করোনা মুক্তির পরেও যেসব শারীরিক সমস্যা থেকে যায় ও করণীয়

0
863

করোনাভাইরাসের আক্রান্ত এমন অনেকেই সেরে ওঠার পরও অন্যান্য নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভুগতে দেখা যায়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে তেমন কোন জটিলতা দেখা যায় না। আবার কারও কারও ওপর করোনাভাইরাস দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এইসব জটিলতা কাটিয়ে উঠতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। 

চিকিৎসা বিদ্যার ভাষায় একে বলা হয় ‘পোস্ট কোভিড সিনড্রোম’।

কারণ কি? 

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকে। এই প্রতিরোধ ক্ষমতা এক পর্যায়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে সক্রিয় হয়ে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রদাহের সৃষ্টি করে। যার ফলে নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়।

ভাইরাস যতোটা না ক্ষতি করছে তার চাইতে বড় ধরণের ক্ষতি হতে পারে যদি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাজ করে। যা ফুসফুসসহ শরীরের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গে আঘাত হানে। একে মাল্টি সিস্টেম ডিসঅর্ডার বলে। 

সাধারণত দুর্বলতা ও অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠার মতো সমস্যাগুলো থেকে যায়। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা, অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে ব্যথা, অবসাদ এবং ক্লান্তি ভাব হয়।

রোগীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, লিঙ্গ ও বয়স ভেদে একেকজনের লক্ষণ একেক মাত্রার হতে পারে। তবে আগে থেকেই যারা বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত তাদের বিভিন্ন অঙ্গ ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

ফুসফুস

করোনাভাইরাস সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ফুসফুসে। অনেকে করোনাভাইরাস নেগেটিভ হওয়ার পরও তার কাশি, শ্বাসকষ্ট দীর্ঘদিন ধরে থেকে যেতে পারে। ফুসফুসের এই দুর্বলতার কারণে দেখা যায় রোগীরা অল্পতেই খুব হাঁপিয়ে ওঠেন। ভীষণ দুর্বলতা ও ক্লান্তিবোধ কাজ করে। অনেকের শ্বাসকষ্ট ও কাশির সমস্যা দীর্ঘসময় থেকে যায়।

আবার যারা আগে থেকে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট বা ফুসফুসে প্রদাহজনিত সমস্যায় ভুগছেন তাদের করোনাভাইরাস হলে ফুসফুস দ্রুত আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। আবার যেসব রোগীদের আইসিইউ বা জরুরি অক্সিজেন নিতে হয়েছে তাদের অনেকের ফুসফুসে পালমোনারি ফাইব্রোসিস সমস্যা দেখা দেখা দিতে পারে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিতভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলে এটি ফুসফুসের দেয়ালে প্রদাহের সৃষ্টি করে, ফুসফুসে পানি জমে যায়। যার ফলে রোগীর স্বাভাবিকভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হয়। বুকে চাপ দিয়ে ব্যথা করে। ভারী ভারী লাগে ফাইব্রোসিস একবার হলে সেটা পুরোপুরি ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

হৃদপিণ্ড

কোভিড ১৯ ফুসফুসের রোগ বলা হলেও এটি হৃদপিণ্ডের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে থাকে। অনেকেরই বুকে ব্যথা, বুক ধড়ফড় করা কিংবা হৃদপিণ্ডের প্রদাহজনিত সমস্যা মায়োকার্ডাইটিসে দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে রোগীর রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা থাকায় হার্ট এটাকের ঝুঁকিও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এ কারণে যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন চিকিৎসকরা তাদের ব্লাড থিনার দিয়ে থাকেন যেন রক্ত পাতলা থাকে।

কিডনি

যারা দীর্ঘদিন ধরে কিডনির জটিলতায় ভুগছেন এবং নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয় তারা করোনাভাইরাস থেকে সেরে ওঠার পরও বড় ধরণের ঝুঁকিতে থাকেন।

করোনাভাইরাসের কারণে কিডনিতে সমস্যা না হলেও ডায়ালাইসিস ও হাই পাওয়ারফুল ওষুধ সেবনের কারণে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে রক্তে সোডিয়াম পটাশিয়ামের ভারসাম্যহীনতা বা ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স, এসিড-বেসড ডিসঅর্ডার ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে যা জটিলতা আরও বাড়িয়ে দেয়।

তবে যাদের কিডনি জটিলতা নেই তাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

লিভার

ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হলে লিভার স্বাভাবিক সময়ের চাইতে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর পরিস্থিতি যদি জটিল পর্যায়ে পৌঁছায় যায় তাহলে পরবর্তীতে তাদের জন্ডিস, লিভার ফেইলিওর হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে।

প্যানক্রিয়াস

অনেক রোগী একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস বা অগ্নাশয় জনিত জটিলতায় আক্রান্ত হয়। এর ফলে রোগীদের পেটে তীব্র ব্যথা হয়। যাদের আগে থেকেই হাই প্রেশার, লো প্রেশার, কোলেস্টোরেল বা ডায়বেটিসজনিত সমস্যা আছে তারা কোভিড পরবর্তী সময়েও ঝুঁকিতে থাকেন।

কোভিড ১৯ থেকে সেরে ওঠার পরেও অনেকের ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়, ওজন খুব দ্রুত কমে যায়। ফলে প্রেশার লো হয়ে আসে আবার যারা হাইপার টেনশনে ভোগেন তাদেরও প্রেশার হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যারা ডায়াবেটিসের ভুগছেন তাদের রক্তে চিনি পরিমাণ খুব দ্রুত ওঠা নামা করে।

যেসব রোগীদের অক্সিজেনের মাত্রা ৯০ এর নীচে নেমে যায় তাদেরকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে অক্সিজেন দিতে হয়। পরিস্থিতি জটিল হলে চিকিৎসকরা রোগীকে স্টেরয়েড দিয়ে থাকেন। স্টেরয়েড তাৎক্ষণিক জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখলেও এর ফলে ডায়াবেটিস ও প্রেশার অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে।

মানসিক সমস্যা 

করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার পরও অনেক রোগী দেখা গেছে দীর্ঘদিন ধরে মানসিক উদ্বেগ, বিষণ্ণতায় ভুগেছেন। অনেকেই কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। ছোটখাটো বিষয় ভুলে যাচ্ছেন, ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন। বিশেষ করে যারা দীর্ঘসময় হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন তারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি রোগে আক্রান্ত হন। হসপিটাল বা আইসিইউতে থাকার ভীতিকর স্মৃতি থেকে অনেকে বের হতে পারেন না।

করনীয় কি? 

কোভিড থেকে সেরে ওঠার ৪৮ ঘণ্টা পর, এরপর ১ মাস, ৩ মাস ও ৬ মাস পর চিকিৎসকের পরামর্শে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নেয়া জরুরি। সেইসঙ্গে দিনে রাত পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া বেশ জরুরি।

যারা আগে থেকেই হাইপার টেনশন, হার্টের জটিলতা, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কিডনি জটিলতায় ভুগছেন তাদেরকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেন ডাক্তাররা। চিকিৎসকের পরামর্শে ইনসুলিন বা ওষুধের মাত্রা ঠিক করে নেয়া যেতে পারে।

এছাড়া খাবারের দিকে খুব নজর রাখতে হবে। প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় সুষম খাবার রাখা জরুরি। শাক, সবজি, ডিম,  সেইসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ পানি, ফলের রস খেতে হবে।

কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত থাকার সময় হাসপাতাল বা বাড়িতে দিন রাত বিছানায় শুয়ে বিশ্রামের কারণে পেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। পেশির গঠন ভালো করতে তাই নিয়মিত অল্প অল্প করে ব্যায়াম করতে হবে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে ভিটামিন ডি এবং এই ভিটামিন ডি এর উৎস হল সূর্য। সকাল ৯টা থেকে ১১টা এই সময়ে শরীরের চামড়ায় সরাসরি রোদ লাগানো বেশ প্রয়োজন। ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট থাকলেও সূর্য রশ্মি কাজ করে বেশি। 

এরপরও যদি মানসিক স্বাস্থ্যে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ে তাহলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

সূত্রঃ বিবিসি

Facebook Comments Box