খন্দকার মুঈনউদ্দিন অপুঃ ২০২০সালের হজ্জের বহুল কাঙ্খিত লগ্ন এমন একটি সময় এসেছে, যখন কভিট ১৯ এর কালো থাবায় দুনিয়াব্যাপি মৃত্যুর মিছিলের সারি বেড়েই চলছে। হজ্জকে উদ্দেশ্যকরে যখন বাইতুল্লাহ্য় হাজীদের উচ্চারিত লাব্বায়েক আল্লাহ্হুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বায়েক লা-শরিকালাকা লাব্বায়েক, ইন্নাল হামদা, ওননেয়েমাতা লা-শরিকালাকা লাক, স্বরে আকাশ বাতাশ মুখরিত থাকার কথা ঠিক সে সময় তার চিত্র ভিন্ন। এখন পর্যন্ত সৌদি হজ্জমন্ত্রীসভা বহিরবিশ্বের কোন দেশকে হজ্জব্রত পালন করার জন্য অনুমতি প্রদান করেননি। যতটুকু সংবাদ পেয়েছি তাতে হজ্জব্রত পালন সৌদিয়ারব নিজ দেশের মধ্যে সিমাবদ্ধ রাখবেন যতকক্ষননা কভিট ১৯ নামক মহাদূরযোগ কেটে যায়।
হজ্জের আভিধানিক অর্থ:
হজ্জ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘আল-কাছদু’ কোন বিষয়ের বা কাজের ইচ্ছা বা সংকল্প গ্রহণ। আরবি ভাষায় হজ্জ হচ্ছে যিয়ারতের সংকল্প করা। শরীয়তের পরিভাষায় হজ্জ হলো আল্লাহ্তায়ালার ঘরের প্রতি সম্মান ও মহাত্ম প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কতকগুলি বিষেশ ও নির্দিষ্ট কাজ সহকারে মহান ঘরের যিয়ারতের সংকল্প গ্রহণ। আরবি জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে ফরজ হজ্জ পালন করতে হয়।
হজ্জ প্রধানত ৩ প্রকার, ১. হজ্জে ইফরাদ ২. হজ্জে কেরান ৩. হজ্জে তামাত্তু।
হজ্জের ইতিহাস-
অধিকাংশ আলেমদের মতে ষষ্ঠ হিজরী সনে মদীনা শরীফে হজ্জ ফরজ করা হয়েছে। ইমাম কুরতুবীর মতে ৫ম হিজরী সনে হজ্জ ফরজ হয়েছে। আল্লামা মাওয়ার্দীর মতে ৮ম হিজরী সনে হজ্জ ফরজ হয়েছে।
হজ্জের ইতিহাস অতি প্রাচীন। পৃথিবীতে মানুষ বসবাসের শুরু থেকে এমনকি আরও আগে থেকে। সর্বপ্রথম যখন হযরত আদম (আঃ) ভারত উপমহাদেশ থেকে মক্কা শরীফ গিয়ে হজ্জ পালন করেন, তখন জিবরাঈল (আঃ) বলেছিলেন- আপনার ৭ হাজার বছর আগে থেকে ফেরেশতারা এই ঘরের তাওয়াফ করে আসছে। কথিত আছে হযরত আদম (আঃ) ভারত থেকে পদব্রজে ৪০ বার হজ্জ পালন করেছিলেন।
এরপর বহু বাছর চলে যায়। বিশেষত হযরত নূহ (আঃ) –এর মহাপ্লাবনের পর এ ঘর বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং এ এলাকা জনমানবশূণ্য হয়ে পড়ে।
হযরত ইবরাহীম (আঃ) প্রায় ৪ হাজার বছর আগে ইরাকে জন্মগ্রহণ করেন। তার বংশেই হযরত মূসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এই ৩জন শ্রেষ্ঠ নবী জন্মগ্রহণ। তখন সমগ্র দুনিয়ার মানুষ আল্লাহ্তায়ালাকে ভুলে বসেছিল। যে জাতির মধ্যে তার জন্ম হয়েছিল সে জাতির লোকেরা যদিও তখনকার পৃথিবীর উন্নত জাতি ছিল, কিন্ত পথভ্রষ্ট হওয়ার দিক দিয়ে তারা ছিল অগ্রগামী। তারা আকাশের তারকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জীব যন্তু, মাটি ও পাথর নির্মিত মূর্তির পূজা করত। তারা জ্যোতিষশাস্ত্র, জাদুবিদ্যা ও ঝাড়ফুকের চর্চা করত। বিভিন্ন দেবদেবী তৈরি করে এদেরকে পূজা করত এ আশায় যে, এদের খুশি করতে পারলে তাদের মঙ্গর সাধিত হবে। শুধু তাই নয় রাজা বাদশাহদেরকেও তারা সেজদা করত, আল্লাহ্তায়ালার অংশ মনে করে। উল্লেখ্য যে তিনি যে বংশে জন্মগ্রহণ করেন সে বংশটাই ছিল পেশাদার ও বংশানুক্রমিক পূজারী। তার বাপ দাদাও ছিলেন আপন বংশের পন্ডিত পুরেহিত। কিন্তু তার বিবেক সেসব পূজারীদের অনুসরন করতে সায় দিল না। বরং তিনি বললেন: আমার রব কেবল তিনিই হতে পারেন যিনি সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন, সকলেই যার মুখাপেক্ষী এবং যার হাতে সকলেরই লাভ-ক্ষতি ও জীবন-মৃত্যু। তাই তিনি উপাস্য মুর্তিগুলোকে পরিত্যাগ করে ঘোষণা দিলেন-
“ইন্নি ওয়াজ্জাহতু ওয়াজ হিয়ালিল্লাযি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদোয়া হানিফাও ওমা আনা মিনালমুশরিকীন”
অর্থাৎ- আমি সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিশেষভাবে কেবল সেই মহান সত্তাকেই ইবাদত বন্দেগীর জন্য নির্দিষ্ট করলাম, যিনি সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের মধ্যে শামিল নই। (সূরা আনআম)
এ বিপ্লাবাত্বক ঘোষণার পর হযরত ইব্রাহীম (আঃ) -এর উপর মুসীবতের পাহাড় ভেঙ্গে পড়ল। তার পিতা তাকে পরিত্যিাগ করল। সমগ্র জাতি তাকে আশ্রয়হীন করল। সত্যের জন্য তিনি একাই মাথা তুলে দাড়ালেন। রাজার দরবার থেকে ফয়সালা হল তাকে জীবন্ত জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়া হবে। সে ব্যবস্থাও করা হল। তারপর আল্লাহ্তায়ালার অনুগ্রহে মুক্তি পেলেন তখন সবকিছু ছেড়ে শুধু নিজের স্ত্রী ও ভ্রাতুস্পুত্রকে সাথে নিয়ে শত বিপদের মোকাবেলা করে সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিশর এবং আরব দেশসমূহে ঘুরতে থাকলেন। কিন্তু কোথাও শান্তিতে বসবাস করতে পারলেন ন। তার একমাত্র অপরাধ ছিল তিনি যেখানে যেতেন সেখানেই বলতেন- আল্লাহ্তায়ালা ছাড়া আর কোন মালিক নাই, প্রভু নাই, মুনিব নাই, সকলে শুধু তারই এবাদত করো। এভাবে তার গোটা যৌবনকাল অতিবাহিত হয়ে কালো চুল সাদা হয়ে গেল।
জীবনের শেষভাগে ৮৬ বছর বয়সে যখন সন্তান লাভের কোন আশা ছিল না তখন আল্লাহ্তায়ালার আদেশে স্ত্রী বিবি হাজেরা (আঃ) ও বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া সন্তান ইসমাঈল (আঃ)কে লুপ্ত কাবা ঘরের নিকটবর্তী জনমানবশূণ্য স্থানে রেখে গেলেন। আল্লাহ্তায়ালার ইচ্ছার কথা জেনে বিবি হাজেরা সবর করলেন। ইব্রহীর (আঃ)-এর রেখে যাওয়া সামান্য পানীয়, খাদ্য কয়েকদিনের মধ্যে ফুরিয়ে গেল। মা ও শিশু ক্ষুধায় পিপাসায় কাতর। মা হাজেরা নিকটস্থ সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের উপর উঠে চারিদিকে তাকালেন যদি কোথাও কোন কাফেলা বা পানির সন্ধান পাওয়া যায়। এভাবে ৭ বার সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করে হতাশ হৃদয়ে শিশু পুত্রের নিকট এসে দেখলেন, মাটি ফুরে স্বচ্ছ পানির ধারা বইছে। এটাই জমজম কূপের উৎস। মা ও সন্তান তৃপ্তি সহকারে পানি পান করে আল্লাহ্তায়ালার শুকরিয়া আদায় করলেন। বাণিজ্য কাফেলা মরূভূমির বুকে পানির সন্ধান পেয়ে মা হাজেরার অনুমতি নিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করল। ধীরে ধীরে মক্কা জনপদে পরিণত হল।
পরবর্তীতে আল্লাহ্তায়ালা লূপ্ত কাবা ঘরের স্থানটি দেখিয়ে তা পুনঃনির্মাণের আদেশ দিলেন। ইব্রাহীম (আঃ) পুত্র ইসমাঈল (আঃ)কে সাথে নিয়ে পবিত্র কাবাগৃহ পুনঃনির্মাণ করলেন। যে পাথরটির উপর দাড়িয়ে তিনি এ সুউচ্চ ঘরটি নির্মাণ করলেন তা আধুনিক লিফ্ট এর কাজ করলো। যা মাকামে ইব্রাহীম নামে আজও বিদ্যমান। এরপর আল্লাহ্তায়ালাতায়ালা ইব্রাহীম (আঃ)কে আদেশ দিলেন যে,
“এবং মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা করে দাও। তারা তোমার নিকট আসবে পায়ে হেটে এবং সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে করে, [উটগুলো] আসে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে।” (সূরা হজ্জ)।
আল্লাহ্তায়ালার আদেশে ইব্রাহীম (আঃ) এর ঘোষণা সমস্ত জীবজগৎ এমনকি রূহ জগতেও আল্লাহ্তায়ালা পৌছে দিলেন। হজ্জ শুরু হওয়ার এটাই গোড়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ।
হজ্জ ফরয হওয়ার শর্ত-
মুসলমান হওয়া, স্বাধীন হওয়া, আকেল বা বুদ্ধিমান হওয়া, বয়োপ্রাপ্ত হওয়া, সুস্থ হওয়া, আর্থিক ও শারিরীক সামার্থবান হওয়া ইত্যাদি।
হজ্জের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব-
প্রোত্যেক ধনী ও সম্পদশালী মুসলিম ব্যক্তির উপর জীবনে একবার হজ্জ পালন করা ফরয। এর অস্বীকারকারী সুস্পস্ট কাফের (সূরা আলে-ইমরান:৯৭)। এটা একাধারে দৈহিক, আত্মিক ও আর্থিক ইবাদত বিধায় এর ধর্মীয় গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ্পাক বলেন-
“আর তোমরা আল্লাহ্তায়ালার উদ্দেশ্যে হজ্জ ও ওমরা পরিপূর্ণভাবে পালন কর”। (সূরা আল-বাকারা : ১৯৫)।
হজ্জ পালনের মাধ্যমে ঈমানের পরিপূর্ণত ও দৃঢ়তা লাভ করা সম্ভব হয়। হজ্জ পালনের মাধ্যমে আল্লাহ্তায়ালাপাক মানুষের গুনাহ সমূহ মাফ করে দেন। আল্লাহ্তায়ালার নবী (সঃ) বলেছেন-
“যে ব্যক্তি এ ঘরে (কাবায়) হজ্জ করতে এলো এবং কোন প্রকার অন্যায় কাজ করলনা কিংবা কোন অশ্লীল কথা বললনা, সে এমন (পবিত্র) হয়ে প্রত্যাবর্তন করলো, যেমন তার মা তাকে নিস্পাপরূপে ভূমিষ্ট করেছিলো (বুখারী-মুসলিম)।
হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মুসলিম নর ও নারী সাদা পোশাক পরিধান করে থাকেন। নগ্ন পদ ও শূণ্য মস্তিস্ক নিজের সকল আমিত্বকে এক আল্লাহ্তায়ালার খুশির জন্য বির্সজন দিয়ে পরকালের মুক্তির আশায় আল্লাহ্তায়ালার দরবারে ধরনা দেয়, যাতে করে পরকালে হাশরের ময়দানের কথা স্মরণ হয়।
হজ্জ পালনের সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। হজ্জ মুসলিম জাহানের এক মহা সম্মেলন। কোন মুসলমানই তা অস্বীকার করতে পারেনা। সমস্ত মুসলমানকে এক ঐক্যে ও ভ্রাতৃত্বে সৃষ্টি করে দেয়। হজ্জ বিশ্বের মানুষের বর্ণবাদ, গোত্রবাদ, সমাজবাদকে ভুলিয়ে এক আল্লাহ্তায়ালার গোলাম বনিয়ে দেয়। তাই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে হজ্জের শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।
আয়ারল্যান্ড থেকে হজ্জে অংশগ্রহন পদ্ধতি-
আয়ারল্যান্ড থেকে প্রধান দুটি অর্গানাইজেশন হজ্জ যাত্রীদের জন্য ব্যাবস্থা করে থাকেন। যেমন- মানাসিক টুর ও ডাবলিনের সাউথ সার্কুলার মসজিদ। উভয়ের সার্ভিসে বিগত বেশিরভা হজ্জযাত্রীরাই সন্তষ্ট বলে যানাযায়। যদিও তাদের উভয়ের সার্ভিস ভিন্ন। মানাসিক মক্কা থেকে শুরু করে মদিনাতে ট্রিপ সমাপন করে। আর সাউথ সার্কুলার মসজিদ মদিনা থেকে শুরু করে মক্কায় গিয়ে ভ্রমন শেষ কর থাকে। এ দুই পদ্ধতিতে দুই রকম সুবিধা ও অসুবিধা আছে। কেউ যদি মনেকরে থাকেন যে আমি আগে হজ্জের ফরয দায়িত্বগুলো শেষ করতে চাই তিনি মানাসিক এর সাথে যেতে পারেন। আবার কেউ যদি মনেকরেন যে আমার হজ্জের শেষ চিত্রটি কাবার সাথে হোক তিনি সাউথ সার্কুলার রোড মসজিদ থেকে যেতে পারেন। আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে আমাদের সুবিধা ও অসুবিধা। হজ্জ যাত্রীরা উভয় অর্গানাইজেশন থেকেই হজ্জ ট্রেনিং পেয়ে থাকেন।
যদিও ওমরা পদ্ধতি হজ্জ মন্ত্রীসভা অনলাইন সিস্টেম চালু করে বিগত দিনের তুলনায় অনেক সহজ করে দিয়েছেন। ওমরা পালন করার জন্য কোনো অর্গানাইজেশনের স্বরনাপন্ন নিষপ্রয়োজন। ইতিমধ্যে আয়ারল্যান্ড থেকে অনেক মুসলমান ভাই ও বোন নিজের প্রচেষ্টায় এবং সহজে ওমরা পালন করে এসেছেন।
হজ্জ প্রেত্যেক মানুষকে তার মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ সৃষ্টি জগতের কোন সৃষ্টিজীবই পৃথিবীবে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারবেনা। সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। পৃথিবীতে কোন মানুষই আল্লাহ্তায়ালার নির্ধারিত সময়ের বেশি জিবীত থাকতে পারেনি এবং পারবেওনা। তাই হজ্জ পালনের মাধ্যমে আল্লাহ্পাক তার বান্দাদেরকে এ শিক্ষাই দান করে থাকেন। আমাদের ব্যাক্তি জীবনে যাদের হজ্জ পালন করার সামর্থ আছে তাদেরকে যেন আল্লাহ্তায়ালা তার ঘর পরিদর্শন করার জন্য কবুল করেন এবং যাদের হজ্জ পালনের সামর্থ নেই তাদেরকে যেন আল্লাহ্তায়ালা হজ্জ পালন করার সামর্থ দান করেন। আমিন।