সঞ্চয় – সাজেদুল চৌধুরী রুবেল

0
879

পরিষ্কার আকাশ। ধবল জোস্না। কোথাও মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। পূর্ণিমার ভরাট চাঁদ হাসছে। তারারা ঝিকিমিকি করছে। বাইরে মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। ভাড়া করে থাকা আক্কাস সাহেবের দক্ষিনামুখী ফ্ল্যাটটিতেও এ বাতাস বয়ে যেতে লাগলো। সাততলার উপরে ফ্লাট। সহজেই বাতাস গড়িয়ে বেড়ায়। চাঁদের আলোও পড়েছে ঘরের ভেতর। বিছানায় শুয়ে আছে স্ত্রী শামীমআরা। ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিনের খাটাখাটনি ও ক্লান্তির পর খুব বেশিক্ষণ ঘুম ধরে রাখতে পারেননা। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। কতো দিন আক্কাস আলী সারাদিনের ঘটে যাওয়া গল্প বা সুখ দুঃখের কথা শুয়ে শুয়ে বললে দু একবার “হু” “হ্যাঁ” শোনার পর আর কোনো সাড়াশব্দ পেতেননা। বুঝতেন, স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছে। কোন কোন দিন স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তিনিও ঘুমিয়ে যেতেন, আবার কোনো কোনো দিন স্ত্রীকে বিছানায় আগলে রেখে তার ঘুম যেনো ভেঙ্গে না যায় সে জন্য খুব সতর্কতার সাথে বিছানা ছেড়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়াতেন। আজও তিনি তাই করলেন। শামীমআরা বেগম ঘুমিয়ে যাবার পর তিনি ঘুমোতে পারছিলেন না। তাই তিনি অতি সঙ্গোপনে বেলকনিতে এসে দাড়ালেন।

শামীমআরা ঘুমোচ্ছেন। এক খন্ড চাঁদের আলো তার মধ্যবয়সী চেহারায় দোল খেয়ে গেলো। চাঁদের আলোতে উজ্জ্বল ফর্সা মুখটি আরও ঝলমলে হয়ে উঠলো। বয়সে প্রৌঢ়া হলেও চেহারায় এর বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। এখনো টগবগে যুবতী বলেই ভুল করবে যে কেউ। বড়ো মেয়ে ভার্সিটিতে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। অথচ পাশাপাশি দাড়ালে মনে হবে বড়ো বোন ছোট বোন। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে স্ত্রীর এমন সৌন্দর্যময় ঘুমন্ত চেহারাটা দেখছিলেন অপলক দৃষ্টিত। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে এভাবেই তিনি এ সৌন্দর্য অবলোকন করে আসছেন।

পঁচিশ বছর আগে এক সুন্দর বিকেলে তার সাথে প্রথম দেখা। মফস্বল শহর থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে আসে শামীমআরা। ভাই ভাবীর সাথে ব্যুটানিকেল গার্ডেনে ঘুরতে গেলে কাকতালীয় ভাবে আক্কাস সাহেবের সাথে তাদের দেখা হয়ে যায়। ভাই ইমতিয়াজ মতিঝিলে একটি কর্পোরেট অফিসে চাকরি করতেন। আক্কাস সাহেব বসতেন রাজউক বিল্ডিংয়ে। দুজনের অফিস আলাদা আলাদা বিল্ডিংয়ে হলেও তারা প্রায়ই একই রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেতে যেতেন। সে সুবাদে তাদের মধ্যে আগে থেকেই কিছুটা মুখচেনা মুখচেনা ভাব ছিলো। দু একদিন হয়তোবা ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথাও হয়েছিলো। আজ এক ভিন্নতর পরিবেশে একে অপরকে দেখে মনে হলো যেনো তাদের মধ্যে কতো দিনের সম্পর্ক, কতো দিনের চেনাজানা! দুজনেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডসেক করতে করতে একে অন্যকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ” এখানে কি মনে করে?”
ইমতিয়াজ সাহেবই প্রথম উত্তর দিলেন। ছোট বোনের দিকে ইশারা করে বললেন, “ও মফস্বল থেকে এসেছে। তাকে ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছে। তো আপনার কি অবস্থা? কোথায় যেনো থাকা হয়?”
আক্কাস সাহেব তার বোনের সৌন্দর্য দেখছিলেন। লাজুক চোখ দুটোতে যেনো বিরাজ করছিলো ভূমধ্যসাগরের নীল নীরবতা। ঠোঁটে জামার সাথে ম্যাচ করা লিপস্টিকের হালকা রং। মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করা ঘন কালো লম্বা চুল। সাক্ষাৎ পরী। রূপকন্যা। পড়ন্ত বিকেলের সোনালি রোদের সৌন্দর্যও তুচ্ছ তার সৌন্দর্যের কাছে। প্রথম দেখাতেই ভালো লাগার মতো মেয়ে সে। এমন একজনকে নিয়ে যে কারো প্রেমসাগরে ডুব দেয়ার ইচ্ছে হবে। তারও হলো। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করলেন না, বুঝতে দিলেন না। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন- মালিবাগ, মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায়।
– ও আচ্ছা! তাহলে তো আপনি লাকি। অফিস থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আমার তো প্রতি দিন সকালে যুদ্ধ করে অফিসে যেতে হয়। ঢাকা শহরে রাস্তাঘাটের যা অবস্থা!
– কেনো! আপনার বাসা বেশ দূরে বুঝি?
– হ্যাঁ, মিরপুর ১৮ তে। চলুন না আমার বাসায়। এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
– না, না তা কি করে হয়! অন্য একদিন যাবো।
– আমার স্ত্রী ভালো কফি বানায়। না গেলে পস্তাবেন।
– কফির কথাই যখন বললেন, তাহলে চলুন সামনের কফিশপটাতেই বসা যাক।

ইমতিয়াজ সাহেব আর আপত্তি করলেন না। পরিপাটি কফিশপ। পুরো ক্যাফে জুড়ে দেয়ালে লাগিয়ে রাখা সাউন্ডবক্স থেকে মৃদু আওয়াজে ভেসে আসছিলো হিন্দি গানের মাদকীয় সুর। “আজকাল ঢাকা শহরে ফাস্টফুড ও বেভারেজ শপ গুলো বেশ আধুনিক হয়ে উঠছে” ইমতিয়াজ সাহেব এ কথা বলে জানালার পাশে টেবিলটিতে বসার ইঙ্গিত দিলেন। কথামতো সবাই সেখানে বসলেন। বসার সময় সবার অলক্ষ্যে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই আক্কাস ও শামীমআরার চোখাচোখি হয়ে যায়। কিছু কিছু কাজে কারও নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। অনিচ্ছাকৃত ভাবেই ঘটে যায়। তাদের চোখাচোখির বিষয়টিও ছিলো অনেকটা এরকম। লজ্জাবতী লতার মতো শামীমআরা লজ্জা পেয়েছিলো। চোখ নামিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু এ লাজুক চোখের ভাষা আক্কাস সাহেবের বুঝতে মোটেও কষ্ট হয়নি। শামীমআরার বুকের ধরপড়ানি যেনো স্পষ্ট তিনি শুনতে পেলেন। তবু তা না শুনার ভান ধরে পরিবেশ স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে ইমতিয়াজ সাহেবের কথার রেশ ধরে আক্কাস সাহেব বললেন, আচ্ছা ইমতিয়াজ সাহেব বলুন তো আধুনিক মানেই কি নিজ শিকড়কে ভুলে যাওয়া, বিজাতীয় সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ হওয়া, নষ্টামি, নোংরামি?
এবার তার দিকে শামীমআরা ও তার ভাবী দুজনেই তাকালেন। ইমতিয়াজ সাহেব উত্তর দেয়ার আগে ভাবীই মুখ খুললেন। বললেন, ভাই হুট করে এ প্রশ্ন কেনো?
আক্কাস সাহেব সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ছবি গুলো দেখিয়ে বললেন, দেখুন- ওখানে একটিও দেশীয় ছবি নেই। আমাদের দেশের সবুজ শ্যামল দৃশ্য কি কম হৃদয়গ্রাহী? প্রাচীন স্থাপত্য শিল্প সমন্বিত ছবি কি বাজারে নেই?
শুধু কি তাই? এই যে গানটা বাজছে তাও হিন্দি। মন শীতল করার মতো বাংলা গানের কি খুব অভাব? এ পর্যন্ত বলতেই ওয়েটার বিনয়ী ভংগিতে কাছে এসে দাঁড়ালো। অর্ডার নিলো। মজার ব্যাপার হলো কফি খেতে গিয়ে কেউ আর কফি খাননি। সবাই বেশি করে দুধ চিনি দিয়ে চা খেলো। সে বয়সে তো কারো ডায়াবেটিস বা কলেষ্টরল বেড়ে যাওয়ার ভয় ছিলোনা!

সেদিনের সন্ধ্যাটা ছিলো আক্কাস সাহেবের জীবনের এক সর্বোৎকৃষ্ট সন্ধ্যা। বিদায় নিয়ে যখন তিনি বাসায় ফিরছিলেন তার কাছে পৃথিবীটা নতুন মনে হচ্ছিলো। সুন্দর লাগছিলো এ ধরণীর সবকিছু। জীবন মনে হচ্ছিলো খুব অর্থবহ। ঢাকা শহরের বিরক্তিকর জ্যামও মনে হলো মধুর মতো। কান ছেদ করার মতো হর্ন যেনো বাঁশির সুর হয়ে বাজতে লাগলো। হৃদয়ে দোল খেতে লাগলো চোখাচোখির সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্যপট। চোখে গেঁথে আছে একটু আগে দেখে আসা মিষ্টিময় চেহারাটা। মনের আয়নায় বার বার ভেসে উঠতে লাগলো। আহ্ কী সুন্দর! পৃথিবী কতো সুন্দর! আনমনেই গুন গুন করে গেয়ে উঠলো রবীন্দ্র সংগীতের দুটো কলি ….।

চলে এলো বাসার সামনে। ব্যাবিট্যাক্সিতে বসে কল্পনার রাজ্যে হাবুডুবু খেতে ভালোই লাগছিলো। কিন্তু না, নেমে যেতে হবে। ড্রাইভারকে পঞ্চাশ টাকা বেশি দিয়েই চলে যেতে লাগলো। ড্রাইভার সাহেব পেছন থেকে ডেকে বললেন, চাচা টাকা বেশি দিয়ে গেছেন, আপনার ভাংতি পঞ্চাশ টাকা নিয়ে যান।
ঘার ফিরিয়ে আক্কাস সাহেব বললেন, এটা আপনার বখশিস চাচা। রেখে দিন।
হাত তুলে দোয়া করলেন চাচা। আল্লাহ্ তার মনের আশা পূরণ করুন।

আক্কাস সাহেব ড্রাইভারের সততায় মুগ্ধ। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, আহা! আমাদের দেশের নেতা-নেত্রী ও সরকারী রাঘব বোয়ালরা যদি অন্তত ড্রাইভার চাচার মতো সৎ হতেন দেশটা কতোইনা উন্নত হতো। সুন্দর হতো। ভাবতে ভাবতে বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকলেন। ম্যাসমেট তৌফিক সাহেব দেখেই বলে উঠলেন, কি ব্যাপার আক্কাস সাহেব, কোথায় ছিলেন সারাদিন? ভেবেছিলাম, আপনাকে নিয়ে বিকেলে ঘোরাফেরা করবো।

তৌফিক ও আক্কাস সাহেব দুজনে একই রুমে থাকেন। আলাদা আলাদা বেড। তাদের মধ্যে বেশ ভাব। খুবই আন্তরিক। পারিবারিক কথাবার্তা সহ সব রকমের সুখদুঃখের গল্প একজন আরেকজনের সাথে শেয়ার করেন। আক্কাস সাহেব আগে থেকেই মনস্থির করে রেখেছেন বাসায় পৌছেই তৌফিককে সব খুলে বলবেন। তিনি আর তর সহ্য করতে পারছিলেননা। এক নিশ্বাসে পুরো কাহিনী বলে ফেললেন। তৌফিক সাহেব মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে সব শুনলেন।

প্রায় তিন মাস পর শামীমআরার সাথে আক্কাস সাহেবের বিয়ে সম্পন্ন হয়। একই নদীর অভিন্ন স্রোতে মিশে যায় দুজন দুজনার হয়ে। আক্কাস সাহেব তার বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখা কথাটি একদিন সাহস করে শামীমআরার বড়ো ভাইকে বলে ফেলে। কথায় আছে না, সাহসে লক্ষী। কাজ হয়ে গেলো। তারা তো এমন একটি ছেলেই খুঁজছিলো। শুভ কাজে তবে আর দেরি কেনো! ব্যস্ ঘরোয়া পরিবেশে হয়ে গেলো বিয়ে। তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। ১০/১২ জন বন্ধুবান্ধব নিয়ে খুব সাদাসিধে ভাবে ভাইয়ের বাসা থেকে শামীমআরাকে কবুল পড়িয়ে নিয়ে আসে।

সেই যে শুরু হলো সংসার তা আজও চলছে সং ও ঢং হয়ে। সংসার মানেইতো সং আর ঢং। এ সং আর ঢং এর মধ্য দিয়েই চলছে তাদের পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু তারা মোটেও অসুখী দম্পতি নয়। তারা এ জীবনে বহুবার একসাথে বেলকনিতে বসে বিকেলের চা খেয়েছে । চাঁদ দেখেছে। পূর্ণিমা দেখেছে। তারার ঝিকিমিকি দেখেছে। সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত দেখেছে। বৃষ্টিতে ভিজেছে। দুটো স্বত্বায় যেনো এক আত্মার বসবাস।

শামীমআরার যে জিনিসটা আক্কাস সাহেবের বেশি ভালো লাগে তা হলো তার কোনো চাহিদা নেই। শরীরের সৌন্দর্যের মতোই সুন্দর তার মন। কোনো কোনো সুন্দরী মেয়েরা বেশ অহংকারী হয়। বদমেজাজি হয়। কিন্তু শামীমআরা একটু অন্যরকম। তার মধ্যে এসবের কিছুই নেই। সংসার জীবনেও তার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। অভিযোগ অনুযোগ নেই। চাওয়া পাওয়া আর অভিযোগ অনুযোগের বিষবেদনা ছিলোনা বলেই তারা হয়ে উঠতে পেরেছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী দম্পতি।

তার কোনো বাড়তি আকাঙ্খা ছিলোনা। বিয়ে করে যেদিন একরুম বিশিষ্ট একটি সাবলেট হাউজে তাকে নিয়ে তুললো, সেদিনও সে মন খারাপ করেনি। বরং কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলেছিলো আমার কিছুই চাওয়ার নেই। সারা জীবন শুধু তোমাকে আমার কাছে পেতে চাই। আর একটি কথা। শুধু একটি ঘর চাই। নিজের ঘর। যে ঘরে সাজাবো নিজের মতো করে নিজের সংসার। যে সংসারে বইবে শান্তির হিমেল বাতাস। যে সংসার হবে তোমার আমার জান্নাত।

পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবন পেরিয়ে এলেও আক্কাস সাহেব শামীমআরা বেগমকে সে ঘর আজও দিতে পারেননি। অবশ্যি এ জন্য শামীমআরা বেগমের কোনো আক্ষেপ নেই কিংবা তাদের সংসারেও সুখের কোনো ঘাটতি ঘটেনি। আক্কাস সাহেব ইচ্ছে করলে এ জীবনে ঢাকা শহরে কয়েকটি বাড়ি করতে পারতেন। গাড়ি কিনতে পারতেন। রাজউকের প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্টে তিনি চাকরি করতেন। বলতে গেলে টাকার খনি। তার সহকর্মীরা প্রতিদিনই পকেট ভারী করে বাসায় ফিরতেন। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন নীতি ও নৈতিকতার পথ। সততার পথ। আখিরাতের পথ। সে পথ বেয়ে তিনি দুমুটো ডালভাত যুগিয়ে সাদাসিধে জীবনের মধ্য দিয়ে পাড়ি দিয়েছেন অনেক লম্বা সময়। শামীমআরা তাতে অসন্তুষ্ট না হয়ে এ জীবনকেই স্বাগত জানিয়েছেন। আলিঙ্গন করেছেন। গর্ব একটাই তার স্বামী ঘুষখোর নয়, দুর্নীতিবাজ নয়। এটাই সুখের, এটাই গৌরবের।

শামীমআরা বেশ সঞ্চয়ী মহিলা। মেয়েদের পড়াশুনার খরচ বাবদ ও সংসার পরিচালনার জন্য আক্কাস সাহেব প্রতিমাসে তার হাতে যে অর্থ তুলে দিতেন সেখান থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে কিছু টাকা পয়সা জমা করতেন। বিশেষ বিশেষ দিবস বা অনুষ্ঠানে মেয়েরা উপহার ও সালামি হিসেবে টাকা পয়সা পেলে সে গুলোও তিনি খরচ করতেননা। সেভিংস একাউন্টে জমিয়ে রাখতেন। উদ্দেশ্য একটাই, আক্কাস সাহেব অবসরে যাওয়ার পর পেনশনের টাকা দিয়ে যখন কোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনবে তখন তিনি ওই জমানো টাকা কাজে লাগাবেন। বাড়ি কিনতে গিয়ে যদি টানাপোড়েন দেখা দেয় তবে তিনি আক্কাস সাহেবকে এ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করবেন। আর যদি প্রয়োজন না হয় তবে ইচ্ছে মতো আসবাবপত্র কিনবেন।

আজ দুপুরে তৌফিক সাহেবের সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিলো। তৌফিক সাহেবের হাউমাউ কান্না সব ওলটপালট করে দিলো। আক্কাস সাহেবের হৃদয় বিগলিত হয়ে গেলো। তিনি যা বলার জন্য তৌফিক সাহেবের কাছে গিয়েছিলেন তা আর বলা হলোনা। শামীমআরাকেও দুপুরের ব্যাপারে কিছুই তিনি জানাতে পারেননি। বুকের ভেতর যেনো একটি পাথর চাপা দিয়ে আছে। নাহ্ তিনি আর ভাবতে পারছেন না। শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। চোখ জ্বালাপোড়া করছে। ঘাড়ের দুপাশে দুটো রগ চিন চিন করছে। সম্ভবত প্রেসারটা বেড়ে গেছে। তিনি আর দেরি করলেন না। বেলকনি থেকে চলে এলেন। ঘরে ঢুকেই শামীমআরার মাথায় খুব আস্তে আদর করে হাত বুলালেন। শুয়ে পড়লেন। ঘুমোতে চেষ্টা করলেন।

ফজরের আজানের আগেই আক্কাস সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। খুব বেশি ভালো ঘুম হয়নি। বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চাচ্ছিলোনা। আরেকটু গড়াগড়ি করতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু “ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম” এ কথা মনে হতেই তিনি আলসেমি ভেঙ্গে উঠে পড়লেন। বাসায় দু’রাকাত সুন্নত পড়লেন। মসজিদে গিয়ে ফরজ নামাজটা আদায় করলেন। বাসায় এসে পোষাক বদলালেন। মর্নিং ওয়াকে বেরুলেন।

শামীমআরা বেগমও উঠে নামাজ পড়লেন। কোরআন তেলওয়াত করলেন। একটু চা খেলেন। পানের বদভ্যেস আছে তার। তাই পান মুখে দিয়ে নাস্তা বানানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বড়ো মেয়েকে আটটার আগেই নাস্তা দিতে হবে। আক্কাস সাহেবও মর্নিং ওয়াক শেষ করে সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়বে। তার হাতে আজ অনেক কাজ। প্রথমে ব্যাংকে যাবে। পরে রেজিস্ট্রি অফিসে। খুব আনন্দ লাগছে শামীমআরার। কতো দিন পর তাদের স্বপ্ন সফল হতে যাচ্ছে আজ। পঁচিশ বছর পর ভাড়াটিয়া জীবনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। আক্কাস সব কাজ ঘুচিয়ে ফেলেছে। বনশ্রীতে চার রুম বিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাট। বেশ ছিমছাম। সুন্দর। একেবারে মনের মতোন। বেলকনি আছে। দুজনে বসে বিকেলের চা খাওয়া যাবে। পুরো টাকা পরিশোধ করে আজ রেজিস্ট্রি করা হবে। আহ! ভাবতেই কেমন পুলক পুলক অনুভব হচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। ভাবলেন, কাজের মেয়েটা এসেছে হয়তো। কিন্তু দরোজা খুলেই অবাক। তৌফিক সাহেব তার স্ত্রী মিলাকে নিয়ে দাড়িয়ে। সাতসকালে অপ্রত্যাশিত ভাবে তাদেরকে দেখে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। কি বলবেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেননা। তৌফিক সাহেব তার সম্মোহন শক্তি দ্বারা তা আচ করতে পেরে তিনিই বললেন, এতো সকালে আমাদেরকে দেখে খুব অবাক হয়েছেন, এইতো! অবাক হওয়ারই কথা। শামীমআরা বেগম তার উত্তর না দিয়ে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললেন, আগে ভেতর চলুন।

ড্রয়িং রুমে সোফায় বসতে বসতে তৌফিক সাহেব বলতে লাগলেন, ভাবী অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের এ ঋণ শোধ করার মতো নয়। শামীমআরা হা করে তাকিয়ে রইলেন। তিনি আগা মাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তাই একটু ইতস্তত করে বললেন, কিসের ঋণের কথা বলছেন, আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। এবার কিছুটা ভ্রু কুঁচকে তৌফিক সাহেব বললেন, কেনো, আক্কাস কি আপনাকে কিছুই বলেনি?
– না…
– সে গতকাল আমার এখানে গিয়েছিলো….
এ পর্যন্ত বলতেই তাকে থামিয়ে দিয়ে শামীমআরা বললেন, তাতো আমি জানি। আমরা বনশ্রীতে যে ফ্ল্যাট রাখতে যাচ্ছি তার রেজিস্ট্রি হবে আজ। এ সুসংবাদটা জানানো এবং আজ রেজিস্ট্রি করার সময় যেনো আপনি তার সাথে থাকতে পারেন তা বলার জন্যই গতকাল আপনার এখানে যাওয়ার কথা ছিলো।
তৌফিক সাহেবের কপোলে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। স্ত্রী মিলার দিকে তাকিয়ে বেশ বিমর্ষ ভাবে শুধু বললেন, ও আচ্ছা!
– সব ঠিক আছে তো ভাই সাহেব?
– হ্যাঁ হ্যাঁ সব ঠিক আছে। এ কথা বলেই তৌফিক সাহেব একটি চেক বের করলেন। পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকার চেক। শামীমআরাকে তা দেখিয়ে বললেন, গতকাল আক্কাস আমাকে এটি নিজ হাতে সাইন করে দিয়ে এসেছে।
– এসবের মানে কি ভাই? বেশ আড়ষ্ট কন্ঠ শামীমআরার।
– আক্কাস যেহেতু আপনাকে কিছুই বলেনি তাহলে আমার কাছ থেকে কঠিন সত্যটি শুনুন।

স্ত্রী মিলাকে দেখিয়ে বললেন, ও বড্ড অসুস্থ। মৃত্যুপথযাত্রী। লিভার সিরোসিস হয়েছে। বাংলাদেশে এর কোনো ভালো চিকিৎসা নেই। ইন্ডিয়ায় নিয়ে গিয়ে দ্রুত লিভার ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করতে পারলে বেঁচেও যেতে পারে। ফিফটি ফিফটি সান্স। কিন্তু এটা অনেক টাকার বিষয়। নূন্যতম পঞ্চাশ থেকে ষাট লক্ষ টাকার প্রয়োজন। জানেন তো আমার কাছে কোনো টাকা পয়সাই নেই। সারা জীবন ভুল পথে চলেছি। স্বামী স্ত্রী দুজনেই বেহিসেবির মতো দু হাতে টাকা পয়সা উড়িয়েছি। জীবনে কখনো সঞ্চয়ের চিন্তা করিনি। আজ প্রয়োজনের বেলায় আমি নিঃস্ব, রিক্ত। আমার আহাজারি ও হৃদয়ের পীড়ন উপলব্ধি করে আক্কাস সমস্থ জীবনের সঞ্চয় আমার হাতে তুলে দেয়। এসব বলতে বলতে তৌফিক সাহেবের গলা ভারী হয়ে আসছিলো।

মিলা ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে। শামীমআরা তার দিকে তাকালেন। অনেক বদলে গেছে মহিলাটা। দামী প্রসাধনী ও পারফিউম ব্যবহার ছিলো যার নিত্যদিনের অভ্যেস, খোলামেলা পোশাকের মাঝে যিনি খূঁজে পেতেন নগ্ন আধুনিকতা তাকে আজ বড্ড সাদাসিধে লাগছে। শালীন পোশাকআসাকের পাশাপাশি হিজাবও পড়েছেন। দু হাতে টাকা পয়সা খরচ করতেন। মানুষকে কাঁটা কাঁটা কথা বলতেও দ্বিধাবোধ করতেননা। শামীমআরা বেগমকেও তিনি কম কথা শুনাননি। একদিন তো শামীমআরা কেঁদেই ফেলেছিলেন। মিলা বলেছিলো, মফস্বলের মেয়েরা এরকমই হয়। ওদের অন্তর খুব ছোট। হাড়কিপটে। টাকা পয়সা খরচ করার মাঝে যে একটা মজা আছে তা ওরা বুঝেইনা। এ কথা শুনার পর শামীমআরার কি কান্না …!

মিলা এগিয়ে আসলো। অশ্রু ভেজা চোখে শামীমআরাকে বলতে লাগলো, আপা, অনেক ভুল করেছি। মাফ করে দেবেন। আপনাদেরকে সবসময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছি অথচ আপনারাই আজ আমার পাশে দাঁড়ালেন। কোনো দিন এ ঋণ শোধ করতে পারবোনা। বলেই শামীমআরার হাত দুটো চেপে ধরলেন। মুখ গুঁজে আবারো বলতে লাগলেন, প্লিজ আপা, শুধু একবার বলুন আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন।

ঠিক এ মূহুর্তে আক্কাস সাহেব ঘরে এসে ঢুকেন। এমন একটা মূহুর্ত দেখার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেননা। বেশ বিব্রত বোধ করেন। শামীমআরা তাকে দেখেই কাছে ছুটে এলেন। অভিযোগের তীর ছুড়লেন। কি করে পারলে তুমি আমাকে না জানিয়ে এতোটা সময় পার করতে?

আক্কাস সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেননা। চোখে চোখ রাখতে পারছিলেন না। তবু অনেক কষ্ট করে তার দিকে তাকালেন। বললেন, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। তোমার সারা জীবনের সঞ্চয়,স্বপ্ন সাধ ধূলিস্যাৎ করে দিলাম। এমন হতাশাব্যঞ্জক বেদনাবিধূর সংবাদ তোমাকে জানানো আমার জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছিলো। গতকাল রাতে অনেক বার বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। আমাকে ক্ষমা করো লক্ষীটি।

– এই তোমার বিশ্বাস? এই তোমার ভালোবাসা? তুমি একাকি কেনো এ কষ্টের ভার সইছো? আমাকে বললে এ কষ্টের ভার আমিও কিছুটা ভাগ করে নিতাম!
– তোমার সারা জীবনের স্বপ্ন-সাধ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেলো। খেয়ে না খেয়ে, পড়ে না পড়ে যে সঞ্চয় তুমি করেছিলে তাও বিলিয়ে দিয়েছি তোমাকে না জানিয়েই। আমি বড্ড অপরাধী।
– ছি ছি তুমি এসব কি বলছো! টাকা পয়সা ধনসম্পদ তো জীবনের চেয়ে বড়ো নয়। সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে তুমি যে উদারতা, যে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছো তা এ সমাজে কতোটা মানুষ করতে পারে! আমি ধন্য, আমি গর্বিত তোমার মতো মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়ে। তাছাড়া যে সঞ্চয়ের কথা বলছো তাতো যথার্থ সঞ্চয় নয়। সাময়িক। পার্থিব। বরং তুমি যা করছো তাই স্থায়ী সঞ্চয়। জীবনের সঞ্চয়। আখিরাতের সঞ্চয়।

স্ত্রীর এমোন কথা শুনে আক্কাস সাহেব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলেন নাা। চোখ ছলছল করছিলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, আকাশের মতো উদার তুমি, সাগরের মতো বিশাল তোমার হৃদয়। তোমার মহত্ত্বের কাছে আমি হেরে গেলাম। সত্যি আমি খুব ভাগ্যবান পুরুষ। বলেই ভাবাবেগে মত্ত হয়ে শামীমআরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপোলে এঁকে দিলো মায়া ভরা মিষ্টি চুম্বন। 

অক্ষর ব্লগ থেকে নেওয়া

Facebook Comments Box