স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী। ৫০ বছর পরও জাতি কেন দ্বিধাবিভক্ত ?

0
1970
Shahid bhai

স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী, ৫০ বছর পর ও জাতি কেন দ্বিধাবিভক্ত ?

 


 

বৃটিশরা প্রায় দুই শত বছর ভারত উপমহাদেশে তাদের রাজত্ব কায়েম করে আসে।একটা দেশ যখন বানিজ্যের নামে আরেকটি দেশ দখল করে নেয় তখন তাকে আমরা উপনিবেশবাদ বলে থাকি। বৃটিশ সরকার তাই করেছে। তারা বানিজ্যের অজুহাতে এই উপমহাদেশে নির্বিঘ্নে শোষন চালিয়ে এসেছে।বৃটিশ উপনিবেশ আমলে হিন্দু জমিদার ও মুসলিম চাষিদের মধ্যে বিভিন্ন কারনে সামাজিক বৈষম্য তৈরী হয়। কৃষকদের মুক্তির আন্দোলনই কাল পরিক্রমায় পাকিস্তান আন্দোলনে পরিনত হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের (Tow nation theory) ভিত্তিতে মুসলিম অধ্যুষিত অন্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু অধ্যুষিত অন্চল নিয়ে ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাস্ট্রের সৃস্টি হয়। পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট। এবং ভারত তাদের স্বাধীনতা দিবস পালন করে আসছে ১৫ ই আগস্ট থেকে। পাকিস্তানের জন্ম ছিল মূলত মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনের চুড়ান্ত রুপ।এর বীজ বপন করা হয়েছিল মূলত ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলনে। ঐ সম্মেলনে গৃহীত হয় ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্থাব। যা ছিল ভারতের উত্তর পূর্ব এ উত্তর পশ্চিম অংশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ গুলো নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম রাস্ট্র এবং মধ্য ও দক্ষিনের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ গুলো নিয়ে হিন্দু রাস্ট্র প্রতিস্টা করা। ১৯৪৬ সালে সাধারন নির্বাচনে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন আরো বৃদ্ধি পায়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মুসলিমলীগ এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় কংগ্রেসের প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে স্বতন্ত্র রাস্ট্র প্রতিস্টার দাবী আরো সুস্পস্ট হয়ে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃটিশ গভর্নর Lord Mount Batten ১৯৪৭ সালে জুন মাসেই দেশ বিভাগের নীতি ঘোষনা দেন। যার ফলশ্রুতিত্ ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বতন্ত্র জাতি সত্তার অভ্যুদ্ধয় ঘটে।

পাকিস্তান রাস্ট্রের সৃস্টির পর থেকেই (পুর্ব ও পশ্চিম) দুটি অংশের মধ্যে শুরু হয় নানাবিধ বৈষম্য। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি শুরু হয় রাস্ট্রভাষা বাংলা নিয়ে ষড়যন্ত্র।১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ঢাকার পৃথক দুটি সমাবেশে বলেন “Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan” একথা বলার পর প্রতিবাদমূখোর হয়ে উটে বাংলার ছাত্রসমাজ। ‘রাস্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে মুখোরিত হয়ে উটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ আশপাশ এলাকা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি সাধারন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভংঘ করে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়, এতে নিহত হন সালাম,বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর সহ নাম না জানা অনেকে। এর পর ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্থানের আইন পরিষদের নির্বাচনেকে সামনে রেখে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। আন্চলিক স্বায়ত্বশাসন ও বাংলাকে রাস্ট্রভাষা করার দাবী সহ ২১ দফা দাবী নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিস্টতা পেয়ে সরকার গঠন করে। মূখ্যমন্ত্রী হন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক। বেশী দিন স্থায়ী না হয়ে অবশেষে ভেংগে যায় যুক্তফ্রন্ট সরকার।

১৯৬২ সালে শুরু হয় শিক্ষা আন্দোলন। ১৯৬৬ সালে পেশ করা হয় ঐতিহাসিক ৬ দফা। ছাত্রদের ১১ দফা দাবী সম্বলিত ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। এর পর শুরু হয় ১৯৬৯ সালে দেশজুড়ে গনঅভ্যুত্থান।ঐ গন অভ্যুত্থানের মুখে অবশেষে আয়ুব খানের পতন ঘটে। ক্ষমতায় আসীন হন নব্য স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান। তীব্র আন্দোলন ও দাবীর মুখে বাধ্য হয়ে ইহাহিয়া খান ১৯৭০ সালে পাকিস্তান গনপরিষদ নির্বাচনের ঘোষনা দেন। এই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিজয়ী হওয়ার পর ও ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাক না দিয়ে নানা টালবাহানা শুরু করেন। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন পতাকা উত্তোলনের পর ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষনের মাধ্যমে জনগনকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানান। ৭ ই মার্চের ভাষন নি:সন্দেহে তাৎপর্যপূর্ন ছিল এবং ঐ ভাষন মুক্তিকামী মানুষকে আরো বেশী অনুপ্রেরনা জুগিয়েছে। ২৩ মার্চ পর্যন্ত আলোচনার নামে সময় ক্ষেপন করার মাধ্যমে হটাৎ করে ২৫ শে মার্চ কালো রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকা আক্রমণ করে।রাজারবাগ পুলিশ লাইন সহ অসহায়, ঘুমন্ত মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু করে নিরস্ত্র মানুষের উপর নির্মম হত্যাযক্ষ্য, সেই সাথে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় শেখ মুজিবুর রহমান কে। অসহায়, দিশেহারা জাতি কি করবে, এমন অবস্থার মধ্যে তৎকালীন মেজর জিয়া ‘We Revolt’ বলে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধ যুদ্ধের আহবান জানান। ২৬ শে মার্চ (প্রথম প্রহরে) নিজে ই চট্রগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। পরে অবশ্য পূনরায় সংশোধীত ঘোষনা ২৭ শে মার্চ শেখ মুজিবের পক্ষে প্রদান করেন।তার ভাষনটি ছিল এইরকম “ I major Zia …….. hereby proclaims, on behalf of sheikh Mujibur Rahman, the independence of Bangladesh. তিনি ঐ বক্তৃতায় আরো বলেন- “I also declare, we have already framed a sovereign legal government ……….. I appeal to all government’s to mobilise (sic) public opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh.

তার ঘোষনার পর সামরিক/বেসামরিক মিলে শুরু হয় স্বশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ এবং ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পাই লাল সবুজের পতাকা বেস্টিত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাস্ট্র, স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।

এখানে বলা আবশ্যক ‘ স্বাধীনতা সংগ্রাম’ এবং ‘ মুক্তিযুদ্ধ’ এক জিনিষ নয়, দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল। অতএব স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অবশ্যই বড় মাপের নেতা ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসাবে মেজর জিয়াউর রহমানকে অস্বিকার করার উপায় নাই। শেখ মুজিব তার জীবদ্ধশায় কোনদিন জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তোলেননি, উপরুন্ত তার মুক্তিযুদ্ধের অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ “বীর উত্তম” খেতাবে ভূষিত করেছেন। অপরদিকে জিয়াউর রহমান ও কোনদিন মরহুম শেখ মুজিব সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করেননি। নিজেকে বড় করতে গিয়ে অন্যকে ছোট করা সমিচীন নয়। যার যতটুকু অবদান তা স্বীকার করে সত্য প্রকাশে উদ্যোগী হওয়া দরকার। সুতরাং এই দুই মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান ও মেজর জিয়াউর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম. এ. জি ওসমানী সহ সকল শহীদ মুক্তিযুদ্ধাদের জানাই গভীর শ্রদ্ধান্জলী।

পরিশেষে এটুকু বলতে চাই, বাংলাদেশ সৃস্টির আজ ৫০ বছর। জাতি হিসাবে আমরা উদযাপন করছি স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী।একটি জাতির জন্য ৫০ বছর দীর্ঘ না হলেও একজন ব্যাক্তির জন্য অনেক বছর। আমরা যে সকল মৌলিক ভিত্তির উপর দাঁড়ীয়ে যুদ্ধ করেছিলাম তার মধ্যে অন্যতম ছিল- ১।সাম্য, ২।মানবিক মর্যাদা, ৩।সামাজিক ন্যায় বিচার, ৪।বৈষম্যহীন গনতান্ত্রিক রাস্ট্র প্রতিস্টা ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হল যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা স্বাধীকার আন্দোলনে অংশ নিয়ে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হলাম, সেই লক্ষ্য কতটুকু পূরন করতে পেরেছি অথবা স্বাধীনতার মর্যাদা কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছি ? ৫০ বছর পর এখনও এই প্রশ্ন আমাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাছাড়া স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পেতে আর কত বছর আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে ? সুবর্ন জয়ন্তীতে এসে আজো এর উত্তর খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে জাতিকে !

লেখক:- প্রভাষক আব্দুস সহিদ
এম.এস.এস (রাস্ট্রবিজ্ঞান)
আয়ারল্যান্ড প্রবাসী

Facebook Comments Box