জিহ্বা শরীরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের একটি, যা অত্যন্ত কোমল ও সংবেদনশীল। জিহ্বা দ্বারা অনেক কাজই সম্পাদিত হয়, শুধু একটা অকাজ ছাড়া। এখানে সেই অকাজটাই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। এই অকাজটা মোটামুটি সবারই প্রিয়। যা আমরা করতে অনেকেই পছন্দ করি। যেটা করা পুরাপুরিই নিষিদ্ধ, কিন্তু স্বভাবজাতভাবে নিষিদ্ধ কাজের প্রতিই আমাদের আকর্ষণ বেশী থাকে। যে অকাজটা ভালো তো না ই, বরঞ্চ সর্বদা খারাপই বয়ে নিয়ে আসে, বিভেধ তৈরি করে মানুষে মানুষে, দ্বন্দ্ব বাড়ায় পরিবারে, সমাজে, বন্ধুমহলে। তারপরেও ওই অকাজটা আমরা হরহামেশাই করে থাকি। অকাজটার অনেক নাম থাকলেও কাজ একই। পরনিন্দা, পরচর্চা, গীবত, স্লান্ডারিং, ব্যকবাইটিং অনেক নামই আছে, যেগুলা ওই জিহ্বার দ্বারাই সংঘটিত। যা বর্তমানে একটি সামাজিক ব্যধিতে পরিণত হয়েছে।
জিহ্বার গুরুত্ব বোঝাতে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, ”যে ব্যাক্তি আমার জন্য তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের জিম্মিদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মিদার হব।” তিনি আরো বলেছেন, ”মানুষ যখন ভোরে ঘুম থেকে উঠে শরীরের সব অঙ্গ জিহ্বার কাছে অনুরোধ করে যে, তুমি যদি আমাদের ব্যপারে আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহর নাফরমানি কাজে পরিচালিত না কর, তুমি যদি ঠিক থাক তবে আমরা ঠিক থাকব, আর তুমি যদি বেঁকে যাও তাহলে আমরাও বেঁকে যাব।” আল্লাহ সরাসরি গীবত করাকে নিষিদ্ধ করেছেন, গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া জঘন্য কাজ বলেই গীবত কে এর সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ; পরচর্চার ভয়াবহতা বিবেচনা করেই একে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছেন।
গীবত বা পরনিন্দা কি? মোদ্দা কথা হল, একজনের দোষ তার অনুপুস্থিতিতে আরেকজনকে বলাই গীবত। আরো সহজভাবে যদি বলি, আপনার অবর্তমানে কেউ আপনার ব্যাপারে যে রকমের কথা বললে আপনি পছন্দ করবেন না, সে রকম কথাটাই কারো অনুপস্থিতিতে কারো নামে বলাই হচ্ছে গীবত। অনেক উচ্চপর্যায়ের পরনিন্দাকারী আছে যারা অন্যের দোষ তো বলে বেড়ায়ই এবং বরঞ্চ আরেকজনের দোষ অনুসন্ধান করে কুৎসা রটিয়ে কুৎসিত আনন্দ নিয়ে থাকে। এরা আরো বেশী ভয়ংকর। ইমাম গাযযালী (রা.) বলেছেন, ”অন্যের দেহ, বংশ, বসন-ভূষণ, ভাবভঙ্গি, ক্রিয়াকলাপ, কথোপকথন ও গৃহের কোনো দোষ বের করে কিছু বললেই তা গীবত বলে আখ্যায়িত হয়।
”ইসলামে গীবত শোনাটাও পাপ হিসেবে গণ্য হয়। রাসূল (স.) বলেছেন , ‘পরনিন্দা ব্যভিচারের চেয়েও ঘৃণ্য ও জঘন্যতম। পরনিন্দাকারী এবং পরনিন্দা শ্রবণকারী উভয়ই সমান অপরাধী’। কারণ কারো কাছে গীবত শুনলে গীবতকারী গীবত করাতে আরও বেশী উৎসাহী হয়ে উঠে। একটু খেয়াল করলেই আমরা নিজেরাও এর বাস্তব প্রমাণ পরিলক্ষিত করব। পরনিন্দা করা ও শোনা আমাদের আসলেই অনেক পছন্দের। কেউ কারো দোষ বলতে থাকলে আমরা যত উৎসাহ সহকারে শুনি, কিন্তু প্রশংসা ততটা উৎসাহ নিয়ে শুনিনা। বরঞ্চ কারো কাছে অন্যের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করিনা, যতটা পরচর্চা শুনতে পছন্দ করি। কেউ কারো দোষ বলা শুরু করলে, তাকে বাহবা দিয়ে, হাতে তালি দিয়ে, অট্টহাসি দিয়ে, পারলে নিজে কিছু যোগ করে, ইনিয়ে বিনিয়ে, রসিয়ে রসিয়ে, কখনো গলা খাঁকারি দিয়ে, কখনো সুর করে, কখনো মোলায়েম স্বরে, কখনো বা কর্কশ স্বরে অন্যের দোষ বর্ণনায় সমর্থন জানিয়ে থাকি। অথচ যার পেছনে যার বিরুদ্ধে এত দোষ বর্ণনায় মত্ত তার সামনে ওই মানুষগুলাই দেখা গেলো তার পরম বন্ধু সেজে বসে আছে। অথচ পেছনে কি কুৎসিত।
গীবত অনেকভাবেই হতে পারে। এমন কি আকারে ইঙ্গিতে বা ইশারায় কাউকে হেয় করাও গীবতের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আয়েশা (রা) হাতের ইশারায় এক মহিলাকে খর্বাকৃতি বলে বোঝানের চেষ্টা করলে মুহাম্মদ (স) সাথে সাথে তাকে বললেন, এটা তার গীবত করা হল। কারণ কেউ যদি বুঝতে পারে যে কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু দোষ বর্ণনা করা হল তাই গীবত। তা মুখে, ইশারা-ইঙ্গিতে বা অঙ্গভঙ্গি যেভাবেই হোক না কেনো। কারো ভুল ত্রুটি নিয়ে কথা বলাও গীবত। যেমন অমুকে হাঁটতে পারেনা, অমুকের নামাজ পড়ার নিয়ম ভালো না, তমুকে নামাজ পড়ে না, কারো অসাক্ষাতে এসব বলাও গীবত। কেউ কিছু ভুল করলে সরাসরি তাকে বলাই শ্রেয়। একবার শেখ শাদী (র) তার পিতাকে কিছু লোকের ব্যাপারে বললেন যে, ওই লোকগুলা তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ে ঘুমালে কতই না ভালো হত। এ কথা শুনে তার পিতা বললেন, তাহাজ্জুত না পড়ে তুমিও ঘুমিয়ে থাকলে ভাল হত, তাহলে গীবত করার মত পাপ তোমার ঘাড়ে চাপত না।
গীবত কেনো করি? গীবত করার মূল কারণ অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করা, মানুষের মাঝে বিভেদ তৈরি করা। অন্যের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাবের কারণেও গীবত করে থাকি। নিজেকে বড় করা, আত্মপূজা, আত্মপ্রীতি যখন বেড়ে যায় তখনই আমরা পরচর্চায় মেতে উঠি। হিংসা, বিদ্বেষ, আমিত্ব, অহংকার এসবই অন্যের প্রতি কুধারনার সৃষ্টি করে। অন্যকে অপমান করতে ও অপমানিত হতে দেখলে একধরনের কুৎসিত আনন্দ উপভোগ করে থাকি। অন্যের দোষ খুঁজে পেলে সন্তানলাভের মত সুখানুভব করি। তা না হলে কেনো গীবতটা এত পছন্দের হবে আমাদের? যা কিনা অশান্তিই তৈরি করে।
- পরিত্রাণের উপায় কি? উপায় অবশ্যই আছে। গীবত না করলে আমরা কেউই মারা যাবনা, বরঞ্চ অনেক সমস্যার সমাধান এর পরিত্যাগের মাধ্যমে সম্ভব। নিম্নল্লিখিত উপায়গুলা অনুসরণ করলে আমরা সফল হতে পারি।
- – অন্যের দোষ জানলেও তা গোপন রাখার চেষ্টা করতে হবে।
- – অপরের খারাপ গুন না বলে বেশী বেশী ভালো গুন বা প্রশংসা করতে পারি।
- – অন্যের দোষ বা খারাপ গুনগুলো তার সম্মুখেই বলা শ্রেয়, তাহলে সে নিজেকে শুধরিয়ে নিতে পারবে।
- – কেউ কারো নামে গীবত করলে তার প্রতিবাদ করতে হবে, অথবা তাকে তা না বলতে অনুরোধ করতে হবে, অথবা কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে হবে অথবা ওই জায়গা ত্যাগ করতে হবে, কোনটাই না পারলে গীবতকারীর কথায় অনীহা প্রকাশ করা ও চুপ থেকে মনে মনে এর ঘৃণা করতে হবে।
- – গীবতকারীর কথায় সমর্থন ও উৎসাহ দেয়া যাবেনা, তাহলে ওই কাজে তার উৎসাহ আরো বেড়ে যাবে।
- – অপরকে সন্মান দিতে শিখতে হবে, নিজেকে ছোট রেখে অপরকে বড় রাখার মানসিকতা রাখতে হবে।
- – সবারই কিছু না কিছু দুর্বল জায়গা থাকতেই পারে, কারো দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- – অনেকসময় আমরা শুধু নিছক সন্দেহ থেকেই কুৎসা রটিয়ে থাকি। এই অহেতুক সন্দেহবাতিক থাকা ঠিক নয়।
- – নিজেদের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, আত্মমহিমা, আত্মগরিমা, আত্মহংকার, আত্মপূজা, পরশ্রীকাতরতা দূর করতে হবে মহানবী (সঃ) বলেছিলেন, ”প্রকৃত মুসলিম সে-ই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে এবং প্রকৃত মুহাজির সে-ই, যে আল্লাহ্ তা’আলার নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করে”।
- তবে হ্যাঁ, কারো ব্যাপারে কাউকে সতর্ক করা যায়। যেমন কোনো ব্যক্তি ক্ষতিকারক হলে, বা অন্য গীবতকারীর ব্যপারে সতর্ক করা ঠিক আছে। তবে শুধু সতর্ক করার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
- শেষ কথা হল, মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে বাস করাই মানুষের বৈশিষ্ট। কেউই ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়, পারতপক্ষে আমরা মানুষ। যে কাজ করলে আমাদের মধ্যে সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ দূর করে; তৈরি করে ক্লেদ, ক্লেশ, প্রতিহিংসা, শত্রুতা তা কেন আমরা করতে যাব? ধর্মীয় আদেশ বা উপদেশ বাদ দিলেও আমরা যদি গীবত এর কুফল আর এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো বুঝতে পারি তাহলেও আমাদের মধ্যে সচেতনতা আসা উচিত। ধর্মীয় রেফারেন্সগুলা এইজন্যই আনা হয়েছে যে, আমি বিশ্বাস করি যে, ইসলাম আমাদের সে জিনিসই করতে বলছে যা আমাদের জন্য ভালো, আর তাই করতে নিষেধ করেছে যে আমাদের জন্য পারতপক্ষে খারাপ। যার প্রমাণ আমরা বাস্তব জীবনেও পরিলক্ষিত করে থাকি, পরকাল তো পরের ব্যাপার। আমরা সবাই সবার ভ্রাতা, ভগ্নি, বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশী। আমরাই পারি এই পৃথিবীকে স্বর্গ বানাতে, আবার আমরাই পারি নরক বানাতে। সিদ্ধান্ত আপনার।