মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবাদির মধ্যে ইদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ অন্যতম। বাংলাদেশে এ মাসের ২৯ তারিখে অর্থাৎ আগামীকাল উৎসবটি পালিত হলেও আমরা যারা মধ্যপ্রাচ্য সহ ইউরোপ বা সমসাময়িক ভৌগলিক দেশ গুলোতে বসবাস করছি তারা একদিন আগেই অর্থাৎ আজ ২৮ তারিখেই দিনটি পালন করছি। এখানে সরকারী ভাবে দিনটি ছুটির আওতায় নেই বলে আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে যারা আছি তারা আগে থেকেই স্বীয় কর্মস্থলের ডিপার্টমেন্ট প্রধানকে বলে ওইদিন অফ ডে বা হলিডের ব্যবস্থা করেছি। যারা একা আছেন তাদের বেলায় একটু ব্যতিক্রম। ঈদ বা কুরবানি নিয়ে খুব বেশি একটা মাতামাতি করতে তাদের দেখা যায়না।
প্রবাসে কোরবানির স্টাইল একটু ভিন্ন রকমের। এখানে দেশের মতো হাটে গিয়ে দশটা পশু দেখে যাচাই বাচাই করে পছন্দমতো কোন গরু বা ছাগল কেনার বিশেষ কোন ব্যবস্থা নেই। আমি যেখানে বসবাস করি অর্থাৎ আয়ারল্যান্ডের কথাই ধরা যাক। এ দেশে অবস্থানরত মুসলিমরা সাধারনত দু তিনটি উপায়ে কোরবানি সম্পন্ন করে থাকেন। প্রথমত যারা ঝামেলা বিহীন ভাবে কোরবানি দিতে চান তারা স্থানীয় মুসলিম গ্রোসারি শপের সহায়তায় কাজটি সেরে ফেলেন। আমি যে এলাকায় আছি সেখানে বাঙালি ছাড়াও রয়েছে আফগানি ও পাকিস্তানি মালিকানা ভিত্তিক দোকান। এসব দোকানে প্রতি নামের জন্য একেকটি ভেড়ার দাম হিসেবে ১৮০ থেকে ২০০ ইউরো ও গরুর জন্য ভাগ প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ ইউরো পর্যন্ত দেয়া হয়ে থাকে। দোকানের মালিক ফার্মে গিয়ে ভেড়া জবাই করে নিয়ে আসবেন যা পরদিন বিলি করা হয়।
যারা একটু সৌখিন বা যাদের হাতে সময় থাকে তারা বিভিন্ন খামার ঘুরে দেখেশুনে একটি গরু কোরবানি দিতে পারেন। তবে ওইসব খামারে গরু কেবল জবাই করা যায় কিন্তু আধুনিক পদ্ধতিতে ছোট করে কাটার কোন সরঞ্জমাদি নেই। ফলে কোরবানিকৃত গরুকে কেবল কয়েক টুকরো করে যে কোন একজনের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে বউবাচ্ছা সহ সবাই অবস্থান করে। ফলে গরু কাটার পাশাপাশি সারাদিন চলে খোশগল্প ও সুস্বাদু খাবারের রসালো আয়োজন। এ পদ্ধতিতে কোরবানি সম্পন্ন করতে বেশ কায়িক পরিশ্রম হয় বটে, তবে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে নিঃসন্দেহে।
কেউ কেউ আছেন যারা শারিরিক পরিশ্রমে রাজি নন। তারা যান ওইসব ফার্মে যেখানে গরু জবাই সহ মাংশ কাটাকাটি ও ভাগাভাগিরও ব্যবস্থা করা যায়। এ পদ্ধতিতে নিজ হাতে মাংশ কাটার আনন্দ থেকে যেমন বঞ্চিত হতে হয় তেমনি খরচও একটু বেশি পড়ে। তবে কোরবানিকে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য মাংশ ভাগাভাগি করার আগেই যে কোন একজনের বাড়িতে কিছু মাংশ পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে অবস্থানরত মহিলারা মিলেমিশে ধুমছে রাবান্না করতে থাকে। যা কিনা উৎসবকে আরও প্রস্ফুটিত করে তোলে।
একটি জিনিস না বললেই নয়। কোরবানির মাংশকে তিন ভাগ করে এক ভাগ গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার যে রেওয়াজ তা বাস্তবায়নের সুযোগ এ দেশে নেই। কারণ মাংশ দেবার বা নেবার মতো কোন গরিব এখানে নেই। তবে পরিচিতদের মাঝে যদি কেউ কোন কারনে কোরবানি দেয়া থেকে বিরত থাকে তাদেরকে ব্যক্তিগত ভাবে কিছু মাংশ দেয়া হয়ে থাকে। ঘুরে ঘুরে মাংশ বিতরনের সময় বা পরিবেশ কোনটাই এখানে নেই। তাই গরিব মানুষের ভাগের মাংশের টাকাটা হিসেব করে দেশে পাঠিয়ে দিয়ে অনেকেই কোরবানিকে সহি করার চেষ্টা করে।
কোরবানির পশুর চামড়া বা এর টাকা বিলিয়ে দেয়ারও কোন সুযোগ এখানে নেই। কারণ চামড়ার কোন টাকাই আমাদের হাতে আসেনা। চামড়া বিষয়ক টাকা নিয়ে খামার মালিককে এ পর্যন্ত কোন প্রশ্নও আমরা করিনি কিংবা তার কাছ থেকেও এ ব্যপারে কোন পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়নি। বস্তুত মুসলিম নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত তেমন কোন খামার আয়ারল্যান্ডে গড়ে না উঠায় এসব ছোটখাট সমস্যা সহ কোরবানি সম্পন্ন করতেও মাঝে মধ্যে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়। এ প্রসঙ্গে বছর কয়েক আগের একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করা যায়।
সম্ভবত ২০১৯ সাল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবারে ইদুল আযহা উদযাপিত হয়েছিল। ছুটির দিন থাকায় শত চেষ্টা করেও ওইদিন কোরবানি দিতে পারিনি। কারণ অফিস আদালতের মতো ওখানকার পশুর খামার গুলোও সাপ্তাহিক ছুটির আওতাধীন। আমরা যারা নিজ হাতে কোরবানির গরু জবাই করতে উৎসাহী ছিলাম তারা খামার মালিককে প্রতি গরু হিসেবে বেশ কিছু উপরি দেয়ার লোভ দেখানোর পরো রবিবারে খামার খুলতে রাজি হয়নি। হেলথ ইন্সপেক্টরের অনুপস্থিতি ও হাইজিন গত বিবিধ সমস্যার কথা বলে আমাদের প্রস্তাবকে নাকোচ করে দেয়। বাংলাদেশের মতো এখানে যত্র তত্র গরু, মেষ, ছাগল এমনকি মুরগি পর্যন্ত জবাই করা যায়না। কিছু দিন আগে আমার এক প্রতিবেশি বন্ধুকেই মুরগি জবাইয়ের খেসারত হিসেবে ১৫০ ইউরো জরিমান দিতে হয়েছিল। অগত্যা কি আর করা! ঈদের সারাটা দিন গোমড়া মুখ করে কাটাতে হয়েছিল। অবশ্যি পরদিন সবাই বউবাচ্চা নিয়ে ৪০/৫০ মাইল দূরের খামারে গিয়ে গরু কোরবানি দিয়ে নিজেরাই মাংশ কেটে ভাগাভাগি করে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ঈদের দিন কোরবানি দিতে না পারা কিংবা দেশীয় স্টাইলে কোরবানির মাংশ না খেতে পারার বেদনা এখনো আমাকে পুড়ায়।
প্রবাসে আমাদের ধর্মীয় উৎসবাদি পালনে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে বটে তবে এ উৎসবকে কেন্দ্র করে কোরবানির পশু বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আচমকা বেড়ে যাবার কোন শঙ্কা নেই। সপ্তাহ খানেক আগে কথা হয়েছিল আমার বড় ভাইয়ের সাথে। তিনি কোরবানির গরু কেনা ও দ্রব্য মুল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বেশ শঙ্কায় আছেন। বস্তুত এ শঙ্কা যে কেবল আমার ভাইয়ের একার তা নয়, দেশের অনেক সাধারন মানুষের। সাধারণত এসব দেশে ধর্মীয় বা যে কোন উৎসবাদির ক্ষেত্রে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেয়া হয়। দোকানপাটে চলে বিশেষ মুল্যহ্রাস। অথচ আমাদের দেশে ঠিক উল্টো, যা খুবই দুঃখজনক।
কোরবানি আমাদের জন্য ত্যগের বার্তা নিয়ে আসে। এ ত্যগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ তথা গোটা বিশ্ব।
ঈদের শুভেচ্ছে সবাইকে। ঈদ মুবারক।
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল, লিমরিক
২৮ জুন ২০২৩