সাজেদুল চৌধুরী রুবেলের গল্প “ক্ষমা ভিক্ষা”

0
1180
Cover Photo of story IBT
Kkhoma vikkha

সাজেদুল চৌধুরী রুবেলের গল্প

“ক্ষমা ভিক্ষা”

ফজরের নামাজ পড়ে গাজী সাহেব মসজিদ থেকে বেরুলেন। পূবাকাশে তখনো সূর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েনি। আলো আঁধারি ভাবটা কেটে যায়নি। তবে সাদা সাজের ভাঁজে ভাঁজে ঈষৎ রক্ত বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। একটু একটু বাতাস বইছে। সকাল বেলার হিমশীতল এ বাতাস হৃদয়কে বেশ সতেজ ও প্রফুল্ল করে তোলে। হৃদয়ের এ প্রফুল্লতা নিয়ে প্রতিদিন সকালে তিনি হাঁটেন। মর্নিং ওয়াক করেন।

আজও হাঁটছেন। এ সময়ে হাঁটতে খুবই ভালো লাগে। রাস্তাঘাট নীরব নিস্তব্ধ থাকে। দু একটি রিক্সার টুং টাং শব্দ ছাড়া তেমন কোনো শব্দ ও বায়ু দূষণের মতো ভারী যানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়না। গাজী সাহেবের হাঁটার এ অভ্যেস আজকের নতুন নয়। তিরিশ বছর আগে থেকে তিনি হাঁটা শুরু করেছন। এ জন্যই মাশাল্লাহ তার শরীর স্বাস্থ্য ভালো। ডায়াবেটিস, কলেস্টরল বা প্রেসারের মতো বজ্জাত রোগ সমুহ তাকে কাবু করতে পারেনি। এ বয়সে এসেও ঘোড়ার মতো দৌড়ে বেড়ান। ছেলেবেলায় সাইকেল রেসে ফার্স্ট হতেন। এখনো যে কোনো তেজোদীপ্ত তরুণকে হারিয়ে দেবেন অবলীলায়। শারীরিক ভাবে যেমন তিনি শক্তি সামর্থ্যের অধিকারী তেমনি মানসিক ভাবেও বেশ দৃঢ় প্রত্যয়ী। এমন একজন দৃঢ় প্রত্যয়ী লোকের মনই সেদিন হু হু করে কেঁদে উঠলো যখন দেখতে পেলো তার মতো বয়সী এক বুড়ো চটের বস্তা পরিহিত অবস্থায় কনকনে শীতের সকালে খোলা আকাশের রাস্তায় কাতরাচ্ছে।

গাজী সাহেব যে শহরে বসবাস করেন সেখানে এমন চিত্র নতুন নয়। শুধু ওই শহরে কেনো, পুরো দেশেই এমোন চিত্রের অভাব নেই। সবাই এসবের সাথে কমবেশি পরিচিত। তবু গাজী সাহেবের আবেগসিক্ত অন্তরাত্না কেনো জানি কেঁপে উঠলো। পঞ্চাশ বছরের আগের ইতিহাস মনে পড়ে গেলো। প্রৌঢ়া দেশটার প্রতি তাকিয়ে তার বেশ কষ্ট হলো। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরেও এমন চিত্র দেখার জন্যই কি তাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন? জীবন বাজি রেখে পাকিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন?

গাজী সাহেব তখন কলেজের ছাত্র। ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে যে কজন তুখোড় ছাত্র নেতা ছিলেন তার মধ্যে তিনি অন্যতম। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শুনার পর তার ইন্দ্রিয়ে বিদ্যুত তরঙ্গ খেলে গেলো। “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” কথা গুলো তার কানে অমর কাব্য হয়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। গ্রামে ফিরে গেলেন। যুদ্ধ আসন্ন বুঝতে পেরে গ্রামের মানুষকে জাগিয়ে তুললেন। প্রস্তুতি নিতে বললেন। পঁচিশে মার্চের কালো রাতের খবর ছড়িয়ে পরার পর গাজী সাহেব নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। বঙ্গবন্ধুকে পাকি সেনারা বন্দী করে নিয়ে গেছে শুনে ভেঙ্গে পড়েন। কিন্তু ভেঙ্গে পড়লে তো চলবেনা। মহান নেতা যে মন্ত্র দীক্ষা দিয়ে গেছেন সে দীক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে। দেশকে স্বাধীন করতে হবে।

গাজী সাহেব আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখলেন। মানুষ সম্ভবত নিজের চেহারাটাই সবচেয়ে বেশি কম দেখে। অথচ নিজেকেই সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। গাজী সাহেবও কি তাই? তিনি কাকে বেশি ভালোবাসেন? নিজেকে? দেশকে? মাকে? নাকি ওই জয়াকে? নাহ, তিনিও নিজেকেই বেশি ভালোবাসেন। নিজেকে ভালোবাসেন বলেই তিনি মা, জয়া ও দেশকে ভালোবাসতে পেরেছেন। নিজেকে ভালোবাসেন বলেই মায়ের আদর ও জয়ার ভালোবাসাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে যুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন।

গাজী সাহেবের বাবা নেই। মারা গেছেন অনেক আগেই। মা’র একমাত্র কলিজার ধন তিনি। তাই মা তাকে যুদ্ধে যেতে দিবেন কিনা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছেন। যেভাবেই হোক মাকে রাজি করাতে হবে। তাই পঁচিশে মার্চের কালো রাতের ভয়াবহতার কথা মাকে বিশদ ভাবে বর্ণনা করলেন তিনি। শ্রমজীবী মানুষরা যে যেখানে যে অবস্থায় ছিলো সেভাবেই সেখানে মারা গেছে। শহীদ মিনারকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউনিভার্সিটি চত্বরে শুধু রক্ত আর রক্ত। মৃত মানুষ গুলোকে দেয়া হয়েছে গনকবর যেগুলো দেখতে অনেকটা ঢিবির মতো। ওখানে কারো হাত, কারো পা, কারো মাথার অংশ পুঁতে রাখা হয়েছে। মাকে এসব বলতে বলতে গাজী সাহেবের কন্ঠ ভারী হয়ে এল। এবার মা’র দিকে তাকিয়ে বললো, “বলতো মা, এ অবস্থায় আমার কি করা উচিত?”

ছেলের মনের অবস্থা মা আঁচ করতে পারেন। কিন্তু ছেলে যে তাঁর সাত রাজার ধন। চোখের মনি। বাবার একমাত্র আমানত। এ ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়ে তিনি বাঁচবেন কি করে? তবু ছেলেকে তা বুঝতে দিলেন না। দৃঢ় অথচ স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, “তাহলে তুমি কি চাও?” গাজী সাহেব কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, জানি মা তুমি খুব কষ্ট পাবে। তবু আমি যুদ্ধে যেতে চাই। প্রতিশোধ নিতে চাই। দেশকে শত্রু মুক্ত করতে চাই” মা’র চোখ ছলছল করছিলো। কান্না চাপিয়ে তিনি বললেন, “প্রত্যেক মা স্বার্থপর, আমিও স্বার্থপর। তবু আমার একমাত্র ছেলেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করতে বিন্দু মাত্র কুণ্ঠিত নই। যাও, বীরের মতো যাও। যদি মরতে হয় বীরের মতো মরো, আর যদি ফিরে আসতে পারো তবে বীরের মতোই ফির।”

এবার জয়ার পালা। ওকে কি করে রাজি করা যায়! পাগলের মতো ভালোবাসে গাজীকে। স্কুল জীবনের প্রেম। গাজী যখন ম্যাট্রিকে পড়ে তখন জয়া ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। তখন থেকেই তাদের প্রেম। টুকটাক অংক শেখাত গিয়ে গাজী সাহেব প্রেমের জটিল অংকে জড়িয়ে পড়েন। একই নদীর অভিন্ন স্রোতে মিশে যায় দুটো সত্তা। জয়ার কতো আশা, পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে রচনা করবে তারা ভালবাসার ময়ূর সিংহাসন। এ আশা ও স্বপ্নকে তিরোহিত করার কোনো অধিকার গাজী সাহেবের নেই। কিন্তু তাকে যে যুদ্ধে যেতেই হবে। জয়া কি তা মেনে নেবে? মোটেও না। কিছুতেই জয়া তাকে যুদ্ধে যেতে দেবে না। তাই গাজী সাহেব মনস্থির করলেন, আপাতত জয়াকে যুদ্ধ যাবার কথাটি শুনাবেননা। সকল প্রস্তুতি শেষে যাবার দিন কেবোল তার সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে চলে যাবেন। বিদায় মূহুর্তে জয়া বাধা দেয়ার খুব বেশি একটা সময় ও সুযোগ কোনোটাই পাবে না।

এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে গাজী সাহেব যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। মা ও জয়াকে এভাবে রেখে যেতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিলো তার। মা বার বার আঁচলে চোখ মুছছিলেন। আর জয়ার কি কান্না! তার আহাজারি ও আর্তনাদে যেনো আকাশ ভারী হয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই তাকে থামাতে পারেনি। দেশ বাঁচাতে না পারলে শুধু নিজেরা বেঁচে থেকে কি লাভ? পরাধীন দেশে এ ভালোবাসারই বা কি মূল্য?

যুদ্ধের মাঠে গাজী সাহেব কতো সহযোদ্ধাকে হারিয়েছেন, কতোজনের প্রাণ যেতে দেখেছেন তার কোনো ইয়ত্বা নেই। নিজেও কতোবার সাক্ষাত আজরাঈলের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন তা হিসেব করা মুস্কিল। সবসময় তার মা’র ওই কথাটা মনে করতেন, “যদি মরতে হয় বীরের মতো মরো” তাই তিনি কখনো ভয় পেতেন না। পিছ পা হতেন না। তার প্রখর আত্মবিশ্বাস ছিলো, আজ না হয় কাল দেশ একদিন স্বাধীন হবেই।

সত্যি দেশ একদিন স্বাধীন হলো। ষোল ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিদের আত্মসমর্পণের খবর ইতারে ভেসে এলো। চারিদিকে আনন্দের জয়ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো। বিজয়ের গৌরব নিয়ে গাজী সাহেব বাড়ি ফিরলেন। মাকে জড়িয়ে ধরলেন। ছেলেকে এতোদিন পরে ফিরে পেয়েও মা তেমন আনন্দ প্রকাশ করলেন না। গাজী সাহেবের ভেতরে কামড় দেয়। জয়া কেমন আছে জানতে চায়। মা কোনো উত্তর দেননা। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। গাজী সাহেব আরও বেশি অস্থির ও উত্তেজিত হয়ে উঠেন। প্লিজ মা, বলো জয়ার কি হয়েছে?

মা কি উত্তর দেবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু সত্যকে তো মিথ্যে দিয়ে চাপা রাখা যায়না। তাই কোনো রকমের ভনিতা ছাড়াই মা বেশ দৃঢ় কন্ঠে বললেন, দেখো বাবা জীবনে যা ঘটার নয় তাই অনেক সময় ঘটে যায়। ভাগ্যবিধাতার উপর কারো হাত নেই। জানি, তোমার খুব কষ্ট হবে। তারপরও আমাকে সত্য কথাটাই বলতে হচ্ছে। কুতুব বেপারীর সহযোগিতায় জয়াকে মিলিটারিরা বাজারের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে সে ফিরে আসেনি। জানিনা সে বেঁচে আছে না মরে গেছে। কথাটা শুনে গাজী সাহেব হাজার ভোল্টের বিদ্যুত শক্ড খেলেন। তার মাথায় যেনো আসমান ভেঙ্গে পড়লো। জয়া ছাড়া তার বেঁচে থেকে লাভ কি!

দিন শেষে সবাইকে সবকিছু মেনে নিতে হয়। কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না। গাজী সাহেবের জীবনও থেমে থাকেনি। তাকেও সামনের দিকে অগ্রসর হতে হয়েছে। নতুন ভাবে বাঁচতে হয়েছে। কিন্তু এ বাঁচা যে তাকে এভাবে পীড়া দেবে কে জানতো! যুদ্ধে যদি তিনি শহীদ হয়ে যেতেন তবু ভালো ছিলো। আজ দেশে যা দেখতে পাচ্ছেন তা তার দেখতে হতোনা।

গাজী সাহেবের জীবনের গল্পের মতো লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার জীবনে এমন করুন গল্প লুকিয়ে রয়েছে। দেশের জন্য তারা যে ত্যাগ তিতিক্ষা করেছেন তাকি এমন দেশ গড়ার জন্য? এমন সোনার বাংলা দেখার জন্য?

এক কালে দেশ সামরিক শাসকরা শাসন করেছে। স্বৈর শাসকরা শাসন করেছে। তাদের কথা আলাদা। শেখের ব্যাটির কাছ থেকে তো এমনটি আশা করা যায়না। হ্যাঁ এ কথা সত্য তিনি মুক্তিযুদ্ধাদেরকে দান অনুদান দিচ্ছেন। ভাতা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তিনি অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সহ অগণিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন ছিলো সে সোনার বাংলা গড়ার মূল মন্ত্র থেকে তিনি অনেক দূরে। নৈতিক শিক্ষার উন্নয়ন দেশে ঘটেনি। যদি এ ক্ষেত্রে সফল হতে পারতেন তাহলে দেশে ভুখা নাংগা থাকতোনা। দেশ স্বাধীনের এতোদিন পরেও ওই বৃদ্ধের মতো কাউকে চটের বস্তা পরে খোলা আকাশের নিচে প্রচন্ড শীতে কাতরাতে হতোনা। খোদ বঙ্গবন্ধুর মেয়ে ক্ষমতায় থাকা সত্বেও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ভাঙ্গার দুঃসাহস দেখাতে পারতো না। কিংবা ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে যে এতো চেঁচামেচি তাও করতে পারতো না। তাছাড়া যে দেশটি স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছর পরও অর্থনৈতিক মুক্তি পায়নি, সয়ংসমপূর্ন হতে পারেনি, যার দিকে তাকালে এখনো বড্ড মায়া হয় সে দেশে ভাস্কর্য নির্মাণ কি খুব জরুরী? ভাস্কর্য বানিয়ে কি বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দেখাতে হবে? হৃদয়ে ধারণ করতে হবে? বঙ্গবন্ধুকে মনে রাখার জন্য এসবের কিছুই দরকার নেই। তিনি থাকবেন চিরদিন মানুষের হৃদয়ে। ইতিহাসের পাতায়।

বিশেষ কোনো দিবস টিবস এলেই গাজী সাহেবের মন ভারী হয়ে ওঠে। জয়ার কথা মনে পড়ে। সহযোদ্ধাদের কথা মনে পড়ে। শহীদদের কথা মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার চেহারা ভেসে ওঠে। এখন আর সভাসমাবেশে যাননা। স্মৃতি সৌধে যাননা। একা একা ঘরে বসে থাকেন। হালকা আওয়াজ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই অমর ভাষণটি শুনেন। আবেগাপ্লুত হন। কিছুক্ষণ কান্না করেন। উল্টো পথে দেশ হেঁটে চলার জন্য তিনি ক্ষমা ভিক্ষা চান। ক্ষমা করো হে প্রিয় জনক, ক্ষমা করো হে মহান চতুষ্টয়, ক্ষমা করো হে বীর শহীদান।

লেখক- প্রাবন্ধিক, কলামিসট, কবি ও গল্পকার।

Facebook Comments Box