গীবত কি? কোরআন ও হাদিসের আলোকে গীবতের ব্যাখ্যা

0
33680
Backbiting

খন্দকার মহিউদ্দিন অপু :

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “গীবত কী তা কি তোমরা জান?” লোকেরা উত্তরে বলল, “আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভাল জানেন।” রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “গীবত হলো তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলা যা সে অপছন্দ করে।” জিজ্ঞাসা করা হলো, “আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তবে এটাও কি গীবত হবে?” রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তুমি যা বল তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলেই সেটা হবে গীবত, আর তুমি যা বল তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে সেটা হবে বুহতান বা মিথ্যা অপবাদ।” (মিশকাতঃ পৃ-৪১২)সাহাবি আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, গীবত কাকে বলে, তোমরা জান কি? সাহাবিগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -ই ভালো জানেন। তিনি বললেন, তোমার কোনো ভাই (দীনি) সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গীবত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যে দোষের কথা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তাহলেও কি গীবত হবে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি যে দোষের কথা বল, তা যদি তোমার ভাইয়ের থাকে তবে তুমি অবশ্যই তার গীবত করলে আর তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছ।

(মুসলিম)গীবতের সবচেয়ে উত্তম ও বাস্তবসম্মত সংজ্ঞা দিয়েছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিম্মোক্ত হাদিস থেকে পেতে পারি।হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে দেখা যায় তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করে, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গীবত কী? তিনি বলেন, তোমার ভাই সম্মর্কে তার অনুপস্থি তে এমন কিছু বলা যা শুনলে সেব্যথিত হয়। তখন বলা হলো, আমি যে কথা বলি, তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলেও কি গীবত হবে? নবী করীম সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তুমি যা বলেছ তা যদি তার মধ্যে থাকে, তুমি তার গীবত করলে; আর সে দোষ যদি তার মধ্যেনা থাকে তবে তো তুমি তার ওপর বুহতান বা মিথ্যা দোষারোপ করলে, যা গীবত থেকে অধিক দোষনীয়।[মুসলিম/৬৩৫৭-আবূ হুরাইরা (রাঃ), বুখারী/৫৬১৩, আবূ দাঊদ/১৭৯৯]মহানবী (সা.) বলেন, ‘‘প্রত্যেক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের জীবন, সম্পদ ও ইজ্জত আব্রুতে হস্তক্ষেপ করা হারাম।’’উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, কারো গীবত করো না। আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে এক নারী সম্পর্কে বললাম যে, তার কাপড়ের আচঁল খুব লম্বা। মহানবী (সা.) বলেন, তুমি থুথু ফেলো। আমি থুথু ফেললে মুখ থেকে এক টুকরা গোশত বেরিয়ে আসে।

গবিত কী? বা গীবত অর্থঃ  গীবত আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ পরনিন্দা, দোষারোপ করা, অনুপস্থিত থাকা, পরোক্ষে নিন্দা, পরচর্চা করা, কুৎসা রটনা করা, পিছনে সমালোচনা করা। অন্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা, কুৎসা রটনা করা, পিছে সমালোচনা করা ইত্যাদি।শরীয়তের পরিভাষায় গীবত বলতে বুঝায় কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কথা বালা যা শুনলে সে তা অপছন্দ করবে।গীবত করার মাধ্যম (চোখের ইশারায়, অঙ্গভঙ্গিতে, শ্রবণে ও লিখনে গীবত):পরনিন্দা কেবল মুখের বাক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং চোখের ইশারায়, অঙ্গভঙ্গিতে, শ্রবণে ও লিখনের দ্বারাও গীবত হয়ে থাকে। সর্বপ্রকার গীবতই হারাম। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) বলেন, একদিন আমি হাতের ইশারায় এক স্ত্রীলোককে খর্বাকৃতি বললে’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, হে আয়েশা। তুমি গীবত করেছ, থুথু ফেলো। তৎক্ষণাৎ আমি থুথু ফেলে দেখলাম তা কালো বর্ণের জমাট রক্ত। এরূপে কোনো খোঁড়া কিংবা টেরা চক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তির অবস্থা অনুকরণ করার জন্য খুঁড়িয়ে হেঁটে কিংবা চক্ষু টেরা করে চাইলে তার গীবত করা হলো; তবে কারো নাম উল্লেখ না করলে এতে গীবত হয় না। কিন্তু উপস্থিত লোকেরা যদি বুঝতে পারে যে অমুক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে তবে তা গীবত বলে গণ্য এবং হারাম হবে।ইবাদতের ত্রুটি-বিচ্যুতির উল্লেখপূর্বক সমালোচনা করাও গীবতের অন্তর্ভুক্তঃ যেমন অমুক ব্যক্তি উত্তম রূপে নামাজ পড়ে না অথবা রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে না অথবা নফল নামাজ পড়ে না অথবা রমজানের সবগুলো রোজা রাখে না অথবা মাকরুহ্ ওয়াক্তে নামাজ পড়ে। তাহাজ্জুদের ওয়াক্তে কতক ঘুমিয়ে থাকলে শেখ সা’দী (রা.) তাদের সমালোচনা করেন এবং বলেন, এই লোকগুলো যদি তাহাজ্জুদ পড়তো তবে কতই না ভাল হত। সা’দীর পিতা একথা শুনে বলেন, কতই না ভাল হত যদি তুমি তাহাজ্জুদ না পড়ে এদের মত ঘুমিয়ে থাকতে। তাহলে এদের গীবত করার পাপ তোমার ঘাড়ে চাপত না।

কোন ব্যক্তি অভিনয়ের মাধ্যমে অপর ব্যক্তির দোষ ত্রুটির প্রতি ইঙ্গিত করলে তাও গীবতের অন্তর্ভূক্ত।গীবত করার কারণ বা মানুষ যে সব ক্ষেত্রে গীবত করে থাকেঃমানুষ সব সময় নিজেকে বড় করে দেখে, এই আমিত্বের আরেক নাম আত্মপূজা। এটা শুরু হয়ে গেলে আত্মপ্রীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন তার আত্মত্যাগের মতো মহৎ বৈশিষ্ট্য দূরিভূত হতে থাকে। ফলে এ স্থানে দানা বাঁধে হিংসা-বিদ্বেষ। আবার হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই অপরের প্রতি কুধারণার সৃষ্টি হয়, যা মানুষকে গীবত করতে বাধ্য করে। সুতরাং আত্মপূজা, আত্মপ্রীতি, হিংসা-বিদ্বেষ, কুধারণাই মানুষকে গীবত করতে বাধ্য করে।

ইমাম গায্‌যালী তার রচিত কিতাব কিমিয়ায়ে সা’আদাত গ্রহন্থে ৮টি কারনের কথা উল্লেখ করেছেন-1. ক্রদ্ধ হওয়া।2. অপরের মনতুষ্টি কামানায়।3. নিজের দোষ অপরের ঘাড়ে চাপানোর প্রবনতায়।4. আত্ম প্রশংসার স্পৃহা।5. ঈর্ষা পরায়ন হয়ে।6. হাসি-বিদ্রুপ।7. অসাবধনাতয়। যেমন কানা বাবু, তোতলা কাশেম ইত্যাদি।8. আত্মাভিমান।

গীবতকারী ও গীবত শ্রবণকারী উভয়ই সমান অপরাধে অপরাধী:এক সফরে হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমার (রা.) -র সাথে এক দরিদ্র খাদেম ছিল, সে সবসময় তাদের খেদমত করত। গন্তব্যে পৌঁছে তারা উভয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণ পর সেও ঘুমিয়ে পড়লো তাদের উভয়ের জন্য খাবার তৈরি না করে। তাঁরা উভয়ে জাগ্রত হয়ে বলতে লাগলেন, এই লোকটা খুব ঘুমায়। তারা তাকে ঘুম থেকে তুলে মহানবী (সা.) -এর নিকট পাঠালেন। সে তার নিকট আবেদন করল, হে আল্লাহর রাসূল! হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমার (রা.) আপনাকে সালাম পাঠিয়েছেন এবং কিছু খাবার চেয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তারা উভয়ে আহার করেছে এবং তৃপ্ত হয়েছে। তাঁরা উভয়ে তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আজ কি খেয়েছি? তিনি বলেন, তোমরা আজ ঐ খাদেমের গোশত খেয়েছ (গিবত করেছ) এবং আমি তোমাদের দাঁতে গোশতের রং দেখতে পাচ্ছি। তাঁরা উভয়ে এ কথা শুনে বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের ত্রুটি মাফ করুন এবং আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, আল্লাহর ক্ষমাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট হবে না, খাদেম যেন তোমাদের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে। (দিয়া আল-মুকাদ্দাসীর বরাতে আদদুররুল মানছুরে, কিমিয়ায়ে শাআদাত)।

হাদিস খানা সহি কিনা জানাযায় নিগীবত শুনে আনন্দিত হওয়াও গীবতের মধ্যে গণ্যঃকারণ আনন্দ প্রকাশ করলে গীবতকারী খুশি হয় এবং আরও গীবতে লিপ্ত হয়। মোট কথা, কারো গীবত শোনা এবং তা বিশ্বাস করাও গীবতের পর্যায়ে গণ্য, বরং যে নীরবে গীবত শুনতে থাকে সেও গীবতে অংশগ্রহণ করে। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘‘গবীত শ্রবণকারীও গীবতকারীদের একজন।’’ (তারাবানী)ইচ্ছাকৃতভাবে গীবত শোনা নিজে গীবত করার মতোই অপরাধ। হাদিসে আছে, সাহাবি মায়মুন রাঃ বলেন, ‘একদিন স্বপ্নে দেখলাম এক সঙ্গী ব্যক্তির মৃতদেহ পড়ে আছে এবং এক ব্যক্তি আমাকে তা ভক্ষণ করতে বলছে। আমি বললাম, আমি একে কেন ভক্ষণ করব? সে বলল, কারণ তুমি অমুক ব্যক্তির সঙ্গী গোলামের গীবত করেছ। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি তো তার সম্পর্কে কখনো কোনো ভালোমন্দ কথা বলিনি। সে বলল, হ্যাঁ, এ কথা ঠিক। কিন্তু তুমি তার গীবত শুনেছ এবং সম্মত রয়েছ।’ এ হাদিসখানার রেফারেন্স সংগ্রহ করতে হবেএতে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয় যে, গীবতকারী ও গীবত শ্রবণকারী উভয়ই সমান অপরাধে অপরাধী।

বেঁচে থাকার উপায়গীবত থেকে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি। এ থেকে বাঁচার প্রথম উপায় হচ্ছে অপরের কল্যাণ কামনা করা। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দীন হচ্ছে নিছক কল্যাণ কামনা করা।’দ্বিতীয়ত, আত্মত্যাগ অর্থাৎ যেকোনো প্রয়োজনে অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দেয়া। যেমন আল্লাহ সূরা হাশরের ৯ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন, ‘তারা নিজের ওপর অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা অনটনের মধ্যে থাকে।’তৃতীয়ত, অপরের অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া।চতুর্থত, মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী বেশি বেশি করে অধ্যয়ন করা।পঞ্চমত, কাউকে গীবত করতে শুনলে তার অনুপস্থিত ভাইয়ের পক্ষ থেকে তাকে বাধা দিতে হবে সাধ্যমতো, যদি বাধা দেয়া সম্ভব না হয় তবে মনে মনে ঘৃণা করতে হবে। সম্ভব হলে গীবতের মজলিস ত্যাগ করতে হবে অথবা গবিতকারীকে ভিন্ন প্রসঙ্গে মশগুল করার চেষ্টা করতে হবে। এরূপ কোন চেষ্টা না করলে অবশ্যই গুনাহ্গার হতে হবে।শষ্ঠত: আর কারো মধ্যে গীবত শোনার আগ্রহ লক্ষ্য করা গেলে তা মোনাফেকী স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। আন্তরিকভাবে গীবতকে খারাপ জানলে এবং যথাসাধ্য তাতে বাধা দিলেই কেবল গীবতের গুনাহ্ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

গীবতের পরিণামঃ1. গীবত ইসলামি শরিয়তে হারাম ও কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা অগ্র-পশ্চাতে দোষ বলে বেড়ায়।’ (সূরা হুমাজাহ-১)2. কেয়ামতের দিন নিজের মুখ নিজের নখ দ্বারা জখম করবে: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মিরাজের সময় আমাকে এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো যাদের নখ ছিল তামার। তারা তাদের মুখমণ্ডল ও দেহ আঁচড়াচ্ছিল। আমি জিবরীল আঃ-কে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা নিজ ভাইদের গীবত করত ও ইজ্জতহানি করত। (মাজহারি) হযরত আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘‘মি’রাজের রাতে আমি এমন একদল লোককে অতিক্রম করলাম যারা নিজেদের নখ দ্বারা নিজেদের মুখমন্ডল ক্ষতবিক্ষত করছিল। আমি জিবরাঈল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বলেন, এসব লোক গীবত করতো এবং মানুষের ইজ্জত আব্রু নিয়ে টানাটানি করতো।3. গীবত ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক: হাদীস শরীফে গীবতকে ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক গুনাহ বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: গীবত ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক গুনাহ। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, এটা কিরূপে? তিনি বললেন, এক ব্যক্তিব্যভিচার করার পর খাঁটি তওবা করলে তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়, কিন্তু যে গীবত করে তার গুনাহ গীবতকৃত ব্যক্তি মাফ নাকরা পর্যন্ত মাফ হয় না। হাদীসটি হযরত আবু সায়ীদ (রাঃ) ও জাবের (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হল,গীবতের মাধ্যমে আল্লহতায়ালার হক ও বান্দার হক উভয়ই নষ্ট করা হয়। (তাফসীরে মা’আরেফুল কুরআন)4. কবর আযাব হবে: হযরত জাবির (রা.) বলেন, আমরা মহানবী (সা.) এর সাথে সফরে ছিলাম। তিনি দু’টি কবরের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং কবরের বাসিন্দাদ্বয়কে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। মহানবী (সা.) বলেনঃ তারা দু’জন খুব মারাত্মক কোন গোনাহ করেনি, অথচ তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তাদের একজন মানুষের গীবত করত এবং অপরজন পেশাব করে উত্তমরূপে পবিত্র হত না। অতপর তিনি গাছের দু’টি তাজা ডাল চেয়ে নিয়ে তা দু’ভাগ করে দু’জনের কবরের পাশে গেড়ে দেন এবং বলেন, ডাল দুটি যতক্ষণ তরতাজা থাকবে ততক্ষণ তাদের হাল্কা শাস্তি হবে।         (ইবনে আবিদ দুন্য়া)5. কোন ব্যক্তিকে তার গুনাহের কারণে অপদস্ত করা এবং তাকে জাহান্নামী মনে করা আল্লাহ তায়ালার মর্জি বিরোধী কাজ। বরং যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে অপমান করে আল্লাহ তা’য়ালা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন এবং তাকে অপমান করেন, অন্যদিকে যাকে অপমান করা হলো তার গুনাহ্ মাফ করে দেন। বনী ইসরাঈলের দুই ব্যক্তির ঘটনা এভাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, তাদের একজন সর্বদা ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতো এবং অপরজন পাপাচারে লিপ্ত থাকতো। ইবাদতে লিপ্ত ব্যক্তি সব সময় পাপাচারীকে হেয় প্রতিপন্ন করতো। একদিন সে চটে গিয়ে বলল, আল্লাহর শপথ! তুমি জাহান্নামে যাবে। কথাটি আল্লাহ্ পাকের অপছন্দ হলো এবং ইবাদতে লিপ্ত ব্যক্তিকে জাহান্নামী এবং পাপীকে জান্নাতী বানিয়ে দিলেন (আবু দাউদ, কিতাবুল বিররি (ওয়াস-মিলাহ)।6. কিয়ামতের দিন সৃষ্টিকুলের সামনে অপমানিত হবে: মহানবী (সা.) বলেন, ‘‘কারো উপস্থিতিতে কোন মুমিন ব্যক্তিকে অপমান করা হলো এবং উপস্থিত ব্যক্তি তাকে সাহায্য করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সাহায্য করল না, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্তায়ালা তাকে সৃষ্টিকুলের সামনে অপমানিত করবেন।’’ (আেহ্‌মেদ, তাবারানী)গীবত না করার সুফলঃ1. যে ব্যক্তি তার (মুসলিম) ভাইয়ের অনুপস্থিতে তার ইজ্জত রক্ষায় সহায়তা করলো, আল্লাহ্তা’য়ালা কিয়ামতের দিন তার ইজ্জত রক্ষায় সহায়তা করবেন।’’(ইবনে আবিদ দুন্য়া)।2. ‘‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুপস্থিতে তার ইজ্জত রক্ষায় সহায়তা করল, তাকে দোযখ থেকে নিষ্কৃতি দেয়া আল্লাহ্তা’য়ালার কর্তব্য হয়ে যায়।’’(আহমদ, তাবারানী)3. মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘কেউ খারাপ কাজ করে বসলো অথবা নিজের উপর জুলুম করলো, অত:পর আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে সে আল্লাহ্কে ক্ষমাকারী ও দয়াকারী হিসাবেই পাবে।’’(সূরা নিসা : ১১০)

যাদের দোষ বর্ণনা করা যায় অথবা গীবতের বৈধ ক্ষেত্র সমূহঃগীবত নিঃসন্দেহে হারাম। তারপরও যাদের দোষ বর্ণনা করা যায় তা হচ্ছে1. কারো সাক্ষাতে তাকে সংশোধনের উদ্দেশ্যে তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা যাবে।2. কারো অগোচরে তাকে সংশোধনের নিমিত্তে কয়েকজন মিলে পরামর্শকালে তার কোন দোষ আলোচনা হলে তাতে কোন অপরাধ হবে না। তবে লোক সমাজে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে হলে সম্পূর্ণ হারাম।3. কোনো অত্যাচারীর অত্যাচারের কাহিনী প্রতিকারের আশায় বর্ণনা করা।4. খোদাদ্রোহী, ধোকাবাজ, যালিম শরষক।5. বেদায়াতী ও দ্বীনের ক্ষতিকারী কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার দোষ-ত্রুটি আলোচনা করে লোকদের সতর্ক করা কোন দোষের ব্যাপার নয়।6. সন্তান ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে তার পিতা ও স্বামীর কাছে অভিযোগ করা।7. বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে যদি কেউ পরামর্শ চায় তবে ছেলে-মেয়ের দোষ-ত্রুটি জানা থাকলে তাকে বলতে হবে এ ক্ষেত্রেও কোন পাপ হবে না। বরং ছেলে-মেয়ের শরীয়াত সমর্থিত কোন দোষ গোপন করা পাপ।8. ফতোয়া গ্রহণ করার জন্য ঘটনার বিবরণ দেয়া ও – প্রয়োজন ও উপযোগিতার কারণে কারো দোষ বর্ণনা করা জরুরি।9. কোন মুনাফিক, ফাসিক অথবা মুরতাদের নিন্দা করা জায়েয।10. আবার যাদের স্বভাব গীবত করা তাদের সম্পর্কে অন্যদের সাবধান করার জন্য তার দোষ বর্ণনা করা জায়েজ। যেমন উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা এক ব্যক্তি (মাখরামা ইবনে নওফেল) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তখন তিনি বললেন, তাকে আসার অনুমতি দাও, সে গোত্রের কতই না নিকৃষ্ট লোক। অতঃপর তিনি তার সাথে প্রশস্ত চেহারায় তাকালেন এবং হাসিমুখে কথা বললেন। অতঃপর লোকটি চলে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তার সম্পর্কে এমন কথা বলেছেন, অতঃপর আপনিই প্রশস্ত চেহারায় তার প্রতি তাকালেন এবং হাসিমুখে কথা বললেন। এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আয়েশা, তুমি কি কখনো আমাকে অশ্লীলভাষী পেয়েছ ? নিশ্চয়ই কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালার কাছে মর্যাদার দিক দিয়ে সর্বাধিক নিকৃষ্ট সেই লোক হবে, যাকে মানুষ তার অনিষ্টের ভয়ে ত্যাগ করেছে। (বুখারি, মুসলিম)

গীবত করার পরে করণীয়ঃযার গীবত করা হয়েছে যদি সেই ব্যক্তি জীবিত থাকে এবং সম্ভব হয় তবে তার নিকট মাফ চেয়ে নিতে হবে। আর যদি সে জীবিত না থাকে কিংবা সে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে তবে তার গুনাহ্ মাপের জন্য আল্লাহ্র নিকট দু’আ করতে হবে এবং নিজের জন্যও দুয়া করতে হবে।
শিক্ষাঃ1. গীবত করা কবীরাহ গুনাহ2. পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়।3. সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।4. পরকালে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।শেষ কথা সুতরাং মানব সমাজের এই পার্থক্য সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার নিমিত্তেই। যেসব কারণে সমাজের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়, সমাজ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়, সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়, পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো গীবত, যা মানুষকে নিকৃষ্টতম প্রাণীতে পরিণত করে। তাই তো মহান আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে এই নিকৃষ্ট স্বভাব থেকে বিরত থাকার তাগিদ দিয়েছেন।আমাদের সব সময় আল্লাহতায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে তিনি যেন অনুগ্রহ করে গীবতের মতো জঘন্য সামাজিক ব্যাধিতে আমাদের নিমজ্জিত হতে না দেন। এ ক্ষেত্রে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সর্বাগ্রে। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বান্দা যখন ভোরে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয় তখন শরীরের সব অঙ্গ জিহ্বার কাছে আরজ করে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহর নাফরমানি কাজে পরিচালিত করো না। কেননা, তুমি যদি ঠিক থাক, তবে আমরা সঠিক পথে থাকব। কিন্তু যদি তুমি বাঁকা পথে চলো, তবে আমরাও বাঁকা হয়ে যাবো। (তিরমিজি)রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার জন্য তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো।’ (বুখারি)

Facebook Comments Box

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here