খোলস – সাজেদুল চৌধুরী রুবেল

0
867
Kholosh, Hypocrate

খোলস
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল


 

ট্রেনটি আখাউড়া স্টেশনে থামতে না থামতেই লোকজন হূর হূর করে নামতে শুরু করলো। কারো কারো হয়তো অন্য কোনো ট্রেন ধরার তাড়া আছে, কেউ বা নিজ গন্তব্যে পৌঁছার জন্য উদ্গ্রীব। আবার অধিক দূর বা শেষ গন্তব্যে ভ্রমণকারী যাত্রীদের কেউ কেউ যাত্রাবিরতীর সুযোগে ট্রেনের অদূরে পায়চারি করবে, বিড়ি সিগারেট ফুকবে, চা সিঙ্গারা খাবে। ট্রেন ছেড়ে যাবার সময় হলে তারা আবার হূর হূর করে ট্রেনে উঠে গিয়ে যথাস্থানে বসে পড়বে।

ট্রেন থেকে অধিকাংশ যাত্রীরা নেমে পড়ায় ট্রেনটি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অতি সহজেই সবকিছু দেখা যাচ্ছে। জানালার পাশে বসে থাকা একজন যাত্রী আব্দুল আলী সাহেব বাইরের দিকে চেয়ে থেকে আখাউড়া জংশনের রূপ বৈচিত্র্য দেখছিলেন। জাতবেজাতের লোক হেঁটে চলছে। হকাররা ডেকে ডেকে সুর তোলে চা পান বিড়ি সিগারেট সহ হরেক রকমের জিনিস বিক্রি করছে। একটু পর পরই ট্রেন আসছে, ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। ভিক্ষুকরা সমস্বরে গান গেয়ে ভিক্ষা করছে। একজন সাপুড়ে সাপের খেলা দেখাচ্ছে। এসব দেখতে তার বেশ ভালোই লাগছিলো। কিন্তু যখন একজনকে অজগর কাঁধে নিয়ে ছবি তুলতে দেখলো তখনই তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। এ ধরনের দৃশ্য দেখতে তিনি মোটেও অভ্যস্ত নন। তাই ট্রেনের ভেতরে নজর দিলেন। চোখ পড়লো তার সামনের কম্পার্টমেন্টে আড়াআড়ি ভাবে বসা এক ভদ্রলোকের উপর। তাকে দেখেই তিনি চোখ নামিয়ে নিলেন। অজগরের চেয়েও ভয়ংকর মনে হলো ওই লোকটাকে। কমলাপুর স্টেশনে বসে তারা যখন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখনই তিনি ওই লোকটিকে দেখেছিলেন।

তাকে ঘিরে ছিলো সহজ সরল জাতের কিছু ধর্মান্ধ ব্যাক্তিবর্গ। স্টেশনের বেঞ্চে মখমল কাপড় বিছিয়ে তাকে শুইয়ে দিয়ে কেউ কেউ তার পা টিপে দিচ্ছে, কেউ মাথায় আরাম দিচ্ছে, কেউ তাকে বাতাস করছে, কেউ বা আবার “বাবা” “বাবা” চিৎকার দিয়ে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলছে। এসব আলী সাহেবের কাছে অসহ্য ঠেকছিলো। তখন থেকেই লোকটার প্রতি তার অরুচি ধরে আছে।

আলী সাহেব যে ঘৃণায় চোখ নামিয়ে নিয়েছেন তা ভদ্রলোকের বুঝতে মোটেও কষ্ট হয়নি। চোখের ভাষা বুঝতে না পারলে কি এতো সহজেই তিনি অগণিত মানুষকে ধোঁকা দিয়ে দিব্যি ভালো মানুষের খোলস পড়ে বেঁচে থাকতে পারতেন! জায়গায় বসে থেকেই ভদ্রলোক তাই আলী সাহেবকে ইশারায় ডাকলেন। আলী সাহেব উঠলেননা। এমন একটা ভান করলেন যেনো তিনি কিছুই বুঝেননি। এবার নাম ধরে ডাকলেন, আলী আলী….

ডাক শুনে তো আলী সাহেবের আক্কেল গুড়ুম । এ কি করে সম্ভব! চেনা নাই, জানা নাই একটি লোক কি করে তার নাম ধরে ডাকতে পারে! আলী সাহেব ভড়কে গেলেন। ভেতরে ভেতরে কাঁপতে শুরু করলেন। এমন কামেল ব্যাক্তিকে তিনি মনে মনে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন! ছি ছি এ হেন গর্হিত কাজ তিনি করতে পারলেন! না না মোটেও ঠিক হয়নি। এখনি গিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। বুজূর্গ ব্যাক্তি, আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি ক্ষমা করে দেবেন।

কাছে যেতেই আবারো শকড খেলেন তিনি। “কিরে তোর মাস্টারি কেমন চলছে?” এ কথা শুনেই তিনি চমকে গেলেন। হা করে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোকের দিকে। কি করবেন, কি বলবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। আলী সাহেব যে একজন শিক্ষক এটা তো তার জানার কথা নয়। অথচ এ না জানা কথাটাই অবলীলাক্রমে তিনি বলে ফেললেন। বিরাট আওলিয়া। অন্তর্যামী। অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। চোখ বন্ধ করলে সারা দুনিয়া তিনি নিমেষেই দেখে ফেলেন। আজকালকার ভন্ড পীরদের মতো তিনি কোনো সাধারণ ‘বাবা” নন। অসাধারণ বাবা। এ অসাধারণ বাবার পায়ে আলী সাহেব লুটিয়ে পড়তে চাইলেন।

বাবা তাকে থামিয়ে দিলেন। “তোর জায়গা ওখানে নয়, এখানে” বলেই বূকে বুক মিশিয়ে আলিঙ্গন করলেন। আলী সাহেব এবার ঘেমে উঠলেন। পঁচিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কতো অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। অথচ আজকের ঘটনার কোনো কূলকিনারাই খুঁজে পাচ্ছেন না। যে লোকটি তাকে চেনে না, জানে না, এর আগে তার সাথে এক মূহুর্তের জন্যও দেখা সাক্ষাত হয়নি সেই লোকটি কী করে তাকে কল্বে স্থান দেয়! তিনি অবাক হন। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। এবার বাবা মুখ খুলেন। ভ্যাবাচ্যাকার মতো তাকিয়ে আছিস কেনো? আয়, কাছে আয়। বলেই বুকে মিশিয়ে জোরে চাপ দেন। থতমত খেয়ে যায় মাষ্টার সাহেব। যেনো এক আজব লোকের পাল্লায় পড়েছেন তিনি। ভাগ্যিস কম্পার্টমেন্টে আপাতত কেউ নেই। পুরোটাই ফাঁকা। ভক্তবৃন্দদের সবাই ট্রেন থেকে নেমে গিয়ে কেউ পায়চারি করছে, বাবার সামনে ধূমপান করা যায়না বলে কেউ কেউ বিরামহীন সিগারেট টানছে, কেউ ফু দিয়ে ফু দিয়ে চা খাচ্ছে, কেউবা আবার দয়াল বাবার জন্য খাদ্য সামগ্রী কিনতে ব্যাস্ত। মাষ্টার সাহেব আমতা আমতা করে কি যেনো বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু পীর সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “তুই এখনো বোকাই রয়ে গেছিস। আমাকে চিনতে পারিসনি! বিশ্বনাথ হাই স্কুলের সেই দুষ্টু ছেলেটি আবু জুবায়ের। তার কথা কি তোর মনে আছে? সেই ছেলেটি হলাম আমি, আজকের শাহসূপী হযরত জমসেদ আলী হক্কানী। সবার প্রিয় “হক্কানী বাবা”। জানিস, আমার ভেতরে অলিত্বের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। তবু আমি ওলি। কারণ মানুষ আমার কাছে আসে। আমার পায়ে আনুগত্যের চুমু খায়। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেয়ার জন্য তারা আমার দরবারে আসে। আমাকে নজরানা দেয়।”

মাষ্টার সাহেব যখন এসব শুনছিলেন তখন তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো। কিছুক্ষণ আগে “সুফীবাবা” ভেবে যার পায়ে লুটিয়ে পড়তে চেয়েছিল তাকেই এখন ইচ্ছে করছে ওর দাড়ি ভর্তি গালে খুব জোরে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে খুব কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করলেন। ভালো ভাবে পরখ করে চিনতে চেষ্টা করলেন। সত্যিতো ও জুবায়ের! ছেলেবেলার স্কুলবন্ধু জুবায়ের। এবার মাষ্টার সাহেব মুখ খুললেন। ছি ছি একি তোর বেশ! তুইতো মেডিকেলে স্যান্স পেয়েছিলি। তোর তো ডাক্তারি পড়ার কথা ছিলো….
– হ্যাঁ পড়েছি, ডাক্তার হয়েছি। মানুষকে বছরের পর বছর সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তুই আমার কোনো খবর না রাখলেও আমি তোর সব খবর রাখি। তোর স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আমার একান্তই অনুগত সাগরেদ।

জুবায়ের ওরফে জমসেদ আলী হক্কানীর দিকে বক্র দৃষ্টিতে তাকালেন মাষ্টার সাহেব। যে তাকানোর অর্থ, তুই যদি ডাক্তার হয়ে থাকিস তবে এখন যা করছিস তা কি!
মাষ্টার সাহেবের বক্র দৃষ্টির মর্মার্থ হক্কানী সাহেব বুঝতে পারেন। তাই তিনি বেশ দৃঢ় ভাবে বলেন, শুন, তুই কি ভাবছিস তা আমি সব আন্দাজ করতে পারি। ভাবছিস, ডাক্তারই যদি হবো তাহলে এসব কি! এ কেমন ধান্দা!
– ঠিকই তো।

ডাক্তারের মতো একটি সেবামূলক পেশা বাদ দিয়ে কি করে তুই এমন জঘন্য কাজে জড়ালি? তাছাড়া তুই কি সত্যি অলৌকিক ক্ষমতা বলে মানুষের জন্য কিছু করার ক্ষমতা রাখিস?

– আরে ব্যাটা আমার ভেতরে কোন অলৌকিক ক্ষমতা বলতে কিছুই নেই। না আমি ওলি, না কোনো গাউস কুতুব। আমি হলাম আক্কলে আওলিয়া। হা হা হা!
– ছি ছি তুই হাসছিস! ডাক্তারি বাদ দিয়ে একজন ডাক্তার তার পেশাগত মর্যাদার কথা ভুলে গিয়ে এতো নীচে নামতে পারে তা ভাবতেও আমার লজ্জা হচ্ছে।
– তুই ভুল বলছিস। ডাক্তারি পেশা আমার এখনো আছে। তবে তা জনসেবা, সমাজ সেবা করার জন্য যথেষ্ট নয়। সেবার পরিধিকে বিস্তৃত করার মানসেই এই লাইনে আসা।
– তাই বুঝি! তুই যা’ না তা’ জাহির করার মধ্য দিয়ে “সেবা” খুঁজে বেড়াচ্ছিস!
– তাতে কি! আমি আমার যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আমার কর্ম পরিধি বাড়িয়ে চলছি। কতো ডাক্তার দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে কাকে চেনে? আমাকেই বা ডাক্তার হিসেবে কতোজন চিনতো! এখন আমার হাজার হাজার মুরীদ, সাগরেদ। “হক্কানী বাবা” হিসেবে এক ডাকে সবাই আমাকে চেনে। আমি যদি ফেসবুকে কোনো স্ট্যাটাস দেই কিংবা ইউটুবে কোনো বয়ান ডাউনলোড করি হাজার হাজার লাইক পড়ে। হাজার হাজার ভিউয়ার্স দেখে। ডাক্তারের পাশাপাশি নিজেকে “হক্কানী বাবা” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি বলেই আজ আমার এ সাফল্য।
-সাফল্য না ছাই। তুই যা করছিস, এটাকে কোনো সাফল্য বলা চলেনা। তুই মানুষকে ভুল তথ্য ও ভুল শিক্ষা দিচ্ছিস। অর্ধেক সত্য ও অর্ধেক মিথ্যের মাঝামাঝিতে দাড়িয়ে তুই মানুষকে চরম ধোঁকা দিচ্ছিস। ধোঁকাবাজি করছিস। প্রবঞ্চনা করছিস, আত্মপ্রবঞ্চনা। যে প্রবঞ্চনার ফল একদিন তোকে ভোগ করতেই হবে।
-তুই শিক্ষক মানুষ, নীতি বাক্যই তোর উপজীব্য।
– ভুল বলেছিস, নীতি বাক্য আমার কেবল উপজীব্যই নয়, তপস্যাও বটে। জানি তোদের মতো খোলস পড়া হক্কানী বাবাদের কাছে এ নীতি বাক্যের অর্থ একেবারেই অর্থহীন। তোর এমন অবস্থা দেখে আমার বেশ করুণা হচ্ছে। একটি কবিতা শুনাতে ইচ্ছে করছে তোকে –

ছিলে ডাক্তার, হয়েছিস ভন্ডবাবা, পড়েছিস খোলস
পেয়েছিস বোকা, দিচ্ছিস ধোঁকা, নামবে আজ না হয় কাল তোর ধ্বস
খাবি থাবা, হারাবি ইজ্জত, থাকবেনা আর অবশিষ্টাংশ
কাকও মুখ ফিরিয়ে নেবে সেদিন খেতে তোর তেতো মাংস।

 

হক্কানী বাবা কি যেনো বলতে যাবেন, এরি মধ্যে ট্রেন ছেড়ে যাবার হর্ণ বেজে উঠল। যাত্রীরা সব লাফালাফি করে ট্রেনে উঠতে শুরু করলো। মাষ্টার সাহেব দ্রুত তার সিটে এসে বসে পড়লো। ট্রেন চলতে লাগলো সা সা সা…….।

লেখক- প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
২৯ জানুয়ারী ২০২১

Facebook Comments Box