স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরঃ স্বপ্ন পূরণে আশাবাদী, তবে…

0
1110
Shajedul Bhai

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরঃ স্বপ্ন পূরণে আশাবাদী, তবে…
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল


 

বিশেষ দিবস এলেই আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম নাড়াচাড়া দিয়ে উঠে। সভা সেমিনার করি। বক্তব্য দেই। গল্প কবিতা লিখি। পত্রিকা গুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠান প্রচারের ধুমধাড়াক্কা শুরু হয়ে যায়।

এবারও তাই হবে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি তথা সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে এবার একটু বেশিই হবে। আমি এসবের বিরোধী নই। বরং ইতিহাসকে জিইয়ে রাখতে ও নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার স্বার্থে এসব করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু কেবল ওই বিশেষ দিন গুলোর মধ্যেই যদি দেশপ্রেম বন্দী হয়ে থাকে তবে তা দেশের কল্যাণের জন্য যথেষ্ট নয়। খণ্ডিত ভালোবাসা দিয়ে যেমন ভালোবাসার সফল উত্তরণ ঘটানো যায়না তেমনি মওসুমী দেশপ্রেম দিয়ে দেশের কল্যাণ বয়ে আনা যায়না। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন স্থায়ী দেশপ্রেম এবং সাচ্চা দেশপ্রেমিক।

আমরা এবার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদযাপন করতে যাচ্ছি। একটি মানুষের জন্য পঞ্চাশ বছর অনেক সময় মনে হলেও একটি দেশ বা জাতির জন্য তা খুব বেশি একটা সময় নয়। একটি গল্প বলি। আমি তখন কলেজের ছাত্র। ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি গেলাম। শুনলাম, কয়েক মাইল দূর থেকে এক ভদ্রলোক আমাদের গ্রামে এসেছেন। তার শরীরে পরী ভর করে। গতরাতে তিনি পরী এনেছিলেন। আজ রাতেও নামাবেন। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে একটু ঘুমাবো ভেবেছিলাম কিন্তু ঘুমটুম বাদ দিয়ে বেশ কৌতুহল নিয়ে পরী দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

মাঝরাত। ঘরের আলো নিভিয়ে দেয়া হলো। হুট করে ঘরের ছাঁদ বরাবর একটা মচমচ শব্দ শুনা গেলো। পরী এসে গেছে, পরী এসে গেছে বলে রব উঠলো। কেউ পরীকে দেখলোনা, আমিও দেখতে পাইনি। তবে কোরআন তেলওয়াতের ক্ষীণ স্বর সবাইকে পরীর উপস্থিতির কথা জানিয়ে দিলো। অর্থাৎ পরী এসেই প্রথমে কোনো কথাবার্তা না বলে কোরআন তেলওয়াত করে। তেলওয়াত শেষে সে উপস্থিত লোকজনের সাথে আলাপচারিতায় লিপ্ত হয় এবং বিভিন্ন জন তাকে বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করে। ওইদিনও তাই হলো। শুরু হল প্রোশ্নাত্তর পর্ব। একজন তার বিয়ে হয়েছে কিনা জানতে চাইলো। উত্তরে বললো, তার বয়স মাত্র একশ বিশ বছর। জ্বিন পরীরা সাধারণত হাজার থেকে বারোশো বছর বেঁচে থাকে। তাই সে হিসেবে সে অপ্রাপ্তবয়স্কা। তার বিয়ের বয়স এখনো হয়নি। অর্থাৎ বাচ্চা মেয়ে (পরী)।

সুতরাং পরীর এ উদাহরণটি আমি যদি একটি দেশ বা জাতির ক্ষেত্রে টানি তাহলে খুব বেশি একটা অমূলক হবে বলে মনে হয় না। কারণ
একটি দেশ বা জাতি হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকে। সে হিসেবে পঞ্চাশ বছর একটি জাতির জন্য নস্যি মাত্র। শিশুতুল্য। সুতরাং শিশু বয়সে (বিগত পঞ্চাশ বছরে) দেশটি যতোটুকু এগিয়েছে কৈশোরে পদার্পণ করতে করতে (আগামী পঞ্চাশ বছরে) তা আরও পঞ্চাশ গুণ বেশি এগিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ দেশটি যখন জন্মলগ্ন থেকে যাত্রা শুরু করে তখন এটি ছিলো একটি মেধাশূন্য ধ্বংসস্তূপ। রাস্তাঘাট কালভার্ট, ব্রিজ, যানবাহন, অফিস আদালত, দালানকোটা বলতে কিছুই ছিলো না। পাকবাহিনীরা যখন বুঝতে পারে তাদের পরাজয় নিশ্চিত তখন তারা ওইসব পারিপার্শ্বিক ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি বেছে বেছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে। এমন একটি প্রেক্ষাপটে বলতে গেলে শূন্য তহবিল, শূন্য মেধা বা শূন্য মানবসম্পদ ও অসংগঠিত প্রশাসন নিয়েই দেশটির পথচলা শুরু হয়।

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটির এমন অমসৃণ যাত্রাপথের সাথে আরও যোগ হয় বৈদেশিক মুদ্রার শূন্য ভান্ডার ও ভারসাম্যহীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ভারত থেকে ফিরে আসা সহায়সম্বলহীন এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন চ্যালেঞ্জ, বিশ্বমন্দা ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, বন্যা, খাদ্যাভাব, সামাজিক অস্থিরতা, অপপ্রচার ও আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধাদের অন্তর্কলহ, দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, রক্তারক্তি, গুম ও খুন, ব্যাংক ডাকাতি ও কলকারখানায় লুটপাট ও আগুন, অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্বের ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য, আইন শৃঙ্খলার অবনতি এবং সর্বশেষ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতার জেল হত্যা কান্ড দেশকে মারাত্মক ভাবে ঝাঁকুনি দেয়। আর সামনের দিকে এগোতে পারেনা। স্বাধীনতার আশা আকাঙ্খা বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্থ হয়। সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রকে থমকে দেয়া হয়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যা কান্ডের বিচার রহিত করা হয়।

এর পরের ইতিহাস আমাদের সবারই কম বেশি জানা। “সামরিকবাদ জিন্দাবাদ” শ্লোগানের উপর ভর করে দেশ চলতে থাকে বছরের পর বছর। জন্ম নেয় ধর্মীয় উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, স্বৈরাচারবাদ। দেশ যখন এমন এক কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিলো তখন প্রায় একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় তারা আর আসতে পারেনি। তাই এতদিনের ঘুণেধরা সমাজব্যবস্থাকে সংস্কার করে দেশকে উন্নয়নের যথোপযুক্ত পথে নিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। পক্ষান্তরে বিএনপি জামায়াত পুনরায় ক্ষমতায় এসে দেশের উন্নয়নকে কেবল কণ্টকাকীর্ণই করেনি বরং দেশকে জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির রামরাজ্যে পরিনত করে।

অনেক চরাই উৎরাইয়ের পর আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে আবারো ক্ষমতায় আসে এবং টানা তিনবারে এখন পর্যন্ত সরকারে রয়েছে। রামরাজ্যকে স্বর্ণরাজ্যে পরিনত করার ব্রত নিয়ে তারা কাজ করে চলছে। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, রূপপুর পারমাণবিক প্লান্টের মতো বিশাল প্রকল্প, উড়াল সেতু, বিদেশি স্টাইলে চার লেইন/ আট লেইনের মহাসড়ক প্রভৃতি দৃশ্যমান উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে তাদের ওই ব্রতচারীতারই প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।

দেশ এগিয়ে চলছে সন্দেহ নেই। ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যে দেশের যাত্রা সেই দেশ আজ প্রায় ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে, যা কিনা আকারে আদি বাজেটের ৭২২ গুণ বড়ো। শুধু তাই নয়, আমরা যদি জিডিপি, মাথা পিছু আয়, মানুষের গড় আয়ু, নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন, শহরায়ন, নগরায়ন, শিল্পায়ন প্রভৃতি বিষয় গুলোর উপর নজর দেই, দেখা যাবে অবিশ্বাস্য হারে এসবের উন্নয়ন ঘটেছে। আর তাই তো ওবামার মতো আমেরিকার একজন প্রেসিডেন্টের মুখে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বলতে শোনা যায়।

এ রোল মডেল হওয়ার পেছনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, কৃষক, উদ্যোক্তা ও শ্রমজীবী মানুষের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্ম ও প্রবাসীদের অবদান রয়েছে ব্যাপক। আজকালকার তরুণরা চিন্তাচেতনা ও ধ্যান ধারণায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সামাজিক ও স্বেচ্চাসেবক কর্মকাণ্ডের বাইরে স্বীয় কর্ম জগতেও তারা বেশ স্বচ্ছ, স্বাধীন, সৎ ও সাহসী। আমার বোন-ভাগ্নে ও ভাই-ভাতিজা সহ প্রায় ২৫/৩০ জন চাকরিজীবি তরুণকে আমি চিনি যাদের উপর মনে মনে একটি জরিপ চালাই। দেখা গেলো ওদের সবাই ঘুষ ও দুর্নীতি বিরোধী। চাকরিতে ঢোকার জন্য সুপারিশের সুযোগ থাকা সত্বেও আমার ভাতিজা সে সুযোগ লুফে নেয়নি। স্বীয় যোগ্যতায় চাকরি নেবে বলে যে পণ ধরেছিলো তাই সে করেছে। আমার ভাগ্নে তার মাকে দোয়া করতে বলে যেনো টাকার খনিতে চাকরি করা সত্বেও সে সৎ থাকতে পারে। তাই আমি বিশ্বাস করি, এমন চিন্তা চেতনা কেবল আমার ভাগ্নে, ভাতিজা বা ওই তিরিশ জন তরুণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং গোটা তরুণ মানসের অধিকাংশেই তা বিরাজ করছে। ঘুণেধরা সমাজের বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। যা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করছে। আপাতদৃষ্টিতে তা ধরা না পরলেও ১০ থেকে ১৫ বছর পর ঠিকই তা মানুষের চোখে ভেসে উঠবে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রবাসীরা যেমন তহবিল গঠন, স্বীকৃতি আদায়, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে গুলোর ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তেমনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার জন্য তাদের কোনো জুড়ি নেই। আজ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের যে খবর শোনা যায় তা বস্তুত প্রবাসীদেরই ঘামের ফসল। তাই দেশকে বা দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার ক্ষেত্রে তথা হেনরি কিসিঞ্জারের “বটমলেস বাস্কেট”কে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে অন্য অনেকের মতো প্রবাসীদের ভূমিকা মোটেও কম নয়।

এ মধ্যম আয়ের দেশ একদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হবে বলে আমি দৃঢ় ভাবে আশাবাদী। তবে এ জন্য চলমান উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রেখে বিশেষ কিছু বিষয়ের প্রতি বিশেষ ভাবে মনোযোগী হতে হবে।

প্রথমত- অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নৈতিক উন্নয়নের বিকাশ সাধন ঘটাতে হবে।
দ্বিতীয়ত- দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে।
তৃতীয়ত- ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের সংযত ও পরিমার্জিত ভাষায় কথা বলতে হবে।
চতুর্থত- শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত রাজনৈতিক টাউট বাটপারদের আসকারাতো নয়ই, বরং ওদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।
পঞ্চমত- দালাল, চাটুকার ও বকধার্মিক থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে।
ষষ্ঠত- প্রশাসন ও বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে।
সর্বোপরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তবেই বাংলা যেমন সোনায় পরিণত হবে তেমনি স্বাধীনতার গর্ব নিয়ে প্রথম বিশ্বের (First World) দেশ গুলোর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

লেখক- কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিসট
shajed70@yahoo.com

Facebook Comments Box