একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। কিছুদিন আগে বিশ্বের প্রভাবশালী ও উন্নত একটি রাষ্ট্র ইউকে’র ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। দীর্ঘ ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে কন্সার্ভেটিভ পার্টি লেবার পার্টির কাছে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়। ১৪ বছর কন্সার্ভেটিভ পার্টি গণতান্ত্রিকভাবেই ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ক্ষমতার পরিবর্তনে না ঘটেছে কোনো মৃত্যু, না করেছে কেউ কারো ক্ষয়ক্ষতি, না করেছে কোনো নেতা পলায়ন। ক্ষমতায় এসে লেবার পার্টির প্রধান ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীকে এবং বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জনগণের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে এবং নতুন প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিয়েছেন।
একটি দেশ যদি ভালো থাকে, দেশে যদি সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা থাকে, তাহলে দেশের মানুষ দল মত নির্বিশেষে সবাই কীভাবে ভালো থাকা সম্ভব তারই ব্যাখ্যা দিয়ে এই লেখাটি।
প্রথম পর্ব – সুস্থ রাজনীতি
ক্ষমতাসীন দল মনে করে ক্ষমতা ছাড়ার পর তাদের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। কারো কারো দেশছাড়া হতে হতে পারে, কেউ চাকুরীচ্যুত হতে হবে, কারো ব্যবসায় সমস্যা হতে পারে, কারো আবার প্রতিপক্ষের হাতে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণনাশেরও শংকা থাকে। সেজন্য ক্ষমতা যে কোনো মূল্যে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে।
যারা আবার বিরোধী দলে আছে। তারা মনে করে, কোনরকম ক্ষমতাটা বাগিয়ে নিতে পারলেই হয়। সব সুদে আসলে উসুল করে নেবে। ক্ষমতা হাতে পেয়ে দীর্ঘদিনের প্রতিশোধ পরায়ণ মন প্রতিশোধচিত্তে মত্ত হবে, ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মত সব গ্রাস করতে আগ্রাসী হবে। ক্ষমতাই যেহেতু তাকে সবকিছু করতে বা পেতে সহায়তা করবে, সুতরাং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার সবরকম ফন্দি ফিকির খুঁজে বের করবে।
কিন্তু এমন ধারাবাহিক পরিক্রমায় দেশ যাচ্ছে রসাতলে, দেশের মানুষ পড়ে থাকে ভোগান্তির মধ্যে এবং মানুষে মানুষে বিভাজন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে।
ক্ষমতাসীন দল ও দলের অনুসারীরা ভোগ করে সব সুযোগ সুবিধা, বিরোধীরা থাকে নিগৃহীত, নিপীড়িত। আবার ক্ষমতার পরিবর্তনে দৃশ্যপট যায় বদলে। মাঝখানে সাধারণ জনগণ, যারা এ পক্ষেও নেই ঐ পক্ষেও নেই তারা সর্বকালেই থাকে নিগৃহীত নিপীড়িত।
কিন্তু এমন করে কেন চলবে? সাধারণ জনগণই হোক, বিরোধী দল হোক, কিংবা সরকারী দল হোক; সবাই একই দেশের নাগরিক। দেশের সবার সবকিছুতে সমান অধিকার আছে। ক্ষমতার ছায়াতলে কেউ কেউ সব সুবিধা পাবে, কিন্তু ঐ ছায়ার বেষ্টনীর বাহিরে সবাই থাকবে উপেক্ষিত; তা কেন হবে?
সুস্থ রাজনীতির চর্চা থাকলে উপরোক্ত বিষয়গুলো খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব। ক্ষমতা অর্জন যদি ব্যক্তি স্বার্থ না চিন্তা করে দেশের স্বার্থের জন্য হয় তাহলে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে ও ক্ষমতায় যেতে কেউ অতিমাত্রায় আগ্রাসী হবে না।
দ্বিতীয় পর্ব – আইন
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন সবার ঊর্ধ্বে। আইন সবার ঊর্ধ্বে মানে আইনের প্রহরায় সবাই সমভাবে বিদ্যমান। আইনের চোখে রাজা প্রজার মাঝে তপাৎ নেই, ধনী গরীবের মাঝে তপাৎ নেই, এমনকি নেই ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীনের মাঝে তপাৎ। যদি ধনী কোন গরীবের সাথে অন্যায় করে তাহলে আইন তার বিচার করবে, যদি রাজা প্রজার প্রতি জুলুম করে আইন দেখবে, যদি ক্ষমতাসীন তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাও আইন তার বিচার করবে।
এখন আইন যদি হয় পক্ষপাতদুষ্ট তাহলে মানুষ প্রকৃতপক্ষেই অসহায়। আর আইন যদি হয় ক্ষমতাশালীদের অধিনস্ত তাহলে তা হয় বিপদজনক। যার ক্ষমতা নেই এবং আইনও তার সহায়ক নয়, তাহলে তাকে সর্বদা আত্মসমর্পিতভাবেই থাকতে হয়, সে অন্যায় করলেও এবং না করলেও।
এখন পূর্বের কথায় আসা যাক। আইন যদি নিরপেক্ষ হয় তাহলে একটা দল ক্ষমতা হারালেও তার ভয়ের কোন কারণই থাকার কথা নয়, কারণ আইন তাকে সুরক্ষা দিবে। আর ক্ষমতায় থাকাবস্থায় কেউ বা কোন দল যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে তাকে বা সেই দলকে ক্ষমতা ছাড়া পর্যন্ত আইন আর অপেক্ষা করবে না। আইন যদি স্বতন্ত্রই হয় তাহলে ক্ষমতাসীন হোক আর ক্ষমতাহীন হোক, আইন তাকে তার কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই।
তাহলে ক্ষমতায় থাকলেই যে, কেউ অন্যায় করে পার পেয়ে যেতে পারবে না। একমাত্র আইনের নিরপেক্ষতাই পারে বহু সমস্যার সমাধান করে দিতে।
তৃতীয় পর্ব – জনগণই ক্ষমতার মালিক
গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হচ্ছে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং মালিক। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কে ক্ষমতায় থাকবে, আর কে থাকবে না। জনগণই কাউকে ক্ষমতায় বসাবে, কাউকে নামাবে, জনগণই ক্ষমতার পরিবর্তন আনবে। যেহেতু জনগণের হাতেই ক্ষমতার চাবিকাঠি, সেহেতু সব দলই জনগণকে খুশি রাখার চেষ্টা করবে। কিন্তু ভুলক্রমে কেউ যদি মনে করে, না জনগণ নয়, আমরাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তাহলে জনগণকে খুশি রাখা না রাখা নিয়ে তাদের কিছু যায় আসে না। তাহলে জনগণের সে নেতা বা দল জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করবে এবং অনৈতিক কাজ সম্পাদন করতে সচেষ্ট হবে।
ক্ষমতার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা কেন অনস্বীকার্য? কারণ, যখন ভিন্ন দল ক্ষমতায় আসবে, তখন পূর্ববর্তী সরকারে যারা দায়িত্বে ছিল তাদের অন্যায়, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়গুলো দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। একটা দল যখন জানতে পারবে ৫ বছর পর তারা ক্ষমতায় থাকবে কি থাকবেনা এবং অন্য দল ক্ষমতায় আসলে তাদের কুকীর্তিগুলা প্রাকাশ্যে চলে আসার সম্ভাবনা থাকবে, সেজন্য কিছুটা হলেও অন্যায় কর্ম ও দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে সচেষ্ট হবে। সেক্ষেত্রে দুর্নীতির লাগাম কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
কিন্তু কেউ যদি মনে করে তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী, তাহলে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনে এমন কেউ আর থাকবেনা, সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের কুকর্ম করার পরিমাণ প্রবল থাকে।
ফলাফল
উপরের তিন পর্বের সারমর্ম হল ক্ষমতায় থাকলে সব মধু ভোগ করবে এবং না থাকলে কিছুই না। যার জন্য যে কোনো মূল্যে সবাই ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে ও ক্ষমতা লাভ করতে মরিয়া থাকে।
এখন যদি ধরেন যদি আইন সঠিক ও ন্যায্যভাবে কাজ করে, সরকার জনগণেকে গুরুত্ব দিয়ে ক্ষমতা পরিচালনা করে ও ক্ষমতায় থেকে বিরোধীদেরকে যাথাযথ সন্মান ও গুরুত্ব দিয়ে ক্ষমতাসীনরা চলে তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
যেমন ধরুন আইন যদি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন থাকে তাহলে কেউ’ই বেআইনিভাবে কিছু করার সাহস পাবে না, বরং করলেও আইন তার বিচার করবে। এতে ক্ষমতা ব্যবহার করে কেউ দুর্নীতি, অন্যায় কাজ করতে সাহস পাবে না ও অন্যকে বিনা বিচারে শাস্থি দিতে পারবে না।
জনগণকে গুরুত্ব দিয়ে দেশ পরিচালনা করলে, দেশের মঙ্গল হয় এমনভাবেই রাষ্ট্রচালকরা দেশ পরিচালনা করবেন, যাতে করে জনগণ খুশি থাকে। আর জনগণ খুশি থাকলে পরবর্তী নির্বাচনে আবার জয়ী হয়ে আসার সম্ভাবনা থাকবে। এতে দেশের সুখ ও সমৃদ্ধি বর্ধনে সহায়ক হবে। বর্তমান রাষ্ট্রচালকরা জনগনের থেকে ব্যক্তি স্বার্থটা বেশি চিন্তা করেন বিধায় দেশে আশানুরূপ সুখ ও সমৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ক্ষমতায় থাকাবস্থায় বিরোধীদেরকে যথাযথ সন্মান ও মর্যাদা দিয়ে চললে ক্ষমতা হারালেও বিরোধীরা যখন ক্ষমতাসীন হবে তখন একই কাজটা করতে অনুপ্রাণিত হবে। সুতরাং ক্ষমতা হারানোর যে ভয় তা অনেকাংশেই লাঘব হবে।
দেশ ভালো থাকলে ভালো থাকবে সবাই
উপরোক্ত বিষয়গুলা যদি অনুসরণ করে চলা যায় তাহলে দেশ এমনিতেই উন্নত হবে সর্বদিক দিয়ে। যেমন হয়েছে আজকের উন্নত দেশগুলো। তাহলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকবে, চাকুরীর বাজার বৃদ্ধি পাবে, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে ভালো থাকলে বেকার, প্রতিবন্ধী, অসুস্থরা সরকারী সহায়তা পাবে।
তাহলে কেউই রাজনীতির উপর নির্ভর করে থাকতে হবে না। রাজনৈতিক অবলম্বন করে চাকুরী নেয়া, ব্যবসা করা ও কোনো কাজ করিয়ে নেয়ারও দরকার পড়বে না। এখন সবাই রাজনীতির অবলম্বন করে থাকতে চায় কারণ এর মাধ্যমে তার কিছু রুটি রুজির জোগাড় হয়। কিন্তু দেশ ভালো থাকলে রুটি রুজির জোগাড় এমনিতেই হয়ে যাবে কোনো রাজনৈতিক অবলম্বন ছাড়াই।
দেশ যদি ভালো থাকে তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সবাই ভালো থাকবে।
ওমর এফ নিউটন
বার্তা সম্পাদক
আইরিশ বাংলা টাইমস