খবরটা দু তিন দিন আগেই পড়েছি। স্তম্ভিতও হয়েছি। তবু লিখতে পারিনি। করোনা হামলার পর থেকে আয়ারল্যান্ডের আবহাওয়া যেনো সহসাই বদলে গেছে। তেমন কোনো ঝড়বৃষ্টি নেই। শো শো করে বাতাস নেই।বরং আকাশ পরিষ্কার। ঝলমলে রোদ ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে যাওয়ার জন্য কেবল হাতছানি দেয়। বিশেষ করে গত দু চার দিন ধরে চিক চিক রোদের যে ঝলক, তা সত্যি লোভনীয়। এ যেনো প্রিয়ার ভালোবাসার চেয়েও আকর্ষণীয়। তাই করোনায় ঘরবন্দি লোকদের মধ্যেও যেনো একটা বিদ্রোহ দেখা দিলো। তারা আর ঘরে থাকতে চাইলোনা। তাই অনেকেই করোনা ঝুঁকি মাথায় নিয়েই ঘরের বাইরে বেড়িয়ে পড়লো। আমিও ওইসব গৃহবিদ্রোহীদের একজন। তাই সঠিক সময়ে লিখাটা হয়ে ওঠৈনি।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাস মিনিবাসের ভাড়া নাকি ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়। বাস মালিক সমিতির একটি কমিটি দেশের চার শতাধিক রুটে বাস-মিনিবাসের ভাড়া ৮০ শতাংশ বাড়ানোর দাবি করে। তাদের মতে একজন যাত্রী যদি নিরাপত্তা জনিত কারনে দুটো আসনের জন্য দুটো টিকেট কেনে তবে যতো মূল্য আসবে তা থেকে তারা ২০ শতাংশ ছাড় দেবে। বাকি ৮০ শতাংশ ভাড়া যাত্রীদেরকে পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করার সুপারিশ করেছে। এ সুপারিশ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, দেশের চার শতাধিক রুটে নতুন ভাড়ার তালিকা তৈরির প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নতুন ভাড়ায় যানবাহন চালানো হবে।
করোনাকালে বাস ভাড়া যদি এভাবে বাড়ানো হয় তবে সেটা কতোটুকু মানবিক হবে তাই ভাববার বিষয়। আমি মনে করি এ ধরনের সুপারিশ আক্ষরিক অর্থেই অবাস্তব এবং অগ্রহণযোগ্য। এমন পরিস্থিতিতে বাসের ভাড়া বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে যে কঠিন প্রভাব পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা ঠিক যে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই বলে এর জন্য এক লাফে ৮০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া কতোটুকু সমীচীন? করোনার বিপর্যয়ে জনসাধারণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকের আয় কমে গেছে। কারও কারও চাকরির নিশ্চয়তা নেই, মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না। কাজেই, বাস মালিকদের ক্ষতির দায় সাধারণ যাত্রীরা কোনভাবেই নিতে পারেন না।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশে তেলের দাম কমালে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর দরকার হয় না। বাংলাদেশ রেলওয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ট্রেনে ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখছে। কিন্তু ভাড়া বাড়ায়নি। একইভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার শর্ত মেনে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলও শুরু হচ্ছে রোববার থেকে। নৌযান মালিকরাও ভাড়া বাড়াচ্ছেন না। অথচ বাস মালিকরা করোনার বিপর্যয়কে কাজে লাগিয়ে এক লাফে ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন। বিষয়টি দুঃখজনক।
সরকার সব সচল করতে চাইছে জীবিকার জন্য। তাই গণপরিবহন সীমিত আকারে চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অথচ যে যুক্তিতে সড়ক পরিবহনের অন্যতম বাহন বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, সেটি কি আসলে মানা হবে? স্বাভাবিক সময়ে তো বাসে টেনে হেচরে যাত্রী তোলা হয়। এ বাস্তবতায় সামাজিক দূরত্ব মানা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সে উদ্দেশ্যও মালিক-শ্রমিকদের অসহযোগিতার কারণেই ব্যাহত হতে পারে।
তাছাড়া বাংলাদেশে কোনো জিনিসের দাম একবার বাড়লে তা আর পুরনো মূল্যে ফেরত আসেনা। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়কের আমলে ১০ টাকার চাল যে বেড়ে গিয়ে ৪০ টাকা হলো তা বেড়েছে বৈ আর কমেনি। তাই করোনার ছুতায় এবার ভাড়া বাড়ানো তা যে পূর্বের মূল্যে ফিরে যাবে সে গ্যারান্টি কে দেবে? ইতোপূর্বে যে কোন সংকটে বা অজুহাতে দেশে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ালে তা স্বাভাবিক সময়েও কমানোর কোন নজির নেই। তাই সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় পরিবহন মালিকদের দাবির মুখে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই যে বাড়তি ভাড়ার বোঝা যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তা মোটেও সঠিক নয়। তাছাড়া ভাড়া বাড়ানোর এ সুপারিশ যদি অনুমোদন হয় তবে পরিবহন মালিকদের একচেটিয়া সব দাবিই মেনে নেয়ার সামিল হবে।
আমরা আশা করব, যাত্রী সাধারণের ঘাড়ে বাড়তি চাপ যেন না পড়ে সেদিকেই গুরুত্ব দেয়া হবে। সড়ক পরিবহন খাতের প্রভাবশালী নেতারা যা দাবি করেন সরকারকে তাই মেনে নিতে দেখা যায়। এবার যেন তা না হয় সেদিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া উচিত।
দেশের বাস মালিক এবং পরিবহন শ্রমিক নেতারা চিরদিনই লুটেরা ছিল, এবং এখনও লুটেরা। তারা শুধু যাত্রীদেরই লুট করে না, তারা তাদের শ্রমিকদেরও লুট করে। গণপরিবহন থেকে দুই হাজার কোটি টাকার চাঁদা তোলার খবর এখন কারও অজানা নয়। অথচ সেই চাদার টাকাও বিপর্যয়ের সময় শ্রমিকরা পাননি। সেই টাকাও লোপাট হয়ে গেছে। চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেলে পরিবহনের ভাড়া নৈরাজ্যসহ সব বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার করোনা পরিস্থিতিতে অন্তত এ কাজটি করে দেখাতে পারে।
করোনা পরিস্থিতিতে পৃথিবীর কোন দেশে বাস ভাড়া বাড়েনি। বরং কমেছে। এর কারণ সেসব দেশে সরকার পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ভর্তুকি দিয়েছে। যুক্তরাজ্য ও ভারতসহ অনেক দেশে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে করোনাকালে। আমি যে দেশে বসবাস করছি এই আয়ারল্যান্ডেও করোনাকালে বাস সেবা চালু রয়েছে। কিন্তু এখানেও বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। অথচ বাস চালকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার খরচ বেড়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বেসরকারি সড়ক পরিবহন খাতে ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দর কমেছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তেলের দাম কমানো হলে গণপরিবহনের ভাড়া বাবদ যাত্রীদের কাছ থেকে এত বেশি অর্থ আদায়ের দরকার পড়বে না। বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে।
একজন বাস মালিকের পয়সার অভাব নেই। তার ব্যবসায় লাভের হারটা তুলনামূলক ভাবে কিছুটা কম হলেও কিছু যায় আসে না। এ জন্য তাকে না খেয়ে মরতে হবেনা। কিন্তু যারা বাস যাত্রী তাদের অনেকেই নিম্ন আয়ের মানুষ। কেউ অনাহারে, অর্ধাহারে কিংবা না খেয়ে থাকে।
তাদের দিকেই আমাদের বেশি সদয় হওয়া উচিত। সব সময়ের মতো এবারও বাস মালিকদের দাবি দাওয়া মেনে নেওয়া মানে তেলা মাথায় তেল দেয়া। তাই সরকারকে বলবো, একটু কঠিন হোন। তেলা মাথায় আর তেল নয়।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও কলামিসট
shajed70@yahoo.com