এক
একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। পাশাপাশি দু গ্রাম। নদীর এ পার আর ওই পার। দু গ্রামেই দুজন বাঘা চেয়ারম্যানের বসবাস। উভয়েই উভয়কে শত্রু ভাবতেন। একজন আরেকজনের নাম শুনতে পারতেন না। কেউ কারো চেহারা দেখতেন না। দা-কুমড়া সম্পর্ক।
একদিন এক চেয়ারম্যানের কাজের লোক নদীর ঘাটে গোসল করতে যায়। সেখানে গিয়ে শুনতে পায়, ওপারের চেয়ারম্যান সাহেবকে গ্রেফতার করে পুলিশ থানায় নিয়ে যাচ্ছে। খবরটা শুনে গোসল শেষ না করেই কাজের লোকটি খুশিতে লাফাতে লাফাতে তার চেয়ারম্যানের কাছে আসে। গ্রেফতারকৃত চেয়ারম্যানকে একটি জঘন্য গালি দিয়ে গ্রেফতারের খবরটি তার মালিককে (চেয়ারম্যান) জানায়। কাজের লোকটি ভেবেছিলো যদি গালি দিয়ে গ্রেফতারের খবরটি জানানো হয় তবে তার মালিক তার উপর আরও বেশি খুশি হবে। কিন্ত বাস্তবে চেয়ারম্যান সাহেব খুশি না হয়ে বিব্রত হলেন। কাজের লোকটির উপর চড়াও হলেন। যে লোকটি তার সাথে খেলা খেলে অর্থাৎ তারই সমমানের একজনকে তার ঘরের চাকর যখন অসম্মান করে, গালিগালাজ করে তখন ওই চাকর সুযোগ পেলে তাকেও হেয় বা ছোট করতে দ্বিধাবোধ করবেনা। এ ভাবনাটা চেয়ারম্যান সাহেবকে বেশ তাড়িত করে। তাই তিনি কাজের লোকটিকে আর কোনো সুযোগ না দিয়ে কাছে ডেকে এনে দুই গালে দুটো থাপ্পড় দিয়ে বিদায় করে দেন।
বিষয়টি চেয়ারম্যান সাহেবের মনে ধরে। তাই তিনি দেরী না করে থানায় গিয়ে গ্রেফতারকৃত চেয়ারম্যানকে ছাড়িয়ে আনেন। তার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ তুলে নেন ও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তার অনুসারীদের কটুক্তির জন্য প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেন। ফলে এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হয়। যা পরবর্তিতে সাধারণ জনগণ ও সমাজে ব্যাপক ভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
দুই
বছর দশেক আগে বন্ধু শরীফ ভাই সহ ডিঙ্গেল গিয়েছিলাম। দেখলাম, সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে দুই আইরিশ ভদ্রলোক বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। ছোট মাছ। ধরে ধরে ছেড়ে দিচ্ছিলো। আমার হিউমার সেন্সকে প্রকাশ করার সুযোগ পেলাম। তাই দুষ্টোমি মাখিয়ে বললাম, “তোমরা এগুলো ছেড়ে দিচ্ছো কেনো! আমরা তো এসব খাই।” বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, এ প্রজাতির ছোট মাছ খাওয়া বা ধরা দুটোই আইন বিরোধী। “কোনো গার্ডা বা পুলিশ তো আর দেখছেনা, গাড়ির বুটে করে নিয়ে যাও। ” উত্তরে বললো, দেখুক বা না দেখুক বে-আইনী কাজ আমরা করতে যাবো কেনো!
এ দুই লোককে জোর করে বা ভয়ডীতি দেখিয়ে আইন মানার জন্য বাধ্য করা হয়নি। তাদের নৈতিক শিক্ষাই তাদেরকে আইনের প্রতি বিশ্বস্ত করে তুলেছে। অর্থাৎ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বে-আইনী কাজে লিপ্ত হয়নি। এই যে লিপ্ত না হওয়া, এর জন্য যে স্বচ্ছ মন-মানসিকতা ও নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন তাই আমাদের মাঝে চর্চা করতে হবে। একটি সুন্দর, সৎ ও সভ্য সমাজ গঠনকল্পে তা খুবই জরুরী।
তিন
গল্পটা কোথায় পড়েছিলাম ঠিক মনে নেই। তবে গল্পটি মনে আছে।
এক শিক্ষক ক্লাসে এসে ব্ল্যাকবোর্ডে একটি রেখা টেনে দেন। রেখাটিকে না মুছে ছোট করার জন্য বলেন সবাইকে। কিন্ত না মুছে রেখাটিকে ছোট করার উপায় কি! কারো মাথাতেই কোনো বুদ্ধি এলোনা। ফলে শিক্ষক এ রেখাটির নীচে আরেকটি রেখা টানলেন যা আগেরটির চেয়ে একটু বড়। ব্যাস আগের রেখাটি মুছা ছাড়াই ছোট হয়ে গেলো।
বস্তুত কাউকে ছোট করতে বা হারাতে হলে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা বা কুৎসা রটানোর প্রয়োজন হয়না। তাকে স্পর্শ না করেও তা পারা যায়! নিজেকে বড় করে বা মহৎ হিসেব গড়ে তুলতে পারলে এমনিতেই অন্যজন ছোট হয়ে পড়ে।
চার
আমি সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলাম একজন সাধারণ কন্স্ট্রাকসন কর্মী হিসেবে। ছেলেবেলা থেকেই হোষ্টেলে হোষ্টেলে সময় কেটেছে। জীবনে কোনোদিন কাজ করার সময় হয়ে উঠেনি। তাই সিঙ্গাপুরে কন্স্ট্রাকসনের মতো জায়গায় কাজ করা ছিলো আমার জন্য খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অনিচ্ছা সত্বেও কাজে ভুলভ্রান্তি হয়ে যেতো। বার্মিজ সুপারভাইজার ধৈর্যচ্যুত হয়ে বিগবসকে কম্লেইন করলো। আমাকে “বাঙ্গালা” “বাঙ্গালা” বলে কাছে ডেকে নিয়ে বস খুব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভরে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার কঠিন হুমকি দিলেন। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো। অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে একটু সাহস করে বসকে বললাম, “জীবনে কোনোদিন কাজ করিনি। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। মাস্টার্স শেষ করেই তোমার এখানে চলে এলাম। দয়া করে আমাকে একটু সময় দাও। আর ভুলভ্রান্তি হবেনা।”
– তুমি মাস্টার্স পাস! আর এখানে এসে লেবারের কাজ করছো! কম্পিউটার জানো? তাহলে তোমাকে অফিসে জব দিয়ে দিতাম।
কম্পিউটার জানা ছিলোনা। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিলাম। খুব আফসোস হলো। বসের প্রস্তাবটিকে আমার হাত থেকে স্বর্গের ছাবি গড়িয়ে যাওয়ার মতো মনে হচ্ছিলো।
যা হোক, এর পর থেকে কম্পিউটার শেখার ভূত মাথায় চাপলো। বন্ধুবর যায়েদ আহমদের (বর্তমানে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী) আপ্রাণ প্রচেষ্টায় শিখেও ফেললাম। দু মাসের মাথায় বসকে জানালে তিনি অফিসে যোগদান করতে বলেন। সেখানে আমি চার থেকে সাড়ে বছর চাকরি করি। এক পর্যায়ে বসের সাথে আমার নখ আর গোশত সম্পর্ক হয়ে উঠে। যে কোন কাজে কর্মে আমাকে ছাড়া ভরসা পেতেননা। বলতে গেলে এডমিন জাতীয় সকল দায়িত্বই আমার উপর ছিলো। এমনকি যে সুপারভাইজার আমার উপর অভিযোগ এনছিলো তার বেতনটাও আমার সিগনেচারে ড্র হতো।
সুতরাং ভুল যে মানুষকে সবসময় ভুল পথে পরিচালিত করে তা নয়, মাঝেমধ্যে ভুল ফুল হয়েও ফোটে। ব্যক্তি জীবনে যেমন তা সত্য তেমনি সাংগঠনিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক জীবনেও তা সমান ভাবে প্রযোজ্য।
পাঁচ
শেষ গল্পটি বলেই লেখার ইতি টানবো। এক বিবাহিত যুবক মানসিক অশান্তিতে ভূগছে। এ অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এক দরবেশ বাবার শরণাপন্ন হয়। তাকে তার অশান্তির কারণ ব্যাখ্যা করে। ব্যখ্যা করতে গিয়ে বললো, কয়েক বছরের দাম্পত্য জীবন তাদের। তার স্ত্রী তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তবু সে তার এক সহকর্মীনীর প্রেমে পড়ে যায়। ওই মেয়েও তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। যুবক স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে সহকর্মীকে বিয়ে করতে চায়। সে ক্ষেত্রে স্ত্রী যদি আকস্মিক ভাবে তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে তবে তার কাজটি করতে সহজ হয়। স্ত্রীর মনে অলৌকিক কেরামতিতে তার উপর ঘৃণার উদ্ভব ঘটনোর জন্যই সাধক বাবার কাছে যুবকের আগমন।
সব শুনে সাধক বললেন, উপরওয়ালার ঈশারায় সবই সম্ভব। তবে তার আগে তোমাকে দুটো কথা বলি। প্রথমত- ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে যদি তোমার স্ত্রীকে তোমার উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা করা হয় তবে সে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসবেনা। তার চোখে তুমি হবে পৃথিবীর জঘন্যতম ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয়ত- যে সুন্দরী মেয়ের ভালোবাসায় মজে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছো সেই মেয়ে বিয়ের পর ভবিষ্যতে তোমাকে একই ভাবে ভালোবাসবে তার কি নিশ্চয়তা আছে! এমনওতো হতে পারে ওই মেয়ে উল্টো তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কাউকে ভালোবেসে আবারও বিয়ে করছে। বস্তুত ভবিষ্যতে কি হবে, কি ঘটবে তুমি কিছুই জানোনা। তবে এতোটুকু নিশ্চিত ভাবে জানো যে তোমার স্ত্রী তোমাকে আগের মতো এখনো অনেক ভালোবাসে।
সাধকের কথা শুনে যুবকের চোখ খুলে গেলো। আবেগের মোহ কাটিয়ে বিপথগামীতা থেকে ফিরে এলো। ভবিষ্যত যেহেতু জানা নেই তাই বর্তমানকেই প্রাধান্য দিলো।
মুল কথা- পারিবারিক বন্ধন, এর সম্পর্কোন্নয় ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য আবেগকে ঠাঁই না দিয়ে বর্তমানের আলোকে যেমন ভেবেচিন্তে বাস্তব সিদ্ধান্তে পৌঁছা উচিত ঠিক তেমনি সামাজিক, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও তা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
গল্পে গল্পে, ঘটনায় ঘটনায় ব্যক্তি চিত্রের মধ্য দিয়ে প্রকৃত অর্থে এখানে একটি সুন্দর সমাজের আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। এ আকুতিতে সাড়া দিয়ে মানুষ যদি হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, কুৎসা-সমালোচনা তথা সকল অসূরতা বাদ দিয়ে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধাবোধ, নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, উদারতা, মহত্ত্ব, ঐক্য ও বন্ধন, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রভৃতি সুকুমার প্রবৃত্তির মাধ্যমে একটি সুন্দর, শ্বাশত, সম্প্রীতি ও সৌহার্দপূর্ণ এবং শীতল সমাজ রচনা করতে সক্ষম হয় তবে তা হবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক বিরাট আশীর্বাদ।
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
লেখক ও কলামিস্ট