মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তিক ইতিহাস: আরও জোরালো প্রচার প্রয়োজন
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
স্বাধীনতা দিবস এলে আমরা কেবল স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়েই টানাহ্যচরা করিনা বরং ২৫ মার্চ কালো রাতের কথা বলাবলি করি, আওয়াজ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনি, ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দু লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। এ সবই ঠিক আছে। কারণ এগুলো সবই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। স্বাধীনতার ইতিহাস। স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতার ইতিহাস স্মৃতিচারিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গল্পের ভেতরে যেমন অনেক গল্প লুকিয়ে থাকে তেমনি ইতিহাসের ভেতরেও অনেক ইতিহাস মানুষের অজানা থাকে। মুক্তিযুদ্ধের এমন অনেক ইতিহাস রয়েছে যা সাধারণ মানুষ এখনো জানেনা। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জের প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস। এ ইতিহাস ইতিহাসবেত্তাদের কলমে সচরাচর সেভাবে উঠে আসেনা। এরকম অনেক উঠে না আসা ইতিহাসের একটি আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
আমার মা’র বয়স প্রায় আশি বছর। প্রতিদিন তাঁর সাথে কথা বলি। ঘন্টা ছাড়িয়ে যায়, তবু কথা চলে। মা ছেলের কথা, ভালো মন্দ জিজেস করলেই যথেষ্ট। বড়জোর কি খেয়েছেন বা কি রান্না করা হয়েছে, ওষুধ গুলো খেয়েছেন কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি দু মিনিটের মধ্যেই কথা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের কথা শেষ হয়না। মা’র কন্ঠটাকে আরও কিছুক্ষণ শোনার জন্য ইচ্ছে করেই আমি কথা লম্বা করি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এ কথা, ও কথা জিজ্ঞেস করি। আবার কোনো কোনো দিন মা নিজেও অতীত স্মৃতিতে ফিরে যান। তাঁর স্মৃতি ও শ্রবণশক্তি দুটোই ভালো। স্মরণ শক্তিও বেশ প্রখর। তিনি যখন ক্লাস টু তে পড়তেন তখন তাঁর চাচাতো বোনের বিয়ে হয়। সে সময় তাঁর চাচা (আমার শ্রদ্ধেয় নানা) বিয়ের আসরে পাঠ করার জন্য একটি কবিতা লিখে দেন। বিশ/বাইশ লাইনের কবিতাটি এখনো তাঁর ঠোটস্থ। সেদিন আমাকে এক নিশ্বাসে শোনালেন যা আমি রেকর্ড করে রেখেছি। আমার মা খুব সম্ভবত ফাইভ/ সিক্স পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। কিন্তু বই পড়ার প্রতি ছিলো তাঁর প্রবল আগ্রহ। কথায় কথায় একদিন বললেন, “আজকালকার ছেলেমেয়েদের তো বই পড়ার প্রতি তেমন বেশি আগ্রহ নেই। ওরা ফেসবুক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু আমাদের সময়ে ছিলো ভিন্ন প্রেক্ষাপট। আমরা বই পুস্তক পড়তেই বেশি পছন্দ করতাম। তোমার বাবার সংগ্রহে প্রায় দেড় দুইশ বই ছিলো। তার সব গুলোই আমি পড়েছি।” অর্থাৎ সংসারের সব কাজকাম সেরে আমাদেরকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে কুপিবাতি জ্বালিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত বই পড়তেন। স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে মা আমাকে এখনো ওইসব বইয়ের গল্প শোনান।
বই পড়ার কথা বলতে গিয়েই একটু আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন তিনি। বাবার কথা মনে পড়ে গেলো তার। আমার বাবা মারা গেছেন প্রায় বিশ বছর আগে। আমরা ভায়েরা যখন বড়ো হলাম, কামাই রুজি করতে শিখলাম তখনই তিনি চিরতরে চলে গেলেন। সুখভোগ করার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। সারাজীবন শত্রুদের সাথে পাঞ্জা লড়ে টিকে থাকতে হয়েছে। একজন স্কুল শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন ন্যায় ও আদর্শের প্রতীক। অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়ানো ছিলো তাঁর স্বভাবের বাইরে। সততা, আদর্শ, পরহিতৈসী মনোভাব, গরিব ও সংখ্যালগুদের পক্ষে কথা বলাই ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। আর এ বৈশিষ্ট্যই তাঁর জন্য কাল ছিলো। এ বৈশিষ্ট্যের জন্যই তিনি ধান্দাবাজ সমাজপতিদের কাছে শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। আর এ শত্রুতার জের হিসেবে তারা মরণ কামড় দেয়ার চেষ্টা করেছিলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। কয়েকদিন আগে মা আমাকে ওই গল্পটি শোনালেন।
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধনু নদীতে চলন্ত লঞ্চ থেকে সহসা গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে এলো। মিলিটারি এসে গেছে ভেবে গ্রামবাসী তটস্থ হয়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর লঞ্চ যখন গ্রামের বাজারে এসে থামে তখন বুঝতে পারলো, ওরা মিলিটারি নয়, মুক্তিবাহিনীর একটি দল। গ্রামবাসী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু ওই হাঁফ ছেড়ে বাঁচাটা বেশিক্ষণ টিকলো না। কমান্ডার সাহেব গ্রামের মাথা শ্রেণীর লোকদের ডেকে পাঠালেন। চেয়ারম্যান মেম্বার সহ অনেকেই জড়ো হলেন। আমার বাবাও এলেন। আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেককে এ গ্রামে কালপ্রিট কে, রাজাকার কে তা লিখে দেয়ার জন্য বলা হলো। আমার বাবা কে কালপ্রিট, কে রাজাকার কিছুই বললেন না কিন্তু একজন জনপ্রতিনিধি ও তার ভাই আমার বাবাকে তাদের শত্রু ও কালপ্রিট বলে উল্লেখ করলো। এবং আমাদের পাড়াতেই ঐতিহ্যবাহী এক হিন্দু বাড়িতে দু একদিন আগে যে ডাকাতি হয়েছিলো তার দায়ভার তাঁর উপর চাপানোর চেষ্টা করলো। আমার বাবার হুকুমেই ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে বলে কমান্ডারকে জানানো হলো। যারা ডাকাতির সাথে সরাসরি জড়িত ছিলো তাদেরকে সামনে হাজির করা হলো। ওরাও আমার বাবাকে “হুকুমদাতা” বলে সাক্ষী দিলো। বস্তুত ওরা ছিলো ওই জনপ্রতিনিধি গোষ্ঠীর পা চাটা গোলাম। তাদের শেখানো বুলিই ওরা অনবরত বলে যাচ্ছিলো। সত্য কথা স্বীকার করানোর জন্য যতোই ওদেরকে প্রহার করা হচ্ছিলো ততোই তারা আমার বাবার নাম বলছিলো। কিন্তু কমান্ডার সাহেব ছিলেন বেশ বিচক্ষণ লোক। তিনি কোনো অবস্থাতেই তাদের কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বুঝতে পারছিলেন এটা ষড়যন্ত্র। তাই তিনি বাবার কাছে গেলেন, বললেন, ” আপনার চেহারা এতো মলিন কেনো, অভয় দিচ্ছি আপনাকে গুলি করা হবেনা।”
এর একটু পরই একটি গুলির শব্দ শোনা গেলো। ফাঁকা গুলি। ডাকাতদেরকে ভয় দেখানোর জন্যই মূলত এ গুলি করা হয়েছিলো। কিন্তু মানুষ বলাবলি করতে লাগলো এই বুঝি মাষ্টার সাহেবকে গুলি করে হত্যা করা হলো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাবাকে গুলি করা হয়নি। বরং কমান্ডার সাহেব তাঁকে বাড়ি যেতে বললেন। কথিত ওইসব জনপ্রতিনিধিদের অপকর্ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সারাজীবন যে তিনি কলমযূদ্ধ করেছেন তার প্রমাণপত্র হাজির করার জন্য অনুরোধ করা হলো। বাড়িতে এসে আলমারি থেকে পুরনো ফাইল ভর্তি পিটিশন নিয়ে কমান্ডার সাহেবকে দেখালেন। কমান্ডার সাহেব যা বোঝার তা বুঝে ফেললেন। আমার বাবাকে সসম্মানে ছেড়ে দিলেন। ডাকাত গুলো কে গুলি করে মারতে চাইলেন। কিন্তু বাবার অনুরোধে তারা বেঁচে গেলেন।
আমি আমার পরিবারের, গ্রামের এ করুণ ইতিহাসটি গাল্পিক আকারে টানলাম। কিন্তু এমন করুণ ইতিহাস শুধু আমার গ্রামেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলার প্রতিটি গ্রামে এমন হাজারো ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। আমার বাবা হয়তোবা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু এমন অনেকে আছেন যারা নিজেদেরকে বাঁচাতে পারেননি। তাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শুধু পাকবাহিনী কর্তৃকই এ দেশের মানুষ নির্যাতিত হয়নি, মারা যায়নি, নিজেদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভুল সিদ্ধান্তের শিকারেও পরিণত হতে হয়েছে অনেককে।
“মুক্তিযুদ্ধ” একটি অহংকারের নাম। আর “মুক্তিযোদ্ধা” ত্যাগ ও মহিমার নাম। গর্ব ও গৌরবের নাম। একটি শ্রদ্ধার প্রতীকের নাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজাকার সেজে যেমন কিছু কিছু লোক মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহযোগিতা করেছিলো, জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য কাজ করেছিলো ঠিক তেমনি মুক্তিযোদ্ধার পোশাক পরেও কিছু কিছু লোক দেশবিরোধী কাজ করেছে। গ্রামে গঞ্জে ডাকাতি করেছে, লুটপাট করেছে। বর্ডারমুখী শরণার্থীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ সবই কঠিন বাস্তবতা, রূঢ় ইতিহাস। কিন্তু এসব ইতিহাস খুব বেশি একটা চোখে পড়ে না। পত্রপত্রিকায় লেখা হয়না। ইতিহাসবিদরা এসব নিয়ে খুব বেশি একটা মাথা ঘামাননা, গবেষণাও করেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিখুঁত ভাবে তুলে ধরা ও একে সমৃদ্ধ করে তোলার স্বার্থে গ্রামবাংলার প্রান্তিক ইতিহাসকে মোটেও হেলা করা উচিত নয়। আশা করি ইতিহাস বেত্তাগন বিষয়টি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করবেন।
শেষ কথা বলে শেষ করবো। প্রত্যক্ষ ভাবে যারা স্টেনগান, রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করেছেন তাঁরা যে মুক্তিযোদ্ধা তা নতুন করে বলে বোঝাবার দরকার নেই। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তাঁরা। তবে সাধারণ মানুষ যারা পাকিদের নির্যাতন, নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, যারা যুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সাহস জুগিয়েছে, বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা। তাই আমি বলতে চাই, শুধুমাত্র রাজাকার, আল বদর, আলসামস তথা মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী ছাড়া বাংলার প্রতিটি মানুষই তখনকার স্ব স্ব অবস্থানে ছিলেন একেকজন মুক্তিযোদ্ধা।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
লিমরিক, আয়ারল্যান্ড