেন। গঙ্গাজল ঘাঁটি থেকে বাল্যবন্ধু পরিমল এলো।
সংবাদপত্রে নিখোঁজ খবর ছাপা হলো। বাকি থাকলো সিআইডি আর সিবিআই। নিরুদ্দেশ অনিমেষকে সাতদিন, একমাস, বছর কেটে গেলেও কেউ আর খুঁজে পেলো না। ছেলেগুলো মাঝে মাঝে অনিমেষের ঘর খুলে চুপচাপ বসে থাকে। কেউ কোনো কথা বলে না। মাঝে মাঝে ৩ বছরের রঘুনাথ আনিমুচ বলে ডাকে। অনেক্ষন সারা না পেয়ে মায়ের কাছে ফিরে যায়। রঘুনাথের মা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদে। আলম সাহেব বাড়ি ফেরে। হাতমুখ ধোয়। আর দীর্ঘ্যক্ষন অনিমেষের বাড়ির দিকে মুখ করে নীরবে বসে থাকে।
মামুন আলম
ডাবলিন
০১/০৯/২০২১
প্রথম পর্ব