দাবানল কি?
রক্তাভ আগুনের লেলিহান শিখা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তীব্র বেগে ছড়িয়ে পড়ে বন বনাঞ্চলে। পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় যা কিছু পড়ে সম্মুখে। পাতা থেকে পাতায়, বৃক্ষ থেকে বৃক্ষে, বনাঞ্চল থেকে বনাঞ্চলে হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হতে থাকে আগুনের লেলিহান জিহ্বা প্রসারিত করে। পশুপাখি, মানুষ, বাসস্থান যা কিছু আগুনের রুদ্রমূর্তির সামনে পড়ে সবই হয় ভস্মীভূত। আগুনের এই অগ্নিমূর্তিই হচ্ছে দাবানল, যেথায় আগুনের চোখে থাকে আগুন। যেখানে আগুন নিজেই খেলে।
সাধারণত বন বনাঞ্চল ও গভীর জঙ্গলে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডকেই দাবানল বলে থাকে। এ ধরণের অগ্নিকান্ড বহুলাংশে অনিয়ন্ত্রিতই থাকে। দাবানলের তীব্রতা এতোই তীব্র থাকে যে, একে নিয়ন্ত্রণ কিংবা নেভানো অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও বেশীরভাগক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব।
দাবানল যখন ছড়ায়, তা দ্রুতবেগে ছড়ায়। দাবানলের আগুনের তাপদাহ এতোই তীব্র থাকে যে বহুদূর থেকেও প্রচণ্ড তাপ অনুভূত হয়, যার ফলে এর নিকটবর্তী হওয়াও সম্ভব হয় না।
দাবানলের আগুন ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার বেগে চলতে সক্ষম। এমনকি নদীর উপর দিয়েও দাবানল ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। দাবানলের আগুন থেকে অগ্নিঝড়, টর্নেডো তৈরি হতে পারে এবং ছাই ৩ হাজার মাইল দূর পর্যন্ত চলে যেতে পারে। দাবানলে পোড়া সাইবেরিয়ার তাইগা বনের ধোঁয়া ৩ হাজার মাইল দূরে জাপানের ওসাকা শহরকে অন্ধকার করে দিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার ব্ল্যাক ফ্রাইডে বুশ-ফায়ারের ছাই উড়ে গিয়ে পড়েছে ২ হাজার মাইল দূরের নিউজিল্যান্ডে।
দীর্ঘদিনের ক্ষুধার্তের মতোই দাবানলের আগুন। পশুপাখি, গাছপালা এমনকি মাটিতে অবস্থিত ছত্রাক সবই হচ্ছে আগুনের খাবার। যে পর্যন্ত না পুড়তে পুড়তে সব নিঃশেষ না হয়ে যায়, সে পর্যন্তই জ্বলতে থাকে আগুন।
দাবানলের উৎপত্তি হয় কীভাবে?
দাবানল সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে উৎপত্তি হয়ে প্রাকৃতিকভাবেই বিস্তৃতি লাভ করে। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে দাবানলের আবির্ভাব হয় বেশি। অতিরিক্ত খরার ফলে বনাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চলে পানি বাষ্পীভূত হয়ে তৈরি হয় পানির ঘাটতি। বাতাসে বিদ্যমান জলীয় বাষ্প শোষণ করে পূরণ করা হয় কিছু ঘাটতি। কিন্তু ক্রমাগত খরার ফলে মাটি ও বাতাস আদ্রতার পরিমাণ এতোই কমে আসে যে, বৃক্ষতরু সে সমতা রক্ষা না করতে পেরে অতিমাত্রায় দাহ্য হয়ে ওঠে।
দাহ্য অবস্থায় পাতায় পাতায় অথবা বৃক্ষে বৃক্ষে ঘর্ষণের ফলে আগুনের সৃষ্টি করে। আর আগুন একবার জ্বলে গেলে আর বনাঞ্চলে থাকি প্রচুর অক্সিজেন; এ দুইয়ের মিলিত প্রভাবে আগুন জ্বলে উঠে দাউ দাউ করে এবং মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে যায় দিগ্বিদিক।
আর শুষ্ক দাহ্য অঞ্চলে একবার আগুন ছড়িয়ে পড়লে আগুনের লেলিহান শিখা তার হাত যতদূর বাড়াতে সক্ষম ততদূর ছড়িয়ে পড়ে।
দাবানলের সাথে যদি বাতাস এসে যোগ দেয় তাহলে তো আগুনের পোয়াবারো। বাতাসের সহায়তায় আগুন লাভ করে দ্বিগুণ শক্তি। উঁচু গাছের ক্যানপির আগুন অনায়াসে ছড়াতে পারে, উষ্ণ তাপক-শিখা ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে থাকে আর পোড়াতে থাকে ক্রমাগত।
এছাড়া প্রাকৃতিকভাবে দাবানল সৃষ্টির আরেকটি অন্যতম কারণ বজ্রপাত। বজ্রপাতের ফলে বিভিন্ন স্থানে শুরুতে ছোট ছোট দাবানলের সৃষ্টি হয় এবং পরে তা বায়ুর ইন্ধনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
অনেকক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবেও আগুন লাগতে পারে। যেমন কেউ ইচ্ছে করে লাগানো, ক্যাম্পফায়ারের আগুন বা সিগারেটের আগুন অথবা অসতর্কতাবশত আগুন লাগতে পারে। কিন্তু আগুন যেভাবেই লাগুক, কিন্তু বনাঞ্চলের আগুন ছড়ানোর জন্য দরকার হয় শুষ্ক ও দাহ্য পরিবেশ।
দাবানলের আধিক্য কোথায় বেশি?
সাধারণত বনাঞ্চল সমৃদ্ধ অঞ্চলেই দাবানলের আধিক্য দেখা যায় বেশি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বনাঞ্চল আমাজনে দাবানল নিত্য নৈমত্তিক ব্যপার। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চল আফ্রিকার সাহারা মরু অঞ্চল, আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে দাবানলের আধিক্য রয়েছে। আমেরিকার বনাঞ্চলে বিভিন্ন উপায়ে আগুন লাগে বছরে প্রায় এক লক্ষ বার। যে কারণে পুড়ে যায় ২০ লক্ষ হেক্টর জমি।
প্রাকৃতিক দাবানলের পাশাপাশি অনেক কৃত্রিম দাবানলেরও সৃষ্টি করা হয়। গত তিরিশ বছরে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অরণ্য, আফ্রিকার কঙ্গো এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মিলিয়ন মিলিয়ন একর এলাকার বৃক্ষ ধ্বংস করা হয় কৃত্রিম অগ্নিকান্ড ঘটিয়ে। বনাঞ্চল ধ্বংস করে জায়গা অধিগ্রহণ, ফসল চাষাবাদের জমি বের করা ও মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে এসব অগ্নিকান্ড ঘটানো হয়।
বাংলাদেশের বনাঞ্চলে বড় গাছের ঘনত্ব কম থাকায় প্রাকৃতিক দাবানল ঠিক তেমন একটা হয় না। তারপরেও কিছু অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে, যার বেশিরভাগই মনুষ্যসৃষ্টি। তবে ভারতের বনাঞ্চলের কিছু অংশ দাবানল তৈরি করে গাছের ঘনত্ব ও শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে।
শেষ কথা
প্রাকৃতিক সৃষ্ট দাবানলের উপর হয়তো কারো হাত নেই, কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট দাবানলের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। দাবানলে ক্ষতি সাধিত হয় মানুষের এবং অসহায় পশুপাখির।
রাজা নীরোর আমলে রোমের ৭০% ই পুড়ে খাক হয়েছিল, সেসময় নীরো বাঁশি বাজাচ্ছিল। কথিত আছে নীরো নিজেই আগুন লাগিয়েছিল।
নিজে আগুন লাগাই বা না লাগাই, আমরা যেনো নীরো না হয়ে যাই। প্রয়োজনে এগিয়ে যাই।
ওমর এফ নিউটন
বার্তা সম্পাদক
আইরিশ বাংলা টাইমস