প্রবাসীরাই দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড

বৈদাশিক মুদ্রাই বাংলাদেশের অর্থনীতি চালিকার মূল শক্তি

0
98

বিশ্বের মোট সর্বোচ্চ রেমিটেন্স উপার্জনে সর্বোচ্চ দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক  প্রবৃদ্ধি অর্জন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে যে কয়েকটি নিয়ামক সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তন্মেদ্ধে অন্যতম হচ্ছে বৈদেশিক রেমিটেন্স।

আপনার গ্রাম ও আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন, দেখবেন সব ইট পাথরের দালানে ছেয়ে গিয়েছে। এর ৯০ ভাগ মালিকই দেখবেন দেশের বাহিরে থাকে। প্রবাসের কস্টার্জিত অর্থ দিয়েই বাড়িগুলো তৈরি। এমনকি শহরাঞ্চলে বহুতল ভবন তৈরি তারও বেশীরভাগ ক্রেতা প্রবাসীরা।

বহু মানুষ দেখবেন ২০-২৫ বছর আগে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করতো। আজ তাদের ভাগ্যেও আমূল পরিবর্তন। তার ৯০ ভাগই প্রবাসে কর্মের সুবাধে।

এই ৯০ ভাগ মানুষের যে ভাগ্য উন্নয়ন তার শতভাগই প্রবাসে থাকার ফলশ্রুতিতে। দেশ তাদের ভাগ্য উন্নয়নে এতটুকু অবদান রাখতে পারেনি।

হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে প্রবাসীরা সচল রেখেছে দেশের অর্থনীতি

এই প্রবাসীদের বৈদাশিক আয় কি শুধুই তাদের নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নই ঘটিয়েছে? না, তাদের বৈদাশিক আয় উন্নয়ন ঘটিয়েছে সামগ্রিকভাবে দেশ ও দেশের মানুষেরও।

সে বিষয়েই নিম্নে আলোকপাত করা হল। 

একটা দেশের অর্থনীতি কীভাবে সচল থাকে? ট্রানজেকশন বা বিনিময়ের মাধ্যমেই অর্থনীতি সচল থাকে। যত বেশি বিনিময় তত বেশি অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। তা না হলে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হয়।

ধরুন আপনি আপনার পরিবারকে টাকা পাঠালেন মাসিক খরচের জন্য। আপনার টাকাটা যে মাত্র দেশের কোনো ব্যাংকে জমা হল, তৎক্ষণাৎ দেশের মোট রিজার্ভকেও বর্ধিত করল। তারপর আপনার পরিবার সে টাকায় চাল, ডাল, লবণ, মাছ, প্রসাধন, ঔষধ ইত্যাদি কিনলো। তার মানে টাকাটা বাজারে চলতে শুরু করলো। ধরুন আপনি A কোম্পানির সাবান ও B কোম্পানির ঔষধ কিনলেন। তাহলে আপনি সে কোম্পানির প্রোফিট বা লাভে ভূমিকা রাখলেন। কোম্পানিগুলো তা দিয়ে কাঁচামাল কিনবে, কর্মচারীর বেতন দিবে এবং সরকারকে লাভের উপর ট্যাক্সও দিবে। তাহলে দেখেন আপনি আরো অনেকের উপার্জনে ভূমিকা রাখতেছেন ও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতেছেন। আপনি যে পণ্য ও সেবা নিচ্ছেন তার উপর আপনি ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স বা ভ্যাটও দিচ্ছেন, যা সরাসরি রাষ্ট্রীয় আয়ে যোগ হচ্ছে।

তাহলে চিন্তা করে দেখুন আপনার প্রেরিত অর্থের রাষ্ট্রের জন্য কি অপরিসীম অবদান রাখতেছে। বিপরীতভাবে যদি চিন্তা করেন, আপনার সে টাকাটা বিদেশ থেকে আসলো না। তাহলে ঠিক উল্টোটা ঘটবে।

বৈদাশিক মুদ্রা দেশে যাচ্ছে। সে টাকা থাকাতে খরচ করতে পারতেছেন। সে টাকা খরচ হয় বলে আরেকজনের ব্যবসা চলতেছে, আরেকজনের ব্যবসা চলতেছে বিধায় অনেকের কর্মসংস্থান হচ্ছে, কর্মসংস্থান হচ্ছে বলে তাদের পরিবার চলতেছে, তাদের খরচ আবার অর্থনীতিতে সার্কুলেট হচ্ছে। এভাবে একটি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে।

আমাদের দেশের জনসংখ্যা অধিক বলে ট্রান্সেকশন বা বিনিময়ও অধিক। অধিক ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে এবং তা অর্থনীতির চাকাকে বহুগুণ বাড়াতে সক্ষম। জনসংখ্যা আমাদের জন্য অভিশাপ নয়, বরঞ্চ আশীর্বাদও বটে।

বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে রেমিটেন্স আসে। যেমন ব্যবসায়ে রপ্তানি অন্যতম। কিন্তু প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের তুল্য তা নয়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে যা রপ্তানি হয়, তার কাঁচামাল আমদানিতে রেমিটেন্স দেশ থেকে বেরও হয়ে যায়, সুতরাং ব্যবসায়ে আমদানিকৃত রেমিটেন্স খুব ফায়দা বহন করে না। কিন্তু প্রবাসীদের রেমিটেন্সের বিনিময়ে কিছুই দেশ থেকে বের হচ্ছে না। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের সম্পূর্ণটাই দেশের কাজে লাগে। বরঞ্চ আমদানি বাবদ অনেক দেনা প্রবাসীদের রেমিটেন্স থেকেই শোধ করা হয়।

বিশ্বের বহু দেশ আছে যাদের দেশের বাহিরে থেকে আমাদের মতো রেমিটেন্স আসে না বললেই চলে। সুতরাং ঐসব দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ আয় (টাক্স/ভ্যাট) ইত্যাদি দিয়ে বাৎসরিক বাজেট পূরণ করে। তারপরেও তারা উন্নত রাষ্ট্রের একটি। আমি যেদেশে থাকি, আয়ারল্যান্ড তার অন্যতম উদাহরণ।

এছাড়াও সরকার যদি অন্য দেশ থেকে লোণ বা ঋণ প্রত্যাশা করে তাহলে যদি বৈদাশিক মুদ্রার ফ্লো যদি ভালো থাকে তাহলে অন্য দেশ ঋণ দিতেও কার্পণ্য করে না। কারণ তারা জানে দেশের প্রচুর রেমিটেন্স আমদানি হয়, সুতরাং সে ঋণ পরিশোধ করে দিতে পারবে। বৈদাশিক মুদ্রার ফ্লো কমে গেলে অন্য দেশও লোণ দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে, যদি দেয়ও তাহলে ছড়া সুদ অথবা কঠিন শর্ত মানতে হতে পারে।

দেখুন একজন পিওন, ড্রাইভার বা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন আহামরি বেশি নয়। কিন্তু দুর্নীতির আশীর্বাদে তাদেরকে ধরলে ১-২ কোটি নয় কয়েকশ কোটি টাকার নিচে পাওয়া যায় না। তাহলে রাগব বোয়ালদের কথা চিন্তা করুন। একথা একারণেই বলা যে, দেশে সীমা ছাড়া দুর্নীতির পরেও একটি দেশ কীভাবে টিকে আছে?

বাংলাদেশ টিকে আছে কারণ, বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনেক এবং বহু বাংলাদেশি প্রবাসে আছে এবং প্রচুর পরিমাণ বৈদাশিক মুদ্রা বাংলাদেশে প্রেরিত হয়। এই প্রেরিত অর্থই বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকার মূল শক্তি।

যে পরিমাণ বৈদাশিক মুদ্রা বাংলাদেশে আসে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বরত ব্যক্তিবর্গ একটু বিচক্ষণ হলেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল নয়, উন্নত রাষ্ট্রই থাকতো। মালেয়শিয়া সিঙ্গাপুর হওয়ার স্বপ্ন নয়, ঐসব দেশগুলো থেকে আরো ভালো অবস্থায় থাকা সম্ভব হতো।

দেশে প্রতিনিয়ত প্রচুর অর্থ বিনিময় ছাড়াই ঢুকতেছে। দেশে অর্থ আছে বলেই দুর্নীতিবাজরা হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করে বিদেশে পাচার করতেছে। অর্থ আছে বলেই আছে ক্ষমতার কামড়া কামড়ি। অর্থ আছে বলেই জনগণকে উপহাস করা নেতাদের বেতন ভাতা জোটে।

প্রবাসীরা আছে বলেই আজ দেশের রক্তনালী প্রবাহিত। প্রবাসীরাই দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড।

ওমর এফ নিউটন
বার্তা সম্পাদক
আইরিশ বাংলা টাইমস

Facebook Comments Box