করোনা ভ্যাকসিন ও আমাদের করনীয়ঃ- ডাক্তার মুসাব্বির হোসাইন

0
921
Dr. Mushabbir Hoassain
Dr. Mushabbir Hoassain

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস দীর্ঘ এক বছর যাবৎ আমাদের মাঝে এক তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে পরিত্রান মিলতে এখনো আমাদের কতটুকু কাঠখোড় পোড়াতে হবে তার কোন সঠিক দিনকাল জানা নাই।

গত এক বছরে সাড়ে সাত কোটির উপর মানুষ আক্রান্ত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করা গেছে এই করোনা ভাইরাসে। এর মধ্যে প্রায় ষোল লাখের উপরে মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এখনো গড়ে প্রতিদিন বিশ্ব্যব্যাপী প্রায় সাত লাখ লোক আক্রান্তের বা এই ভাইরাস পজিটিভের রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা দিন প্রতি দশ থেকে তেরো হাজারের মধ্যে বিরাজ করছে। করোনার প্রথম ছোবলে বিশ্বব্যাপী বহুদেশ প্রতিদিন এক হাজার, দুই হাজার বা প্রায় তিন হাজার করে প্রাণ হারিয়েছিল। আর দ্বিতীয় ছোবলে প্রথম ছোবলের দৈনিক সর্বোচ্চ সংখ্যাকে অতিক্রম করছে। স্বয়ং আমেরিকায় বর্তমানে দিন প্রতি তিন হাজার দুইশত কিংবা তিনশত লোক প্রাণ হারাচ্ছে।

২০১৯ সালের শেষের দিকে সর্ব প্রথম যখন এই ভাইরাস পৃথিবীতে হানা দেয়, তখন থেকে বিশ্বের ছোট বড় ওষুধ কম্পানি ও ল্যাবোরেটরিজগুলো গবেষণায় লেগে যায়। এই ভাইরাসেকে নিরুপন করার জন্য নানা রকম টেস্টিং কীটের আবিষ্কার, প্রস্তুত ও ব্যবহার সফলতার সাথে শুরু হয়। কিন্তু এর প্রতিরোধের জন্য সহসাই কোন ব্যবস্থার দ্বার প্রান্তে পৌঁছাতে পারেনি কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত। কারণ যে কোনো ভ্যাকসিন জনসাধারণের দ্বার গোড়ায় আসতে হলে সেটিকে কমপক্ষে ৬ টি ধাপ পার করে আসতে হয়। এই প্রক্রিয়া শেষ হতে সাধারণত দশ থেকে পনেরো বছর সময় লেগে যায়।

যেহেতু এই ভাইরাস অতীতের অনেক ইনফ্লুয়েঞ্জা ও করোনা ভাইরাসের সাথে প্যাটার্নের দিক থেকে সমপর্যায়ের বা কিছুটা ভিন্ন তাই বিজ্ঞানীগণ অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন তড়িৎ উন্নয়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন।

আয়ারল্যান্ডের টিভি ব্যক্তিত্ব, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র রেজিষ্ট্রার, প্রোটিনকুল্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাঃ মুসাব্বির হোসাইন সম্প্রতি চ্যানেল ২৪ কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই ভ্যাকসিনের উন্নয়ন ও ব্যবহারের উপর নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেন। তিনি জানান নানা জরিপে ও ট্রায়ালে ফাইজার ও বায়োনটেকের ভ্যাকসিন ৯৫% সফল হয়েছে। UK রেগুলেটরি বডি (MHRA), FDA (USA) ও European Medicine Agency (EU) এক যোগে কাজ করে যাচ্ছে এই ভ্যাকসিনের অনুমোদন ও মান নিয়ন্ত্রনের জন্য। গত ১২ই ডিসেম্বরে ফাইজারের ভ্যাকসিন FDA থেকে অনুমতি পায় এবং কানাডিয়ান রেগুলেটরি বডি থেকে অনুমোদন পায় ১০ই ডিসেম্বর। ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি ফাইজারের ভ্যাকসিন অনুমোদনের জন্য জরুরি বৈঠক ডেকেছে ২১শে ডিসেম্বর।

তিনি জানান গত জুন মাস থেকে MHRA ফাইজারের এই ভ্যাকসিনের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে। সেপ্টেম্বরে তারা ফাইজারের ল্যাবরেটরি ভ্রমণ করে আসেন। তাদের ভ্যাকসিনের স্যাম্পলিং নিয়ে নিজস্ব গবেষণাগারে National Laboratory Standerad এ যাচাই বাছাই করেন তারা। এ সময় ৪৮ জন বিজ্ঞানী এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন এবং ২৩শে নভেম্বরে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে এই ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে ৯৫% সফল। ৬৫ বছর বয়সের উর্দ্ধে যারা তাদের ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিন ৯৪% সফল। উল্ল্যেখ্য এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যত মৃত্যু হয়েছে তার ৭৫% মৃত্যু ৭০ বছর বয়সের উর্দ্ধের মানুষের। অতএব এই ভ্যাকসিন নিঃসন্দেহে আমরা বয়োবৃদ্ধদের রক্ষার্থে ব্যবহার করতে পারবো।

তিনি জানান এখনো পর্যন্ত আমরা গর্ভবতী নারী ও শিশুর ব্যাপারে কোন তথ্য পাইনি কারণ এদের উপর এখনো কোন ট্র্যায়াল চালানো হয় নি।

এই ভ্যাকসিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন দুই জন স্বাস্থ্য কর্মীকে দেখা গিয়েছে সামান্য এলার্জিক রিএকশন হতে। সাধারণত কোনো ভ্যাকসিনে প্রতি সাত লাখে এক জনের এলার্জি জনিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে দেখা যায়, তবে ফাইজারের এই ভ্যাকসিন ০.৬% এলার্জি জনিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে তাদের ডাটাতে উল্ল্যেখ করা হয়েছে। ফাইজার নিশ্চিত করেছে যাদের ডিম অথবা বাদাম জনিত এলার্জি আছে তাদের ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিন নিরাপদ। তবে যাদের উচ্চমাত্রার এলার্জির সমস্যা আছে তাদেরকে এই ভ্যাকসিন নেওয়া থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে (MHRA)

তিনি বলেন এই ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহ এশীয় অঞ্চলে হয়তো কম তবে ইউরোপ ও আমেরিকায় কিছুটা বেশি। কুইন মেরী বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন ১০০০ লোকের উপর একটি জরিপ করে দেখেছে যে মাত্র ৫৮% লোক এই ভ্যাকসিন নিতে চায়। অনুরূপ ফ্রান্সের একটি জরিপে দেখা যায় ৫৪%, আয়ারল্যান্ডের একটি জরিপে দেখা যায় ৫৭% জনসাধারণ এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করার পক্ষে। লন্ডনে কৃষ্ণাঙ্গ বা এশীয় অঞ্চলের বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকদের ৩৯% লোক এই ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী যেখানে ব্রিটিশ সাদা সাদা নাগরিকদের ৭০% এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিতে চায়। আমরা দেখতে পাই কৃষ্ণাঙ্গ বা এশীয়দের মাঝে মৃত্যুর হার বেশি ছিল তাই তাদের প্রয়োজন হবে সকলেরই এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করা।

তিনি পশ্চিমা বিশ্বের এই ভ্যাকসিন গ্রহণে অনীহা জটিলতা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু দিক নির্দেশনা দেন। ডাক্তার মুসাব্বির সকলকে এই ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হতে আহবান করেন।

ডাক্তার মুসাব্বির হোসাইন ২০১৭ সালের জুলাই থেকে আয়ারল্যান্ডের জনগণকে স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দেশে সার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে MBBS পাশ করেন। তার জন্ম এবং বেড়ে উঠা ঢাকাতে। তিনি ঢাকা গভর্নমেন্ট লেবোরেটরি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা রেসিডেন্টশিয়াল মডেল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আয়ারল্যান্ডে আসার পূর্বে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

Facebook Comments Box