সাংগঠনিক ভাবনা -আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশী সামাজিক সংগঠন
সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য সমাজ বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না। এটি মূলত সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সক্ষমতা, সদিচ্ছা, পারস্পরিক মূল্যবোধের সমন্বয়। তবে এ বিষয়টির বিকাশে পারিবারিক শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।স্থান কালো ভেদে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় সমাজে। আমি কোন সমাজ বিজ্ঞানী নই বা নই কোন নামিদামি সমাজ সংস্কারক বা বহুল পরিচিত সামাজিক আন্দোলনের প্রবক্তা। তাই এর চুলচেরা বিশ্লেষণের চেষ্টা করা পাঠকের মধ্যে আগ্রহের পরিবর্তে বিরক্তির কারণই ঘটবে।
তবে আসা যাক মূল বিষয়টিতে। আমার অনভিজ্ঞ লেখনীর মাধ্যমে কিছুটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই পাঠক এবং আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশী ভাই-বোনদের সাথে। প্রচার আছে যে, এখানে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার বাংলাদেশীর বসবাস। শিক্ষাসহ নানা ধরনের পেশায় আমরা নিয়োজিত আছি।নিয়োজিত পেশার উল্লেখ করে লেখার কলেবর বৃদ্ধি আর করলাম না। তবে গর্ব করে বলতে পারি এখানে বাংলাদেশী বেকারের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য সংখ্যক। গত প্রায় কুঁড়ি বছর একটি বৃহৎ সংখ্যার বাংলাদেশী ভাই-বোনদের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে। এ সুযোগটি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে “বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব আয়ারল্যান্ড” নামক সংগঠনটির সূচনা লগ্ন থেকে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার কারণে। যদিও এই সংগঠনটি নামের পরিবর্তন হয়েছে ২০১১ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।
এই এসোসিয়েশন সংশ্লিষ্ট ভাই দের মুখে শুনি ২০১১ পরবর্তী সময়ের ইতিহাস এমনকি অনেকে বলতে দ্বিধা করেনা এর শুরুটিও ২০১১ সনে। তাদের প্রতি অত্যন্ত বিনীত অনুরোধ এই সংগঠনে আপনার সম্পৃক্ততাই সংগঠনের শুরু না। এই সংগঠন শুরুর ইতিহাস হয়তো আপনার জানা নাই। তাই বলি ভুল বার্তা প্রচার না করাই শ্রেয়। সংক্ষিপ্তাকারে যদি আমি এর ইতিহাস বলি তবে বলতে হয় ২০০৩ সালে Camden Street Dublin এর সুরমা ইন্ডিয়ান রেস্তোরায় প্রাথমিক সভার পর ২০০৫ সনের শেষ অথবা ২০০৬ সোনার প্রথম দিকে ডাবলিনের Little Lane এ First Solution Money Transfer অফিসে এস এম মাহফুজুল হক ভাইকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে ডাবলিনে মোস্তফা ভাইকে সভাপতি এবং সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান ভাইকে সাধারণ সম্পাদক করে পুনরায় কমিটি গঠন করা হয়। এরপর ২০০৮ সনে সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান ভাইকে সভাপতি এবং বেলাল হোসেনকে শ্যামল ভাইকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১১ নির্বাচন-পূর্ববর্তী কমিটি কার্য পরিচালনা করে আসে। তার পরবর্তী ইতিহাস কমবেশি অনেকের জানা। তবে যেটুকু না জানালেই নয় তাহলো ২০১১ নির্বাচন পরবর্তী সভাপতি ডাক্তার জিন্নুরাইন জায়গীরদার ভাই এবং সাধারণ সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ ভাই ছাড়া বাকি সকল নির্বাচিত সদস্য ভাইদের খুব একটা সম্পৃক্ততা লক্ষ করা যায়নি। আর কেবলমাত্র সভাপতি-সম্পাদক সর্বস্ব সংগঠন কতটাই অবদান রাখতে পারে তা সহজেই অনুমেয় এবং তা কেবল ডাবলিন ভিত্তিক নয় পুরো আয়ারল্যান্ডের জন্য।
আমি সংক্ষেপে কেবল বলব এর দায়ভার কেবল সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নয়, এটা পুরো কমিটির সমন্বয়হীনতা, অসহযোগিতা এবং সারাদেশব্যাপী কেবল কেন্দ্রীয় কমিটির উপর দায়িত্ব অর্পণ।ডাবলিন সহ অন্যান্য কাউন্টি গুলোতে এলাকা ভিত্তিক সাব-কমিটি গঠন বা কাউন্টি ভিত্তিক কমিটি গঠন না করা এর মূল কারণ হিসেবে আমি উল্লেখ করতে চাই।
আবাই এর বিকাশ বাঁধা গ্রস্থ হওয়ার জন্য আমি আরও একটি কারণ হিসেবে দেখি আয়ারল্যান্ডে বসবাসরত উল্লেখ পেশার ভাই-বোনদের এই সংগঠনের কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ অংশগ্রহণ না করা বা তাদেরকে আকৃষ্ট করতে না পারাটা ও। আমি যদি আরো একটু পরিষ্কার করে বলি তাদের মধ্যে শিক্ষক, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, নার্স, উচ্চশিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক মেধাসম্পন্ন লোকবল সহ অন্যান্য পেশাজীবী ভাই-বোনদের সম্পৃক্ততা জরুরি।
আমি আরও একটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাই যে সকল ভাই বোনেরা এদেশে এসে লেখাপড়া শেষ করে বিভিন্ন পদে কাজে যোগ দিয়েছেন বিশেষ করে তাদেরকে আমাদের এই সংগঠনে তাদের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট করা।
বাংলাদেশী জাতীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি আইরিশ বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান কেও অংশগ্রহণ করা সংগঠন বিকাশে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। এবং বাংলাদেশী জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে এদেশে বাংলাদেশী গুণীজনদের সম্মানিত করা ও নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে সম্পৃক্ত হতে। আমি আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। তা হল যারা এখানে দেশী রাজনীতির প্র্যাকটিস করছি তাদেরকে অবশ্যই ভিন্ন মতাদর্শের ভাই-বোনদের প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষ ভুলে অন্তত দেশমাতৃকার স্বার্থে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। তাতে যেমন দলীয় ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন থাকবে এবং ভাতৃপ্রতিম সম্পর্ক বজায় থাকবে।দৃঢ় হবে সামাজিক বন্ধন, সৃষ্টি হবে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব যা সুষ্ঠ সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে।
আমি আরো একটি বিষয়ে কথা উল্লেখ করতে চাই গুরুত্ব দিয়ে আর তা হলো আইরিশ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ হোক সেটা স্থানীয় অথবা জাতীয়। আসুন আমরা সচেতন হই এই বিষয়টিতে তা শুরু হোক স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ভোটার হওয়ার মাধ্যমে যাদের সুযোগ আছে। আমরা আরও পিছিয়ে না থাকি, অবহেলা বা হেলামি না করি, এই বিষয়টি নিয়ে আসুন আমরা সকলে সকলকে সচেতন করি,সহযোগিতা করি এ বিষয়টিতে অংশগ্রহণ করতে।
প্রিয় পাঠক ভাই ও বোনেরা আশা করি আপনারা সকলেই ইতিমধ্যে জ্ঞাত হয়েছেন যে বাংলাদেশ সরকার আয়ারল্যান্ডে একটি পূর্ণাঙ্গ এমব্যাসি করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং আয়ারল্যান্ড সরকার যাতে বাংলাদেশ তাদের এমব্যাসি করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন সে ব্যাপারে ও সরকারী পর্যায়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। এখানে একটি বিষয় আমাদের তুলে ধরা দরকার। আমরা কত সংখ্যক বাংলাদেশি আয়ারল্যান্ডে বসবাস করছি এই ব্যাপারে আমাদের কাছে সঠিক কোন তথ্য নেই। সেই লক্ষ্যে আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির পক্ষ থেকে গত কয়েক মাস যাবত একটি ডাটাবেইজ কাজ চলছে। আসুন আমরা সকলেই অনলাইন ডাটা রেজিস্টারে তথ্য দিয়ে এ প্রকল্পকে সহযোগিতা করি যা আমাদের সঠিক সংখ্যক বাংলাদেশি বসবাসকারী জানার পাশাপাশি আগামীতে কমিউনিটি নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগে সহায়ক হবে।
আসুন আমরা করোনা কালীন দুর্যোগ মোকাবেলায় বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সহযোগিতা মূলক কর্মকাণ্ডে বেশিবেশি অংশগ্রহণ করি। যা এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তি তুলে ধরবে। ইতোমধ্যেই কিলকেনি, গলওয়ে , ডাবলিন, লেটারকেনী সহ অন্যান্য কাউন্টিগুলোতে আমাদের বাংলাদেশী ভাইয়েরা হাসপাতাল, গার্ডা স্টেশন এ খাবার বিতরণ করেছেন। যে সকল ভাইয়েরা এই মহান কাজটি নিয়ে কাজ করছেন তাদের প্রতি রইল সালাম ও শুভকামনা।
পরিশেষে আমি বলতে চাই আয়ারল্যান্ডের বাংলাদেশ এসোসিয়েশন এখন যে পর্যায়ে এর সাংগঠনিক ভিত প্রতিষ্ঠা হয়েছে এর পেছনে অনেক ভাইদের অবদান রয়েছে যাদের সংশ্লিষ্টতা না থাকলে হয়তো এ কাজটি এতদূর এগিয়ে আসতে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতো। তাদের নাম এখানে উল্লেখ না করলেও তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তবে আমি একজন ভাইয়ের নাম উল্লেখ না করে পারছি না যার সহযোগিতা না থাকলে হয়তো আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশ হাইকমিশনের পাসপোর্ট সার্জারি সহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হতে আরো অনেকটা সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হতো। তিনি আমাদের অতিপরিচিত অনেকটা প্রচারবিমুখ সদা হাস্যোজ্জ্বল শাহ নেওয়াজ টুটুল ভাই। তার হাত ধরেই আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশ হাইকমিশনের যাতায়াত শুরু এখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের মধ্যে সেবা প্রদানের জন্য। পরবর্তীতে ফকির জাকির হোসেন ভাইও অনেক সহযোগিতা করেআসছেন, তারপরে অদ্যাবধি সাইফুল ইসলাম ভাইও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছেন এই সংগঠনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য। ডাবলিন ভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজনে যাদের নাম ভুলার মতো নয় তাদের মধ্যে আক্তার হোসেন, হুমায়ুন কবির অপু, টিটু মিয়া, গোলাম মোর্শেদ কামরুল ও কাজী আহমেদুল কবির অন্যতম। আমরা সম্মিলিত সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের আরো সমৃদ্ধি ও প্রসার আশাকরি সমগ্র আয়ারল্যান্ড ব্যাপী।
শাহাদাৎ হোসেন
সংগঠক ও সমাজ সেবক