মুসলিম মারা গেলে শরীয়তের স্পষ্ট নির্দেশনা হলো বিলম্ব না করে তাকে গোসল দিয়ে কাফন পরানো । অতঃপর জানাযার নামায পড়ে দ্রুত দাফনের ব্যাবস্হা করা । পুরো প্রক্রিয়াটি দ্রুত সম্পাদন সহ মৃত ব্যাক্তির লাশ গম্বীর্যের সহিত কবর স্হান পর্যন্ত নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সর্তকতা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ হাদিসে । এ সংক্রান্ত হাদীস ও আছারের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার রাহ. বলেছেন, জীবিত ব্যক্তি যে সকল বস্ত্ত দ্বারা আরাম বোধ করে মৃত ব্যক্তি তা দ্বারা আরাম বোধ করে। ইবনুল মালাক রাহ. বলেছেন, মৃত ব্যক্তি কষ্টদায়ক বস্ত্ত দ্বারা কষ্ট পায়। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/১৭০)
করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের শেষকৃত্য /দাফন /সৎকার সম্পাদন করা নিয়ে নানা দেশেই বিভিন্ন রকমের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কিন্তুু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে মৃত ব্যাক্তির লাশ দাফনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যে ঘটনা গুলো ঘটছে সে গুলো খুবই দুঃজনক । প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে বিশ্বব্যাপী যে বিপর্যয় নেমে এসেছে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশও এই সক্রমণের বাহিরে নয় । প্রায়শই দেখা যাচ্ছে করোনায় আক্রান্ত মারা যাওয়া ব্যক্তির প্রতি তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ করা হচ্ছে। কেউ কেউ নিজের বৃদ্ধ বাবা-মাকে করোনা রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসছেন বা বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন, যা অত্যন্ত অমানবিক। দেশের ভেতর অনেক জায়গায় মারা যাওয়া ব্যক্তির গোসল, জানাজা, দাফনে সমস্যা তৈরি হবার খবর গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। কোথাও কোথাও নিজেদের এলাকায় কবর দিতেও বাধা দিচ্ছে স্হানীয় জনসাধরণ। কবর স্হানে কাউকে মাটি দেয়া না গেলে তাহাকে কোথায় মাটি দেয়া হবে ? যে কেউ অাক্রান্ত হতে পারেন । তাহলে সে কি মাটি পাবে না ? এই সব প্রশ্ন গুলো নিজেরা একটি বারের জন্য ভেবে দেখছেন না যাহারা দাফন-কাফনে বাঁধা দিচ্ছেন ।অনেকের ধারণা কবর স্হানের ভেতর দিয়ে যাহারা হাঁটাচলা করেন যদি এখানে করোনা ভাইরাসে মারা যাওয়া কাউকে দাফন করা হয় তাহলে তাদের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে ! শুধূমাত্র ভূল ধারণা এবং ভুল প্রচারণার কারণেই এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনাগুলো ঘটেছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে। পার্থিব জীবনের সফর শেষ করে কবরে শায়িত হওয়া প্রত্যেকটি মুসলিমের একটি ধর্মীয় মৌলিক অধিকার । সেই কবরের জন্য একজন মুসলিম মাঠি পাবে না এটা ভাবতে আমার অবাক লাগছে !
এটা সত্য যে, করোনায় মৃত্যুবরণ করা কারো দাফন/শেষকৃত্যে/সৎকারে বেশি মানুষের সমাগম নিরুৎসাহিত করা হয়। সেটি করা হয় পার্সোনাল ডিস্টেন্সিং নিশ্চিত করতে, যাতে শেষকৃত্যে যোগ দিতে এসে অনেক মানুষের জটলায় ভাইরাসটি আরও ছড়িয়ে না পড়ে।
করোনায় মারা যাওয়া ব্যাক্তির লাশ এখন একটি আতংকের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে ! এ রোগে মারা যাওয়া মৃত্য ব্যাক্তিদের দাফনকে অনেকেই পরিবেশের জন্য হুমকি মনে করছেন । সংক্রমণের গুজবে কোথাও করোনা বা উপসর্গ নিয়ে কেউ মারা গেলে দাফনে বাধা দেয়া হচ্ছে। কোথাও আবার স্বজনরাও জানাজায় হাজির হচ্ছেন না। মারা যাওয়া ব্যক্তিকে বহন করতে খাটিয়া দেয়া হচ্ছে না এমন খবরও গণমাধ্যমে উঠে আসছে । রক্তের বাধঁন ছিন্ন করে যিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হচ্ছেন যে সমাধিস্হলে সেখানে এক মুঠো মাঠি দিতে যাচ্ছেন না তার আত্বীয় স্বজন । কি বিচিত্র আমাদের এই পৃথিবী !
করোনা সংক্রমণে মারা যাওয়া মানুষের কি অপরাধ না পাপ ? যে মৃত ব্যাক্তির লাশের কাছে আসতে সবাই ঘৃণা করছেন ? অনেকে হয়তো বলতে পারেন যে সরকারের স্বাস্হ্য বিধি নির্দেশনা মানার জন্য মৃত ব্যাক্তির সংস্পর্শ এড়াতে তাদের এই সমস্ত সতর্কতা । হ্যাঁ !অবশি এ ক্ষেত্রে সকলের সর্তকতা অবলম্বন করে স্বাস্হ্যবিধি মেনে চলা উচিত যাহাতে করে ভাইরাসে সহসাই অন্যরা আক্রান্ত হতে না পারেন । তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সতর্কতা মানার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যাক্তিরা সমাজের কাছে এক ধরণের ঘৃণার বোঝা । ময়লা স্তুুপে আর্বজনা ফেলার মতই তাদেরকে কোন রকম কবরে সমাহিত করা হচ্ছে ।
যে অজুহাতে করোনা সংক্রমণে মৃত্য ব্যাক্তিদের লাশের সাথে অামরা এই ধরণের নির্দয় ও নিষ্টুর আচরণ করছি সেটা কতঠুবু যৌক্তিক ?
বিশিষ্ট চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ থাইল্যান্ডের ডিপার্টমেন্ট অব মেডিকেল সার্ভিসের ডিরেক্টর ড: Somsak Akhalip এর তথ্যমতে ,হোস্ট ( মানব শরীর) মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহের ভেতরে থাকা ভাইরাসের ও মৃত্য ঘঠে । ভাইরাস তখন অার মৃত্য ব্যাক্তির শরীরে বংশবৃদ্ধি করতে পারেনা । বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হা (who)
সর্বশেষ পাওয়া নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে নিশ্চিত করেছে যে করোনা ক্রান্ত লাশের শরীর থেকে ভাইরাস বাতাসে এমনি এমনি ছড়িয়ে পড়ে না! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবেই বলেছে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ থেকে অন্য কেউ করোনায় আক্রান্ত হ্ওয়ার একটি ঘটনাও ঘটেনি।
বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হা, আইইডিসি আর সহ বিশ্বের তাবুড় চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হয়ে বলেছেন যে এই করোনা ভাইরাসটি এয়ারবোর্ণ (বায়ুবাহিত) নয় যে বাতাসে উড়ে উড়ে এদিক-ওদিক যাবে! এটি কেবল সর্দি, কাশির ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়! মৃত ব্যক্তি যেহেতু হাঁচি বা কাশি দিতে পারে না ফলে ড্রপলেট আসার সুযোগও নেই । আর ড্রপলেট না বেরোলে ভাইরাস ছড়াবে কিভাবে ? তাহলে করোনায় মারা যাওয়া ব্যাক্তিদের লাশ দাফনের ক্ষেত্রে কেন এত জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে বাংলাদেশে ? এই দূর্গতির শেষ কোথায় ?
অনেকে হয়তো মনে করেন যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ থেকে পিলপিল করে ভাইরাস বের হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে কি-না ! তবে এ-ব্যাপারে গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন যে সেরকম ভয়ানক কিছু ঘটে না! এ সবই মানুষের মনের দুঃশ্চিন্তা মাত্র। কেউ লাশের গায়ে হাত ছোঁয়ালেই তার হাতে ভাইরাস লেগে যাবে না! অর্থাৎ, চামড়ার ওপর কোনো জীবাণু স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেগে থাকে না বা ঘোরাঘুরি করে না। লাশের নিজে থেকে ভাইরাস ছড়ানোর কোনো সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য জ্বর বা কলেরায় মৃত ব্যক্তির লাশের শরীর থেকে রক্ত অথবা পায়খানা বেরিয়ে শরীর মাখামাখি হয়ে গেলে খালি হাতে তা ছুঁতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছে।
তবে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃতদেহ দাফন/ সৎকার বা শেষকৃত্য সম্পাদনের জন্য একটি নির্দেশিকাও তৈরি করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। গত ২৪ মার্চ নির্দেশিকাটি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ ও প্রচার করেছে। সংস্থার গবেষণা ও নির্দেশিকা অনুযায়ী, সাবধানতা অবলম্বন করে লাশের শরীর স্বাভাবিকভাবেই সাবান-পানি দিয়ে গোসল করানো যায়, কাফনের কাপড় পরানো যায়, প্রিয়জনকে দেখানো যায় এবং গোরস্তানে দাফন বা চিতায় পুড়িয়ে ফেলা যায়। তারা বলেছেন, বৈজ্ঞানিকভাবে নিজের সাবধানতা ছাড়া অযথা ভয়ের কোনো কারণই নেই!
স্বাস্হ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে চলে ইসলামি ফাউন্ডেশন করোনায় মারা যাওয়া ব্যাক্তিদের গোসল ও দাফন সর্ম্পকে ইসলামের বিধান সম্বলিত পরামর্শ অনুসরন করতে বলেছে ।
তাহলে বুঝা যাচ্ছে করোনা ক্রান্ত মৃত ব্যাক্তিদের লাশ দাফনের কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে যে সব সমস্যা গুলো বাংলাদেশে তৈরী হচ্ছে সেই গুলোর পিছনে অন্যতম কারণ হলো গুজব । কেননা বিজ্ঞান এবং ইসলাম দুটিই বলছে করোনায় মারা যাওয়া মৃত্য ব্যাক্তিদের মাঠিতে কবর দিতে কোন ঝুকি নেই ।
টাইম লাইনে আজ একটি ছবি দেখে অনেক্ষন বাকরুদ্ধ ছিলাম । করোনা ক্রান্ত একজন বোনের লাশ বহনের দৃশ্য দেখে নিজের অজান্তে চোখের জল এসে গেলো । নিঃস্বাস আটকে রেখে কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম ছবিটির দিকে থাকিয়ে। ভাবলাম মানু্ষ হিসেবে আজ আমরা কতটা নিষ্টুর ও নির্দয় জাতিতে পরিনত হয়েছি ! ছবিটি না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না আমাদের মানবিক মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে !
ছবিটিতে দেখলাম একজন করোনা সংক্রমণ মেয়ের মৃত লাশ বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে কবর স্হানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দাফনের জন্য । লাশটির সাথে আত্বীয় -স্বজন কিংবা পরিবারের কেউ নেই । সাথে আছেন পিপি ই পড়া দুই জন মানুষ । ঘঠনাটি কোথায় ঘঠেছে তা আমি জানিনা কিন্তুু ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দৃশ্যটি ভাইরাল হচ্ছে প্রচুর । একটু চিন্তা করে দেখুন হতভাগি এই বোনটির জীবনের শেষ বরযাত্রায় এভাবে তাহাকে বাঁশের সাথে ঝুলতে হবে জীবদ্দশায় সে কি কখন ও ভেবেছিলো ? তাই বলতে হচ্ছে মানুষ শুধূ সৃষ্টির সেরা জীব নয় , মানুষ নির্দয় ও নিষ্টুরতার মূর্ত প্রতিক ও বঠে । এই ছবিটি তার প্রমাণ ।
কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হাসরের ময়দানে কঠিন মূহর্তের কথা প্রতিনিয়ত আমরা শুনি বিভিন্ন অালেম -ওলামাদের কাছ থেকে । কথা গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে কেয়ামতের সেই মুসিবতের দিন আমরা আপনজনদের চিনবনা । নিজেদেরকে নিয়ে সবাই ইয়া নসবি ইয়া নসবি করবে। কিন্তুু হাসরে ময়দানে উপস্হিত না হয়ে আজ করোনার কারণে বুঝতে পারছি এই পৃথিবীতে আসলে কেউই কারো আপন নয় ।
পরিশেষে সংগৃহীত একটি গানের দুটি পংক্তির উদ্বৃত্তি দিয়ে আজকের লেখার ইতি টানছি;
“মন কার লাগিয়া কান্দ দিবা রাতি ,
ভেবো দেখো কেউ হবেনা তোমার সঙ্গের সাথী” ।
সৈয়দ আতিকুর রব
অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট
আয়ারল্যান্ড