আলহাম্বরা – ইউরোপে মুসলিম শাসনের জাজ্বল্যমান নিদর্শন

0
408

আলহাম্বরার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবিরা একে আখ্যায়িত করেন ‘’একগুচ্ছ পান্নার মাঝে একটি মুক্তা’’ বলে। একে ইউরোপের তাজমহল বললেও অত্যুক্তি হবেনা।

প্রায় ৭০০ বছর ইউরোপের আইবেরিয়ান পেনিসুলায় (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) মুসলমানরা দোর্দন্ড
প্রতাপের সাথে শাসন করেছিল। কিন্তু কালের আবর্তে মুসলিম অনেক নিদর্শনই হারিয়ে যায়। তারপরেও কিছু কিছু নিদর্শন আজও স্মরণ করিয়ে দেয় মুসলিম শাসনের স্বর্ণ যুগকে। আলহাম্বরা তেমনি একটি নিদর্শন, যা আজও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।

স্পেনে তখন ইসলামের স্বর্ণযুগ। সুলতান মুহাম্মদ ইবনে নাসরের (আল আহমার নামেও পরিচিত) নেতৃত্বে গ্রানাডাও চলে আসে মুসলমানদের কব্জায়। ইবনে নাসর ছিলেন নাসরিদ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। আলহাম্বরা তখনো আজকের আলহাম্বরায় পরিণত হয়নি। গ্রানাডার সাবিক পাহাড়ের উপর অবস্থিত একটি দুর্গের এলভিয়ার নামক দরজা দিয়ে প্রবেশ করেই প্রাসাদের নামকরণ করেন ‘’আল হামার’’ অর্থাৎ ‘’লাল’’। দুর্গের দেয়ালের লাল রঙ্গের কারণেই সম্ভবত ওই নামকরণ করেন। আল হামার থেকেই নামকরণ করা হয় কালাত আলহাম্বরা, যা মূলত আরবি শব্দ, যা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় লাল কেল্লা।

কারুকার্য খচিত শ্বেত পাথরের খিলানগুলা আজও বহন করে চলেছে হাজার বছরের ইতিহাস

আমরা যখন দূর থেকে আলহাম্বরাকে দেখেছিলাম মনে হচ্ছিল সমগ্র সাবিক পাহাড় জুড়েই আলহাম্বরার বিস্তৃতি। যখন ভেতরে প্রবেশ করলাম মনে হচ্ছে ছোট একটি গ্রামে প্রবেশ করেছি। এতে বোঝা গেল আলহাম্বরা একদিনে তৈরি হয়নি। ইবনে নাসর গ্রানাডা অধিগ্রহণের পরেই গ্রানাডার জৌলস বাড়তে থাকে। আলহাম্বরাকেও বর্ধন করতে থাকেন আড়ম্বরপূর্ণভাবে। বর্তমান যে আলহাম্বরা আমরা দেখি এই আলহাম্বরাকে পূর্নাঙ্গ রূপ দেন সুলতান ১ম ইউসুফ ও পরে সুলতান মাহমুদ (৫ম)। মূলত ১২৩৮ সালে ইবনে নাসর গ্রানাডা অধিগ্রহণের পর থেকে ১৪৯২ সালে খ্রিস্টানদের অধিগ্রহণের সময় পর্যন্ত আলহাম্বরার উন্নয়নকাজ চলেছিল। এরপর সময়ে সময়ে আরো পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়। কিছু পুরনো স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলা হয় এবং কিছু নতুন অংশ সংযোজিত হয়। যুদ্ধ ও অপরিচর্যায় আলহাম্বরার জৌলস অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। তারপরেও বর্তমান আলহাম্বরাকে দেখলে সে সময়ের আড়ম্বরপূর্ণ জ্বলজ্বলে মুহূর্তকে দৃশ্যমান করে তোলে।

আলহাম্বরার বাহ্যিক অংশ। সাবিক পাহাড়ের সমগ্রাংশ জুড়েই আলহাম্বরার বিস্তৃতি

দৈর্ঘ্যে প্রায় ২,৪৩০ ফুট ও প্রস্থে ৬০০ ফুট সম্বলিত ১৫,৩০,০০০ বর্গফুটের ১৭৩০ মিটার দেয়াল ঘেরা ত্রিশটি টাওয়ার অ চারটি সদর দরজা সম্বলিত বিশাল প্রাসাদ শুধু আয়তনেই বড় নয়, এর নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীও ছিল নজরকাড়া। এর স্থাপত্য নকশা, জটিল জ্যামেতিক ও অ্যারোবিক্সের কাজ দেখলে মাথা ঘুরে যাবে যে কারোই। প্রতিটা দেয়াল, কলাম, ছাদ; কোনটার সাথে কোনটার মিল নেই। সবগুলোই ইউনিক। দেয়াল এবং ছাদের নকশা অ্যারাবিক ক্যলিগ্রাফিতে ভরপুর। কোথাও পবিত্র কুরআন থেকে আয়াত, কোথাও বিখ্যাত সব কবিদের সাহিত্যিক উক্তি দিয়ে সাজানো প্রতিটি দেয়াল, ছাদ এবং পিলারগুলো। ৯০০০ বার শুধু ‘’ওয়া লা গালিব ইল্লা আল্লাহ’’ অর্থাৎ ‘’অন্য কেউ বিজয়ী না, যদি না আল্লাহ” লেখা আছে দেয়ালে দেয়ালে।

এমন নৈপুণ্যশৈলীর অ্যারাবিক ক্যালিগ্রাফি চোখে পড়বে সর্বত্র

আলহাম্বরা শুধু চারদেয়ালের মাঝে একটি দালানই নয় বরঞ্চ অনেকগুলো প্রাসাদ, উদ্যান, ব্যারাক, উঠোন, ঝর্না, সলিল স্বচ্ছ পানির নহর, পরিষ্কার পানিসম্বলিত পুকুর অসংখ্য কলাম ও তোরণের সমন্বয়ে গঠিত এক স্বর্গসম প্রাসাদ। এর একেকটা প্রাসাদ/কক্ষ একেক কাজে ব্যবহৃত হত।

সরোবর সম্বলিত উদ্যান ও বৈঠকখানা

বসবাসের জন্য ছিল তিনটি ছোটবড় আকারের প্রাসাদ। সবচেয়ে বড় প্রাসাদটির নাম হচ্ছে কোমারেস প্রাসাদ। প্রাসাদের পেছনে রয়েছে ঝর্না ও সামনে রয়েছে বৃক্ষরাজি পাড় সম্বলিত পুকুর, যা কোর্ট অফ মার্থেল নামে পরিচিত, এখানে সুলতানরা প্রশাসনিক কাজ চালাতেন। কোমারেস প্রাসাদের পাশেই রয়েছে কোর্ট অব লায়ন। সুলতান পঞ্চম মুহাম্মদ এই কোর্ট অব লায়ন নির্মাণ করেছিলেন। ১২ টি সিংহের উপর শ্বেত পাথরে তৈরি পানির পোয়ারার কারণেই হয়ত নাম হয়েছে কোর্ট অব লায়ন।

কোমারেস প্যালেস – কোর্ট অব মার্থেল

প্রাসাদে অবস্থিত উদ্যানগুলোকে বলা হত জেনারালাইফ। জেনারালাইফ শব্দটি এসেছে আরবি ‘’জান্নাত আল আরিফ’’ থেকে। জান্নাতে বর্ণিত উদ্যানের আদলেই শুভ্র শ্বেত পাথর, পানির নহর ও ঝর্না সম্বলিত জেনারালাইফ তৈরি করে তৎকালীন আমিরগণ।

১২ টি সিংহের ভাস্কর্যের উপর অবস্থিত পানির পোয়ারা সম্বলিত কোর্ট অব লায়ন

আলহাম্বরা শুধু প্রাসাদই নয়, এটা দুর্গ হিসেবেও ব্যবহৃত হত। প্রাসাদের সবচেয়ে পুরনো স্থাপনা হচ্ছে আল কাজাবা। আল কাজাবা মূলত সৈন্যদের ব্যারাক হিসেবে ব্যবহৃত হত। ত্রিকোণাকৃতির আল কাজাবার চতুর্দিকে উঁচু ওয়াচ টাওয়ার আছে। সবচেয়ে উঁচু (প্রায় ৮৫ ফুট) ওয়াচ টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষণ ও শহরে পানির সরবারাহ নিয়ন্ত্রণ হত। গ্রানাডার সমতলভূমিতে সেচের পানি ছেড়ে দেয়া ও বন্ধ করতে এই পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের ঘণ্টা থেকে সঙ্কেত দেয়া হতো। দ্বিতীয়টিতে নামাজ কক্ষ ও তৃতীয়টি গিরিপথের প্রবেশ দ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হত।

আল কাজাবা – সৈন্যদের ব্যারাক ছিল যেখানে

বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত, যুদ্ধ, ঝড়-জঞ্চা অতিক্রম করে আলহাম্বরার যেটুকুই টিকে আছে তাতে সহজেই অনুমেয় যে মুসলিম সাম্রাজ্য কত শৌর্য বীর্য নিয়ে টিকে ছিল। কালের পরিক্রমায় সেই শৌর্য বীর্য হারিয়ে গেলেও ইতিহাস থেকে মুছে যায় নি। আলহাম্বরা শুধু একটি প্রাসাদই নয়, এটি বহন করে চলেছে এক জলজ্যান্ত ইতিহাস।

আলহাম্বরার ভেতরে অনেকাংশই টিকেট ছাড়া ঘোরা যায়। টিকেট লাগবে শুধু নাসরিদ প্রাসাদে এবং আল কাজাবা তে ঢুকতে। নাসরিদ প্রাসাদ হচ্ছে যেখানে সুলতানদের আবাস্থল ও উদ্যান ছিল এবং আল কাজাবা ছিল সৈন্যদের ব্যারাক।

বারান্দা – অনন্য স্থাপত্যশৈলী ও শিল্পের ছোঁয়া কোথাও বাদ যায়নি

ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন আমেরিকা আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তখন রাজা ফার্দিনান্ড ও রানি ইসাবেলা এই আলহাম্বরা থেকেই কলম্বাসকে কমিশন প্রদান করেন। যে কক্ষ থেকে কলম্বাসকে কমিশন প্রদান করেন তা হচ্ছে নাসরিদ প্রাসাদেরই একটা কক্ষ থেকে, যা এখনো আছে।

মুহাম্মদ ইবনে নাসর যখন গ্রানাডায় বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন মানুষ ‘’তাকে মারহাবান লি-ল-নাসির’’ বলে সম্বোধন করতেন। তখন ইবনে নাসর জবাবে বলেন ‘’ওয়া লা গালিব ইল্লা আল্লাহ’’ অর্থাৎ ‘’অন্য কেউ বিজয়ী না, যদি না আল্লাহ”। এর পর এই বাক্যটি গ্রানাডার নীতিবাক্যে পরিণত হয়। আলহাম্বরার দেয়ালে ৯০০০ বার শোভা পাচ্ছে ‘’ওয়া লা গালিব ইল্লা আল্লাহ’’।

অপূর্ব নকশা সম্বলিত ছাদ। কোন ছাদের নকশা কোন ছাদের সাথে মিল নেই। প্রত্যেকটিই আলাদাভাবে সুন্দর।
আলহাম্বরার রাতের দৃশ্য। মনে হচ্ছে পাহাড়ের চূড়ায় আগুনেরা খেলায় মেতেছে।

লেখা, অভিজ্ঞতা ও ছবিস্বত্বঃ ওমর এফ নিউটন
আইরিশ বাংলা টাইমস

Facebook Comments Box