এইতো দুদিন আগের খবর, আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হঠাৎ ঘোষণা দিলেন তিনি আগামী নির্বাচনে লড়বেন না। অথচ তিনি নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেছিলেন। তিনি কারণ হিসেবে জানান, ”আমি আমার দল ও দেশের ভালোর কথা চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি’’।
আরেকটু পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধি ব্রিটিশদেরকে ভারতবর্ষ ত্যাগে বাধ্য করানোর জন্য অন্যতম একজন নেতা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষ ত্যাগ করে তখন মহাত্মা গান্ধিই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যেনি চাইলেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারতেন। তিনি তা না করে তা জহুরলাল নেহেরুর হাতে পদার্পণ করেন।
আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন মেন্ডেলা, যিনি আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ও গন্তান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। দীর্ঘ ২৭ বছর কারাভোগের পর ১৯৯০ সালে কারামুক্তির পর ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। ১৯৯৯ সালে তার প্রথম টার্ম শেষ হওয়ার পর চাইলেই তিনি ২য় টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকতে পারতেন, কারণ সবাই তাঁকে পছন্দ করতো। কিন্তু তিনি তা না করে প্রথম টার্ম শেষেই অবসর নেন।
মহাত্মা গান্ধি ও নেলসন মেন্ডেলা উভয়ই ছিলেন যথেষ্ট জনপ্রিয় ও সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। গান্ধি চাইলেই প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন, কিংবা মেন্ডেলা চাইলেই আরেক টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তা করেন নি, মনে করেছেন অন্যরা ভালো করবেন ও সুযোগ দিয়ে দিয়েছেন। যার ফলে দুজনকেই দলমত নির্বিশেষে সবাই পছন্দ করে ও আজও শ্রদ্ধা জানিয়ে আসতেছে।
আরো উদাহরণ যদি দেই। ২০০৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং। সে সময় কংগ্রেসের সভানেত্রী ছিলেন সোনিয়া গান্ধি। স্বাভাবিকভাবেই সোনিয়া গান্ধিই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিবেন এমনই সবার ধারণা ছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে নিজে প্রধানমন্ত্রী না হয়ে করলেন মনমোহন সিং কে। তিনি মনে করেছেন মনমোহন সিংই প্রধানমন্ত্রী হবার যোগ্য।
চাইলেই যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন, এমন সুবর্ণ সুযোগ অন্যকে হস্তান্তর করে এক অনন্য নজীর স্থাপন করেন সোনিয়া গান্ধি।
২০১৬ থেকে ২০২৪, এ ৮ বছরে UK তে ৬ বার ৬ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ব্রেক্সিটের কারণে ২০১৬ সালে ডেভিড ক্যামেরুন পদত্যাগ করেন। ব্রেক্সিটে তিনি জিতেছেন, কিন্তু চাইলেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহাল থাকতে পারতেন। এরপর আসেন টেরেসা মে, প্রায় প্রায় তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর UK-EU ব্রেক্সিট ডিল-এর ইস্যুতে তিনিও পদত্যাগ করেন। এরপর বরিস জনসন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং পার্লামেন্টারি সদস্যদের চাপে অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন দেন এবং বিপুল আসনে জয়লাভ করলেও, শুধুমাত্র করোনার সময় বাড়িতে পার্টি দেবার কারণে সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেন। এরপর বরিসের ক্ষণস্থায়ী রিপ্লেসমেন্ট এলিজাবেথ ট্রুস এবং এর পরে বিগত নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ঋষি সুনাক থাকেন প্রধানমন্ত্রী। ইনফ্লেশন, মাইগ্রেশনসহ কিছু ইস্যু নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে ঋষি সুনাক অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন দেন মেয়াদ উত্তিন্নের আগেই। এরপর নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন কিয়ের স্টারমার।
এইতো কিছুদিন আগেই আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাদকারও পদত্যাগ করেছিলেন। পদত্যাগ করার আগে তিনি বলেন নতুন প্রধানমন্ত্রী তাঁর থেকে অধিক ভালভাবে দেশ চালনা করতে পারবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন। জাস্ট এটাই। মনে করেন অন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর থেকে ভালো হবেন।
দেখুন, উপরে ইংল্যান্ড আয়ারল্যান্ড মিলিয়ে যে কয়জন পদত্যাগ করেছেন ও অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন দিয়েছন এবং জো বাইডেন আগামী নির্বাচন যে করবেন না, তার কারণগুলা খুবই নগণ্য। এসব কারণে তাঁরা পদত্যাগ করতে, কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন দিতে বাধ্য ছিলেন না। মনে করতে পারতেন ধুর একটু সমালোচনা হলে হইছে আরকি। মানুষ কিছু বিষয়ে অখুশি থাকলেই বা কি!
আমাদের চোখে মনে হবে এরা বোকার হর্দ। কেউ কী এভাবে ক্ষমতার রসের হাড়ি নিজ হাতে জলাঞ্জলি দেয়? কিন্তু তাঁরাই রিয়েল লিডার। তাঁরা মানুষের চাওয়াকে গুরুত্ব সহকারে দেখেন, জনগণের পালস বুঝেন, নিজের সদস্যদের চাওয়ার প্রতি সন্মান প্রদর্শন করেন। নিজের যোগ্যতা ও সক্ষমতাকেও পর্যালোচনা করে চলেন; যদি দেখেন অন্য কেউ তাঁর থেকে বেশী যোগ্য তাঁকে জায়গা ছেড়ে দেন, বয়স বেশী মনে হলে অবসরে যান।
তাঁদের কাছে দেশ এবং জনগণই মুখ্য। তাঁকেই নেতা হয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে হবে এমন তাঁরা নন। তাঁরা যদি মনে করেন তাঁর দ্বারা দেশের যথোপযুক্ত কল্যাণ সাধিত হচ্ছেনা, কিংবা দেশের মানুষ তাঁর উপর অসন্তুষ্ট, অথবা তাঁর থেকে অন্য কেউ যোগ্য তাহলে দেশের প্রয়োজনে নিজ হতে সে পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ক্ষমতা তো আদতে দেশের কল্যাণেই। কারণ সে দেশের কর্মচারী হয়ে সে শপথই তো নিচ্ছেন তাঁরা।
আর আমাদের দেশে দেখুন। বিগত কিছুদিন যা হচ্ছে, একটা দেশের আর কত মানুষ চাইলে অথবা কত মানুষ মরলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নিমিত্তে রাস্ট্রপ্রদানের পদত্যাগ করার জন্য যথেষ্ট হবে? উপরের উদাহরণের চেয়ে আর কত বেশী উদাহরণ দরকার আছে বোঝার জন্য? রাষ্ট্রপ্রধান তো নয়ই, একজন দায়িত্বরত একজন খুব ছোট পদের ব্যক্তিকেও তো পদত্যাগ করতে দেখিনি।
কবে যে আমাদের রাজনীতিবিদের ক্ষমতায় আরোহণের পাশাপাশি ক্ষমতাকে উৎসর্গ করারও মানসিকতা জন্মাবে?
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের খাতিরে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও তো প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যেতো? তাহলে হয়তো এতো রক্তপাত হতো না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে আবার তা নিয়ে নেয়া যেতো। একজন মন্ত্রী কিংবা একজন আমলা শ্রেণির কেউও পদত্যাগ করে বা বহিষ্কার করে দেখানো যেতো যে তারা যে কিছু একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু না, ক্ষমতা থাকতেই হবে যে কোনো মূল্যে। ১০০ কেন, ১০০ হাজার মানুষেরও যদি মৃত্যু ঘটে।
অনেক দেশে এমনো দেখেছি মাত্র ৫০-১০০ জনের আন্দোলনেই বড়ো বড়ো দাবি মেনে নিতে। শুধু ১ জনের মৃত্যুতে বড়ো বড়ো নেতাদের পদত্যাগ করতে। আর প্রত্যেকটা ঘটনার দায়ভার স্বীকার করা তো আছেই।
শেষ কথা ক্ষমতাটাই আসল, দেশ ও দেশের মানুষ হচ্ছে তাঁদের ব্যবহার্য বস্তু। প্রয়োজনে ব্যবহার করলাম, আর প্রয়োজনে ছুড়ে ফেললাম।
কবে যে আমাদের রাজনীতিবিদের ক্ষমতায় আরোহণের পাশাপাশি ক্ষমতাকে উৎসর্গ করারও মানসিকতা জন্মাবে? কবে যে ক্ষমতা নিজের স্বার্থের চেয়ে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে ব্যবহারের দিকে বেশি মনোযোগী হবে? কবে যে ঘৃণার থেকে ভালবাসার ক্ষমতাটা বৃদ্ধি পাবে? কবে যে দেশ পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ফল ভোগ করবে?
এক বাচ্চা আরেক বাচ্চার খেলনা পেলে আর দিতে চায় না। আপনারা কি বাচ্চা, আর ক্ষমতা কি বাচ্চাদের খেলনা? স্বাধীন দেশের জনগণ আর কত উপহাসের স্বীকার হবে?
ক্ষমতার স্বাদ কি এতই অমিয় যে এর স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে মন নাহি চায়। ক্ষমতার স্বাদ কি এমনি স্বাদ যে, এর উপর কখনো তিক্ততা আসে না?
ওমর এফ নিউটন
বার্তা সম্পাদক
আইরিশ বাংলা টাইমস