আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে উত্তেজনা কেন?

0
767

নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে লড়াই এবং উত্তেজনা আরও তীব্র হয়েছে। বৈরী দুই দেশের সংঘাতের পেছনে আজারিদের বহু দিনের জমে থাকা ক্ষতের শিকড় কত গভীরে আর এই লড়াইয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষের যন্ত্রণা নিয়ে লিখেছেন বিবিসির দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চল ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা রেইহান দেমিত্রি।

পূর্ব ইউরোপে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সংঘাতপূর্ণ এলাকার নাম নাগোরনো-কারাবাখ। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে বিতর্কিত এই এলাকা কার তা নিয়ে। দুই প্রতিবেশি দেশ একে অপরের চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছে এই নাগোরনো-কারাবাখ ভূখন্ডকে কেন্দ্র করে।

আর্মেনীয়দের জন্য এই এলাকা তাদের প্রাচীন খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির শেষ ধারক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর আজারীদের জন্য কারাবাখ মুসলিম সংস্কৃতির একটা প্রাণকেন্দ্র, তাদের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম কবি ও সঙ্গীতজ্ঞদের পবিত্র জন্মস্থান।

সোভিয়েত আমলে নাগোরনো-কারাবাখ ছিল আজারবাইজানের মধ্যে একটি স্বায়ত্তশাসিত এলাকা। কিন্তু সেখানে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ছিল জাতিগত আর্মেনীয়রা।

সোভিয়েত সাম্রাজ্য যখন ১৯৮০’র দশকের শেষ দিকে ভেঙে পড়তে শুরু করে, তখন নাগোরনো-কারাবাখের আঞ্চলিক পার্লামেন্ট আর্মেনিয়ার অংশ হিসাবে থাকার পক্ষে ভোট দেয়। এর জেরে শুরু হয় যুদ্ধ। মারা যায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।

রাশিয়া তখন একটা যুদ্ধবিরতি করার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছিল। সেটা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি হলেও কখনও দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে কোন শান্তিচুক্তি হয়নি।

ফলে বিতর্কিত এই ছিটমহল সরকারিভাবে আজারবাইজান ভূখন্ডের অংশ হিসাবে থেকে গেলেও, বিচ্ছিন্নতকামী জাতিগত আর্মেনীয়রা কারাবাখ এবং আশেপাশের সংযুক্ত আরও সাতটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রায় ছয় লাখ জাতিগত আজারী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

স্বদেশ হারানোর গভীর ক্ষত

কয়েক বছর আগে বিবিসির এই প্রতিনিধি আজারবাইজানে যান দেখতে যে এই দ্বন্দ্ব আজারবাইজানের সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে।

ককেশোস পর্বতমালা আর কাস্পিয়ান সাগর দিয়ে ঘেরা দেশ আজারবাইজান পূর্ব ইউরোপ আর পশ্চিম এশিয়ার সংযোগস্থল। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর উপকণ্ঠে বাস করেন এই দ্বন্দ্বের কারণে দেশের ভেতরেই গৃহহীন হওয়া বেশ কিছু আজারী পরিবার। তাদের থাকার জন্য নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট ভবন বানিয়ে দিয়েছে সরকার।

ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর তারা বেশ অনেক বছর মানবেতর জীবন কাটিয়েছেন পুরনো স্কুল বাড়ি আর পরিত্যক্ত সিনেমা হল ও কারখানায়। তাদের অধিকাংশই এই নতুন ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকতে চান না। তারা স্বপ্ন দেখেন তাদের প্রিয় বাসভূমি কারাবাখে ফিরে যাওয়ার, যে প্রিয় মাতৃভূমি তারা হারিয়েছেন দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের কারণে।

আজারবাইজানের পুরো জাতীয় সত্ত্বা গড়ে উঠেছে তাদের মাতৃভূমি, স্বদেশভূমি হারানোর বেদনা ও ক্ষতকে ঘিরে। বিবিসির প্রতিনিধি রেইহান দেমিত্রি বলেন, একটা প্রাইমারি স্কুলে দেখলাম শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে সাত বছরের শিশুদের বলছেন তাদের হারানো এলাকাগুলোর নাম মুখস্থ বলতে। যেমন কেলবাজার, ফাযুলি, লাচিন। এ রকম সব মিলিয়ে কারাবাখ ছাড়াও আরও সাতটি এলাকা। শিক্ষক ক্ষুদে পড়ুয়াদের বলছিলেন, একদিন এসব এলাকা আমরা ফিরে পাবো।

এসব অঞ্চল নিয়ে লড়াইয়ে যেসব সৈন্য মারা গেছেন স্কুলের ভেতর তাদের সম্মানে তৈরি করা হয়েছে স্মারকস্তম্ভ। দেখলাম একজন সেনার ছবি, যিনি এখনও জীবিত। নাম রানিল সাফারাভ। যখন তিনি ও তার পরিবার কারাবাখ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন, তখন রানিল মাত্র একজন শিশু। পরে বড় হয়ে তিনি যোগ দেন আজারী সেনাবাহিনীতে।

২০০৪ সালে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ন্যাটোর এক প্রশিক্ষণের সময় তিনি আর্মেনীয় বাহিনীর এক অফিসারকে ঘুমন্ত অবস্থায় কুঠার দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেন। সাফারভের আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ হয়। হাঙ্গেরির এক কারাগারে ৮ বছর কাটানোর পর তাকে বিমানে নিয়ে যাওয়া হয় আজারবাইজানে, তার দণ্ডাদেশের বাকি সাজা খাটার জন্য।

কিন্তু আজারবাইজানে পৌঁছানো মাত্রই তাকে বীরের মর্যাদা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। তাকে লাল গালিচা অভ্যর্থনা দেয়া হয়, তাকে সামরিক খেতাবে ভূষিত করা হয় এবং বিনা খরচে একটি থাকার অ্যাপার্টমেন্ট উপহার দেয়া হয়।

কারাবাখে সর্বদা ভয়ের পরিবেশ

আর্মেনিয়া তাদের স্ব-ঘোষিত প্রজাতন্ত্র নাগোরনো-কারাবাখের নাম দিয়েছে আর্তযাখ্। রেইহান দেমিত্রি বলেন, আমি সেখানে গিয়েছিলাম ২০১৫ সালে যখন সেখানকার পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল।

কারাবাখের বেশির ভাগ গ্রামের দুটি করে নাম আছে। আজারী নাম আর আর্মেনীয় নাম। যেমন, কারবাখের আঞ্চলিক রাজধানী স্টেপানাকার্ট। আর্মেনীয়রা একে স্টেপানাকার্ট নামে ডাকলেও আজারীদের কাছে এর নাম হান্কেন্দি।

প্রাচীন শহর, যার নাম শুশা বা শুশিতে আমি দেখেছি পরিত্যক্ত ও ভাঙা প্রাচীন আজারী মসজিদের পাশে তৈরি হওয়া আর্মেনীয় গির্জা। মাদাগিয গ্রামে আমার সাথে কথা হয় লুদমিলা বাগদেসারিয়ানের। অবিস্ফোরিত একটা বোমা ফেটে তার ১৪ বছরের ছেলের একটা হাতের অনেকটা অংশ উড়ে গেছে। তিনি আমাকে কফি খেতে আপ্যায়ন করেন।

লুদমিলা বলছিলেন, কীভাবে তারা সারাক্ষণ একটা ভয়ের পরিবেশে জীবন কাটান। তাদের ভয় যেকোন সময় বড় ধরনের যুদ্ধ লাগবে। তিনি বলেন, আজারী সৈন্য যদি এই গ্রামে আসে, তারা জানতে চাইবে না আমাদের কোন দোষ আছে কিনা। তাদের চোখে আমরা শুধু আর্মেনীয় এবং আমাদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই!

আমরা দেখছি কীভাবে সপ্তাহব্যাপী এই যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এবারের যুদ্ধ আগের সব যুদ্ধের চেয়ে বেশি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট, এবং গোলাবর্ষণ হচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে- শুধু রণাঙ্গনে সৈন্যদের লক্ষ্য করেই নয়, এমনকি রেহাই পাচ্ছে না বেসামরিক মানুষও।

আজারবাইজান এখনও তাদের হতাহাতের সংখ্যা প্রকাশ করেনি। আর্মেনিয়া বলছে, তাদের শতাধিক মানুষ মারা গেছে, যাদের অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। এই দ্বন্দ্ব যখন শুরু হয়, তখন তাদের জন্মও হয়নি।

২০১৫ সালে আমি যখন নাগোরনো-কারাবাখে গিয়েছিলাম, তখন প্রাচীন একটা আর্মেনীয় গির্জার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমি থেমেছিলাম গির্জার সামনে। গির্জার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন এক বৃদ্ধ, মাথা ভর্তি পাকা চুল, সাদা দাড়ি। হাতে লাঠি। বললেন ১৯৯০ এর দশকের যুদ্ধে তার ছেলেকে হারিয়েছেন তিনি।

চোখে হাসির ঝিলিক তুলে আমাকে বলেছিলেন, তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে ওই মুহূর্তে জীবন ও প্রকৃতিকে উপভোগ করছেন।

তিনি বললেন, ঈশ্বরের কাছে আমার একটাই অভিযোগ, তিনি আমাদের সবাইকে একই জাতির সন্তান হিসাবে সৃষ্টি করেননি। সেটা করলে আমরা একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে মরার বদলে শান্তিতে বাস করতে পারতাম! বিবিসি বাংলা।

Facebook Comments Box