দ্যা জার্নাল ডট আই-ই গত ৪ই মার্চ একটি খবর প্রচারিত হয়েছে। সেখানে দেখলাম অনথিভুক্ত অভিবাসীদের নিয়মিতকরণের প্রকল্পের সর্বশেষ তথ্য জানিয়েছেন জাস্টিস মিনিস্টার হেলেন মেকেন্টি।
তিনি বলেছেন ৩১শে জানুয়ারি ২০২২ থেকে চালু হওয়া এই প্রকল্পের অধীনে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার আবেদন অনলাইনে জমা পড়েছে। যাঁর মধ্যে তাঁর মন্ত্রণালয় যাচাই-বাচাই পূর্বক এখন পর্যন্ত ২৫০ জনকে নিয়মিতকরণ করেছে। একটি মানবিক প্রকল্পের অধীনে ০৫ হাজার আবেদনের বিপরীতে এই সংখ্যা খুবই অল্প নিঃসন্দেহে। কিন্তু এর কারণ বের করা অনেক দূর্ভেদ্য।
কথা হচ্ছে, যেখানে সরকার প্রায় ১৭ হাজার অনথিভুক্ত অভিবাসীদের রাষ্ট্রের মূল কাঠামোতে অর্ন্তভুক্তির মাধ্যমে তাদের সামগ্রিক জীবন ধারায় পরিবর্তনের জন্য বিশেষ এই প্রকল্প চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে জাস্টিস মিনিস্টারের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে ৫ হাজার আবেদনের বিপরীতে মাত্র ২৫০ জনকে নিয়মিত করার খবরটি আমার কাছে মোঠেও আশাব্যঞ্জক মনে হয়নি।
মনে হচ্ছে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এই প্রকল্পের গতি কমিয়ে দিয়েছে অন্য কোনো কারণে।
যাচাই-বাচাই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ আবেদন বাতিল হবার কারণ খুঁজতে গিয়ে একটি অসমর্থিত সূত্র থেকে জানতে পারলাম যে, আবেদনকারীর অনেকে সরকারের দেওয়া শর্তসমূহ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শর্তসূমহ বলতে এখানে প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্রের (নথি) বিষয়টি আমার কাছে মনে হচ্ছে। এই খবরের সত্যতা কতটুকু জানি না, তবে এই ধরণের অভিযোগ উড়িয়ে দেবার মত নয়।
কিন্তু এই ধরণের একটি মানবিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে যৎসামান্য কাগজ-পত্রের জঠিলতার কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আবেদন বাতিল হবে সেটা কতটুকু যৌক্তিক? সাধারণত অনলাইনে যে কোনো আবেদনে কিছুটা জঠিলতা থাকে। আর এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে সমস্যা থাকবেই। অবশ্যি যদি কারো বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি অভিযোগ থাকে তাহলে সেটা ভিন্ন কথা।
এই বিশাল জনগোষ্ঠী এমনি তো রাষ্ট্রে নানা কারণে অবহেলিত। কাজের অনুমতি না থাকার কারণে তাঁরা একটা দীর্ঘ সময় ধরে মানবিকতার জীবন-যাপন করছেন। সংঘতভাবে তাদের সবার কাছে প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র না থাকা খুবই স্বাভাবিক। সংগ্রহ করাও দুস্কর। সরকারের কাছে যেহেতু অনথিভুক্ত অভিবাসীদের একটা পরিসংখ্যান রয়েছে এবং সেখানে নিশ্চয় তাদের এ-দেশে বসবাসের তারিখ সহ প্রয়োজনীয় তথ্য রয়েছে। সরকার চাইলে সেখান থেকে প্রয়োজরীয় তথ্য ব্যবহার করতে পারে। এরফলে অহেতুক শর্তের কেড়াজাল থেকে অনেকের মুক্তির অবসান ঘটবে। সেটি না করে সরকার যদি শর্তসমূহ নিয়ে পড়ে থাকে, তাহলে এই প্রকল্প সত্যিকার অর্থে আলোর মুখ দেখবে কি না , সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
আবার সেই খবরে দেখলাম উক্ত প্রকল্প নিয়ে হেলেন মেকেন্টি খুব আশাবাদী। তিনি মনে করেন,সরকারের গৃহীত এই পদক্ষেপের ফলে
এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বার উম্মুক্ত হবে। এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্টিত হবে। এর জন্য তিনি অনুরোধ করে বলেছেন, যাঁরা এখনো আবেদন করেননি, তাঁরা যেন ৩১শে জুলাই এর ভিতর আবেদন করেন।
হেলেন ম্যাকেন্টি’র বক্তব্য এবং তাঁর কাজের ফলাফলের মধ্যে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে আমার নিকট। ০৩ মাসের ব্যবধানে ০৫ হাজার আবেদনের বিপরীতে ফলাফল যদি ২৫০ হয়, তাহলে অবশিষ্ট ০৩ মাসের আবেদনের ফল কি হবে? সেটা এখান থেকে সহজে অনুমেয়। প্রকল্পের বর্তমান পরিস্হিতি পর্যালোচনা করে আমার কাছে নিচের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন:
১) শর্ত সমূহের জঠিলতার কারণে যে সকল অভিবাসী নিয়মিতকরণের প্রকল্প থেকে বাদ পড়ছেন বা বাদ পড়বেন তাদের নিয়ে সরকারের কি সিদ্ধান্ত হবে পরবর্তীতে।
২) এই প্রকল্পের প্রারম্ভিকে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ি প্রায় ১৭ হাজার অনথিভুক্তদেরকে নিয়মিতকরণের কথা ছিল, এর ফলশ্রুতিতে সরকারের দেওয়া শর্তসমূহ পূরণ না হবার কারণে এই প্রকল্প যদি তাঁর কাঙ্কিত লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে এই প্রকল্পের ভবিষৎ কি হবে?
৩) কোটা পূরণের জন্য আবেদনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পর সরকার নতুন করে কি এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াবে ?
প্রকল্পের মন্থর গতি দেখে আমার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধে দেশচ্যুত ইউক্রেনিয়ান শরণার্থীদের প্রভাব পড়েছে এই প্রকল্পে। আমার এই মতের সাথে অনেকে দ্বিমত করতে পারেন, কিন্তু আমার কাছে সেই ধরণের মনে হচ্ছে। ইউক্রেনের প্রায় ৪০ হাজার শরণার্থী নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইরিশ সরকার।
এরই ধারাবাহিকতায় আয়ারল্যান্ড ইতিমধ্যে কয়েক হাজার ইউক্রেনিয়ান শরণার্থীরা এসে পৌঁছেছেন। এই বিশাল শরণার্থীদের জন্য বাসস্হান সহ তাদের অর্থনৈতিক সহযোগীতার দিকে আইরিশ সরকার এখন সবচেয়ে বেশি মনযোগ দিচ্ছে। তাই এই মূহর্তে অন্য কিছুর চেয়ে ইউক্রেনিয়ানদের মানবিক মর্যাদা রক্ষায় আইরিশ সরকার বদ্ধ পরিকর।
আয়ারল্যান্ডে আবাসিক সমস্য একটি অন্যতম সমস্যা। যদিও এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে, তারপরও এই সংকট থেকে বের হতে পারছে না। এর মধ্যে দেশে নতুন করে এই বিশাল ইউক্রেনিয়ান শরণার্থীদের জন্য আবাসিক বাসস্হানের ব্যবস্হা করা সরকারের সামনে এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। শরণার্থীদের জায়গার সংকলুন না হওয়ায় বিভিন্ন পরিত্যক্ত ভবন রাতারাতি বসবাসযোগ্য করে তুলার উদ্যেগ নিয়েছে সরকার। ইউক্রেনিয়ান নাগরিকদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাদেন পাশে দাঁড়াবার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে আইরিশ সরকার।
আয়ারল্যান্ড সাংবিধানিকভাবে একটি নিরপেক্ষ দেশ ছিল। বিগত দিনগুলোতে দেশটি কোনো ভূ-রাজনৈতিক গ্রুপে ছিল না। বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রিয়ভাবে দেশটি সব সময় নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্তে অঙ্গিকারবদ্ধ ছিল। যার ফলশ্রুতিতে আয়ারল্যান্ড যে কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা ইস্যুতে সব সময় নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছে।
কিন্তু অতি সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডের এই নিরপেক্ষ দৃষ্টির পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে সুস্পষ্টভাবে। ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার আগ্রাসনের পর সাবেক কিছু সামরিক কর্মকর্তারা ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে আইরিশ সরকারের উপর চাপ বাড়াতে থাকেন। আয়ারল্যান্ডকে সামরিকীকরণের বিপক্ষে এবং নিরপেক্ষ থাকার পক্ষে গত ৩০ শে মার্চ সংসদে People before profit দলের সাংসদ রিচার্ড বয়েড ব্যানট কর্তৃক উখাপিত একটি বিলের উপর দীর্ঘ আলোচনা হয়। প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল, এই ধরণের একটি জাতীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পূর্বে দেশের সকল নাগরিকের মতামত নেবার জন্য গণভোটের আয়োজন করা জরুরী।
আলোচিত সেই প্রস্তাবের পক্ষে এবং বিপক্ষে আইরিশ সাংসদরা নিজেদের ভোটদান প্রধান করেন। ৫৩ জন সাংসদ নিরপেক্ষ থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন এবং ৬৭ জন সাংসদ ন্যাটোতে যোগদানের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। অপ্রত্যাশিত ভাবে সেই প্রস্তাব ৫৩- ৬৭ ভোটে হেরে যাবার পর এই বিষয়টি ইতিমধ্যে পরিস্কার হয়ে গেছে যে, ন্যাটোতে যোগদান এখন আয়ারল্যান্ডের সময়ের ব্যাপার মাত্র। গণভোটের প্রয়োজন পড়বে না। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা আয়ারল্যান্ডকে দেখা যাবে অদূর ভবিষ্যত ন্যাটোর পক্ষ হয়ে কোনো দূর্বল ভূ- জনগোষ্টির উপর বোমা মারতে! সবচেয়ে অবাক করার বিষয় ছিল, যে গ্রীন পার্টি সব সময় সামরিকীকরণের বিপক্ষে কথা বলেছে, যাদের অবস্হান ছিল সব সময় বারুতের বিপক্ষে এবং সবুজের পক্ষে। সেই গ্রীন পার্টি সেই দিন সংসদে ন্যাক্কারজনকভাবে
ন্যাটোর সামরিক জোটে যাবার পক্ষে ভোট দিয়েছে।
নিরপেক্ষতা মানে উদাসীনতা নয়। নিরপেক্ষতা মানে যুদ্ধাবাজ ও সাম্রাজ্যবদিীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। নিরপেক্ষতা মানে নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়ানো। নিরপেক্ষতা মানে সবলের বিপক্ষে দাঁড়ানো এবং দূর্বলের পক্ষে অবস্হান নেওয়া। কিন্তুু নিরপেক্ষতার এই নীতি বিশ্বব্যাপী এক নয়। রাষ্ট্রভেদে ভিন্নও হয়। ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের কাছে কিছু রাষ্ট্র তাদের শতবছরের গৌরবময় নীতিও হারায়।
সৈয়দ আতিকুর রব
পোর্টলিস