এক দোর্দন্ড প্রতাপ প্রেসিডেন্ট এর জীবন কাহিনী

0
437

ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন লেনিনগ্রাদে জন্মগ্রহণকারী রুশ প্রজাতন্ত্র বা রাশিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। খুবই সাধারণ পরিবার থেকে বেড়ে উঠা পুতিন আজ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধরদের মধ্যে একজন। একজন কারখানা শ্রমিকের সন্তান ও সাধারণ বাবুর্চির নাতি রাশিয়াকে আবার পরাশক্তি তুলে ধরতে দৃয় প্রতিজ্ঞ।

শৈশবে পুতিন 

শৈশব থেকেই পুতিন চিলেন ডানপিটে স্বভাবের, ছিলেন যথেষ্ট পরিমাণ দুষ্ট ও পড়ালেখায় অমনোযোগী। “ক্লাসের দুষ্টু ছেলে” হিসেবেই স্কুলে পরিচিত ছিলেন। তখন থেকেই পাড়ার ছেলেদের সাথে মারামারিতে রপ্ত থাকতেন। সে কারণে তখনই রপ্ত করে নেন জুডোর কলা কৌশল। জুডোতে তিনি ব্ল্যাক বেল্টও বাগিয়ে নেন।

স্কুলের পড়াশুনা শেষ করার আগেই পুতিনের স্বপ্ন ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিতে কাজ করার। তখন থেকে পড়ালেখায় একটু একটু করে মনোযোগী হতে শুরু করেন। পড়ালেখায় মনোযোগী হবার পাশাপাশি, খেলাধুলা ও স্কাউটসের সাথে যুক্ত হয়ে নিজেকে সবদিক দিয়ে পারদর্শী হতে শুরু করলেন।

হাইস্কুলে পড়ার সময়ে তিনি কেজিবির একটি শাখার পাবলিক রিসিপশনে গিয়ে জেনে আসেন কিভাবে একজন স্পাই বা গুপ্তচর হওয়া যায়। তিনি জানতে পারেন হয় তাকে সেনাবাহিনীতে কাজ করতে হবে, অথবা তাঁর একটি কলেজ ডিগ্রি থাকতে হবে, সবথেকে ভাল হয় যদি সেই ডিগ্রিটি হয় আইনের ওপর। ১৯৭০ সালে ভ্লাদিমির লেলিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।

গোয়েন্দা পুতিন

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পরপরই পুতিন যোগ দেন রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থায়। পরবর্তীতে তিনি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এ বদলী হয়ে পাঁচ মাসের মত কাজ করেন। ইন্টেলিজেন্সে কাজ করার প্রায় ছয় মাসের মাথায় তাঁকে বেশ কয়েকটি অপারেশন এবং পুঃন প্রশিক্ষণ কোর্স করতে পাঠানো হয়। তারপর তিনি আবার কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে ফিরে আসেন এবং আরও ছয় মাস সেই বিভাগে কাজ করেন।

কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এ দ্বিতীয় মেয়াদে কাজ করার সময়ে তিনি ফরেন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁকে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য মস্কোতে পাঠানো হয়। সেখানে এক বছর কাটানোর পর তিনি লেলিনগ্রাদে ফিরে যান, সেখানকার প্রধান কেজিবি শাখায় তিনি প্রায় সাড়ে চার বছর কাজ করেন। এরপর তিনি আবার মস্কোতে ফিরে যান এবং “Andropov Red Banner Institute (যা “কেজিবি স্কুল নম্বর ওয়ান” নামেও পরিচিত)” এ তাঁর জার্মানি অভিযানের জন্য প্রশিক্ষণ নেন।

স্নায়ু যুদ্ধের সময় তিনি তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে কেজিবির গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করেন।

১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ – এই পাঁচ বছর পুতিন রাশিয়ান এজেন্ট হিসেবে পূর্ব জার্মানিতে কাজ করেন। জার্মানিতে কাজ করাকালীন তিনি পদন্নোতি পেয়ে প্রথমে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এবং পরি আবারও পদন্নোতি পেয়ে বিভাগীয় প্রধানের প্রধান সহকারী হন। ১৯৯০ সালে পুতিন জার্মানিতে তাঁর কাজ শেষ করে লেলিনগ্রাদে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি লেলিনগ্রাদ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজে যোগ দেন। ১৯৯১ সালের জুনে সেইন্ট পিটার্সবার্গ সিটি হল এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন; এবং ১৯৯৪ সাল থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ সিটি গভর্মেন্টের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন।

প্রধানমন্ত্রী পুতিন 

কেজিবি থেকে পদত্যাগ করে ১৯৯৬ সালে জাতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রশাসনের সহকারী প্রধান হন। ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে একই সাথে রাষ্ট্রপতির বরিস ইয়েলেৎসিনের তাঁকে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সার্ভিসের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা করা হয়। এরই ভেতর তিনি অর্থনীতিতে তাঁর ডক্টরেট থিসিস করতে থাকেন। ১৯৯৮ সালের মে মাসে তিনি রাষ্ট্রপতির প্রশাসনিক দপ্তরের প্রধান চিফ অব স্টাফ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এবং সেই বছরের জুলাইয়েই তিনি ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৯৯ সালের মার্চ থেকে তিনি রাশিয়ান ফেডারেশানের নিরাপত্তা বিষয়ক কাউন্সিলের সচিব হিসেবে আসীন হন। সেই বছরেরই আগস্ট মাসে তিনি রাশিয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান।

প্রেসিডেন্ট পুতিন 

১৯৯৯ সালে নতুন বছরের প্রাক্কালে মি: ইয়েলেৎসিন প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৯৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পুতিন রাশিয়ার আপৎকালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আপৎকালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়ার অল্প পরেই পুতিন ২০০০ সালের ২৬শে মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবির্ভূত হন। সেই বছরের ৭ই মে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

প্রথম মেয়াদে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দারুন সফলতা ও সাধারন রাশিয়ানদের মাঝে দারুন জনপ্রিয়তা অর্জন করার পর ২০০৪ সালের ৪ মার্চ পুতিন আবারও রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

কিন্তু রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী কোন ব্যক্তি পরপর তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তখন মি: পুতিন প্রেসিডেন্ট পদে অংশগ্রহণ না করে প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচন করেন। ২০০৮ সালের ৮ মে পুতিন দ্বিতীয়বারের মত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান।

২০১১ সালের নভেম্বরে পুতিন আবারও রাশিয়ার টুয়েলভথ্ পার্টি কনগ্রেস থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মনোনয়ন পান। ২০১২ সালের মার্চে তিনি তৃতীয়বারের মত রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সাল থেকে পুতিন চতুর্থবারের মত রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল রয়েছেন।

সেই পুতিন এই পুতিন

পুতিনের বয়স এখন ৬৯ বছর। প্রায় ৬০ বছর আগে থেকেই মারামারি আর সংঘাতের নেশা ছিল লেলিনগ্রাদের (বর্তমান সেন্ট পিসবার্গ) কিশোর পুতিনের। সে নেশাই যেন এখন তার ফিরে এসেছে। আগে সে কিশোর সহপাঠীদের সাথে মারামারিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার সেই মারামারি আজ ছাড়িয়ে গিয়েছে বহুদূর। আগে সে হাতাহাতিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা গিয়ে ঠেকেছে কামান গোলা আর অত্যাধুনিক অস্রসস্রে। আজ প্রাণ হরণের খেলায় মত্ত সেই পুতিন। নিজ পার্শ্ববর্তী স্বাধীন দেশ ইউক্রেনে বাজিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধের দামামা। স্বাধীন দেশের শান্তিপূর্ণ মানুষের ঘুম নিমেষেই হরণ করে নেয়ার এক নাম এখন পুতিন।

২০১৫ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো লড়াই যদি অবশ্যম্ভাবী হয়, তাহলে প্রথম আঘাতটা আপনাকেই করতে হবে।’ পঞ্চাশ বছর আগে লেলিনগ্রাদের রাস্তা থেকেই এমন শিক্ষা পেয়েছেন বলে উলে¬খ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। ইউক্রেনে সেটাই হয়ত প্রয়োগ করতেছেন পুতিন।

জানিনা পুতিনের এই রাক্ষুসে নেশা থেকে বের হয়ে আসার মানসিকতা আধো জন্মাবে কিনা। এই সভ্য যুগে অসভ্য বর্বরতা এখন আর কারুরই কাম্য নয়।

Facebook Comments Box