শাহজালালে তিক্ত অভিজ্ঞতা: ইমিগ্রেশন অফিসারদের আরও শিক্ষিত হওয়া চাই
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
আড়াই বছর পর গত ৭ ডিসেম্বর দেশে এলাম। দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে বলে হরহামেশাই বিদেশ থেকে খবর পেতাম। ভাবতাম, দেশের উন্নয়নের সাথে সাথে সম্ভবত মানুষের মননের ও নৈতিকতাও উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু না। দেশে পা রেখেই তা উপলব্ধি করলাম। মানুষের মনমানসিকতা, শিষ্টাচারবোধ ও আচরণিক পরিবর্তন বা উন্নয়ন মোটেও পরিলক্ষিত হয়নি। এয়ারপোর্টে নেমে যখন ইমিগ্রেশন স্পটে এলাম, দেখা গেলো পুরো এলাকার কোথাও শৃঙ্খলার লেস মাত্র নেই। বরাবরের মতো আমরা সরাসরি ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়াতে চাইলে বাধাপ্রাপ্ত হলাম। বলা হলো বাম পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে হেলথ কার্ডে ক্লিয়ালেন্স স্ট্যাম্প নিয়ে ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়াতে। কথা মতো তাই করলাম। লোকাল ট্রেনের মতো কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে চলছিলো তাদের কার্যক্রম। প্রায় এক ঘন্টা পর ইমিগ্রেশন অফিসারের কাউন্টারের ধারেকাছে পৌছাতে সক্ষম হই। আমার সন্তানাদি সহ আমরা চারজন প্যাসেঞ্জার ছিলাম। কাউন্টারের সামনে আমরা চারজনই দাঁড়িয়ে থেকে প্রয়োজনীয় কার্যাদি সম্পন্ন করতে পারবো কি-না জানতে চাইলে ভদ্রলোক বেশ নিরস কন্ঠে “না” সূচক উত্তর দিলেন। অগত্যা তাদেরকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। অভিবাসনিক কাজ শেষ করে পাসপোর্টটি হাতে হাতে না দিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসার আমার দিকে ঢিল ছুঁড়ে দিলেন। এর পর আমার চৌদ্দ বছরের মেয়ে সাইয়েরাহর পালা। তার ক্ষেত্রেও ঠিক একই আচরণ করা হলো। আমার মেয়ে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা, ভদ্রলোক কি বেশ ক্লান্ত? মুখে কোনো হাসির রেখা নেই, গ্রিটিংস নেই। পাসপোর্টটিও ঢিল ছুঁড়ে দিলো। এ কেমন আচরণ? কেমন শিষ্টাচারবোধ?”
আমার মেয়ে কিছুটা বাংলা ও কিছুটা ইংরেজি মিশিয়ে কথাগুলো বললো। তার দিকে তাকিয়ে মনে হলো যেনো চোখে মুখে বিস্ময় স্ফুরিত হচ্ছে। সত্যি তো এ কেমন আচরণ? কেমন শিষ্টাচারবোধ? কিন্তু আমি তাকে তা বুঝতে দেইনি। এমনিতেই তারা দেশে আসতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। তার উপর যদি এসব দুরাচারকে বড়ো করে তুলে ধরি তাহলে তারা আর দেশেই আসতে চাইবে না। তাই বেশ কৌশলী ভঙ্গিতে বললাম, “না মা, ভদ্রলোক সত্যি ক্লান্ত। দেখো না কতো লোকের ভীড়! তাছাড়া তুমি যে দেশটিতে বসবাস করো সে দেশের মতো আমাদের দেশটা এতো উন্নত বা ধনী নয়। ওদেরকে আট ঘন্টার পরিবর্তে বারো চৌদ্দ ঘন্টা কাজ করতে হয়। কাজের চাপ অনেক বেশি। তাই ওদের মন মেজাজ সবসময় এক রকম থাকেনা।” বাবা হয়ে মেয়ের সাথে এভাবে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে তাকে বুঝাবার বা শান্তনা দেবার চেষ্টা করলাম। আমার কথা শুনে মেয়ে শুধু বললো- “still….” ।
সবার কাজ যখন শেষ হলো বিদায় বেলায় আমি ইমিগ্রেশন অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, ” ভাই আপনি কি খুব ক্লান্ত? কোনো কারণে কি আমাদের উপর বেশ রাগান্বিত?” কোনো কথা বললেননা। বললাম, ভালো থাকুন, have a nice evening. এবারও কোনো কার্টিসি দেখালেন না। বললাম, thank you. না এবারও নীরব। ( ভাবটা এরকম যে ব্যাটা তর কাম কইরা দেওনের দরকার কাম কইরা দিছি, এহনও প্যাচাল পারতাছস ক্যান? তাড়াতাড়ি বিদায় ও)। আমি আর কিছুই বললাম না। নেম ব্যজের উপর নজর পড়লো। বড়ো হাতের অক্ষরে লেখা “SHABJI” (সাবজী)। ঐতিহাসিক (?) নামটি নজরস্থ করে দ্রুত প্রস্থান ঘটালাম।
ল্যাগেজ নিতে এসে আরেক সমস্যার সম্মুখীন হলাম। কোথাও ট্রলি নেই। “ট্রলি কোথায় পাওয়া যাবে?” একজন কর্তব্যরত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর প্রান্তের শেষের দিক দেখিয়ে দিলেন। সেখানে গিয়ে দেখি এক তুঘলকি কান্ড। প্রায় দুই আড়াইশ মানুষ গোলাকার হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। বাহির থেকে একটি একটি করে ট্রলি আসছে আর একেকজনকে বিদায় করছে। কারো কারো একের অধিক ট্রলি প্রয়োজন হলেও তাকে একটির বেশি দেয়া হচ্ছেনা। এমনাবস্থা দেখে আমি লাইনে না দাঁড়িয়ে গেটের সামনে যাই। যে লোকটি ট্রলি দিচ্ছে তার কাছে ট্রলির এমন সংকটের কারণ বা হেতু জানতে চাই। তিনি বললেন, যথেষ্ট পরিমাণ ট্রলি নেই। আমাদের ফ্লাইট রাত ১১টায় অবতরণ করলেও তখন বাজে প্রায় ১টা। তারা যেভাবে ট্রলি বিতরণ শুরু করেছে এভাবে চলতে থাকলে ভোর ৪টাতেও বাড়ি পৌছা যাবে কি-না সন্দেহ। তাই তাকে পর্যাপ্ত ট্রলি সরবরাহের অনুরোধ জানালাম। তার কিছুই করার নেই, প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার উপদেশ দান করলেন।
আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোথায় যোগাযোগ করবো! তার লেজ ধরতে পারলেতো! তাই কোনো কথা না বলে মোবাইল দিয়ে ছবি তুলা শুরু করলাম। উপদেশদাতাওয়ালা দৌড়ে এসে ছবি তুলতে নিষেধাজ্ঞা জানালো। আমি বললাম, এখনি ভাইরাল হবে। সাংবাদিকরা আসবে। পত্রিকায় ও টিভিতে নিউজ হবে। এ কথা বলে আমি অদূরে এসে দাঁড়ালাম।
বাস্তবিক পক্ষে আমার মোবাইলে কোনো নেট ছিলোনা। ব্যাটারির চার্জও ছিলো প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাই আমার পক্ষে লাইভে যাওয়া বা কোনো সাংবাদিককে ফোন দেয়া কোনোটাই সম্ভব ছিলোনা। কিন্তু ঝড়ে বক মরার মতো আমার হুমকি কাজে লেগে গেলো। কয়েক মিনিট পরই দেখতে পেলাম, যে গেটে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক ট্রলি বিতরণ করছিলেন ঠিক এর ডান পাশের একটি ষ্টোর থেকে অনেক ট্রলি সরবরাহের চিত্র ভেসে ওঠলো। কাছে গিয়ে দেখি, ষ্টোরটি ভেতর থেকে দোতলা বিশিষ্ট। উপরে অসংখ্য ট্রলি। এক্সসেলেটর জাতীয় লিফ্ট রয়েছে। উপর থেকে ট্রলি গুলোকে এক এক করে লিফ্টে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে আর তা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কার আগে কে ধরবে সে জন্য লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে যে কারো হাত পা ভাংতে পারতো। আহত হতে পারতো। যাহোক, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অর্থাৎ প্রায় সবার হাতেই ট্রলি পৌছে গেলে আমি ও আমার সহযাত্রী বন্ধু জাবেদ দুটো করে ট্রলি সংগ্রহ করতে সক্ষম হই।
আমার প্রশ্ন- কেনো ট্রলি নিয়ে এমন নোংরামি করা হলো? কেনো কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আগন্তুক যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ানো হলো? কেনো দেশে নেমেই প্রবাসী সহ সকল যাত্রীদেরকে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বাদ গ্রহণ করতে হলো?
বিশ্বের কোথাও এক ধাক্কায় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ১০০% বাড়িয়ে দেয়ার নজির নেই। অথচ বাংলাদেশ সরকার তাই করেছে। তবু কেনো ইমিগ্রেশন অফিসারদের মতো সরাসরি চাকরিজীবীরা মুখ গোমড়া করে রাখেন? কেনো তাদের মুখে হাসির ছিটেফোঁটা থাকেনা? কেনো তারা ন্যুনতম কার্টিসি, ম্যানার বা গ্রিটিংসে অভ্যস্ত নন? তবে কি মনে করবো ওদের আরও শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে?
এয়ারপোর্ট হচ্ছে একটি দেশের প্রতিবিম্ব। কোনো বাড়িতে পা রেখে যেমন ওই বাড়ির নাড়িনক্ষত্র জেনে নেয়া যায় তেমনি এয়ারপোর্টে পা রাখতেই গোটা দেশটা সম্পর্কে মানুষের মনে একটা ধারণা জন্ম নেয়। তাই আমরা আশা করবো, অন্তত দেশের মান রক্ষার্থে এয়ারপোর্ট কতৃপক্ষ আলোচ্য বিষয় সমূহের উপর কঠোর নজরদারি সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ঢাকা, বাংলাদেশ
১৩ ডিসেম্বর ২০২১
লেখক: আয়ারল্যান্ড প্রবাসী কবি ও প্রাবন্ধিক