শান্তির আশ্রয়

0
1077

লিখেছেন SHAJEDUL CHOWDHURY

জমিলার কোলে তিন মাসের শিশু সন্তান। বেশ নাদুসনুদুস। চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর মুখখানা। সে মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জমিলা। গন্ড বেয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে বেদনাশ্রু। কি জবাব দেবে তার সন্তানকে! বড়ো হয়ে সে যখন জানতে চাইবে কে তার বাবা, কি তার পরিচয় তখন কি বলবে ছেলেকে! কে বাবা? বাবা না ছেলে? ছেলে না বাবা? জমিলার জীবনটা এ রকম হলো কেনো? সেও তো আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই বাঁচতে চেয়েছিলো। তারও তো স্বপ্ন ছিলো। রংঢং করে বিয়ে হবে। লাল বেনারশি গায়ে জড়াবে। মেহেদী রাংগা হাতে পড়বে রেশমি চুরি। স্বামী আলতো করে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে আদর করবে আর সে তার দরাজ বুকে মাথা রেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেবে। তাদের বুক জোরে আসবে ভালোবাসার সোনালি ফসল। কিন্তু নিয়তি কেনো তাকে নিয়ে হাসলো এমন ক্রোঢ় হাসি। আচ্ছা, আল্লাহ কি কেবোল ওই ধনবানদেরই! গরিবের আল্লাহ বলতে কিছু নেই। আল্লাহ কি পয়সা খায়? ঘুষ খায়? পয়সাওয়ালারা যখন পশু হয়ে ওঠে, ওদের পশুত্বে যখন প্রকৃতিও লজ্জা পায় তখনো আল্লাহ নির্বিকার বসে থাকেন। এ কেমন তার লীলাখেলা! এ কেমন বিচার! সহসা জমিলার ভেতরের আরেকটি সত্তা জেগে ওঠে। ছি ছি পাপাবেগের মোহে জমিলা এসব কি ভাবছে! সে চৈতন্য ফিরে পায়। বাস্তবতার সিড়িতে পা ফেলে। ঠিকইতো সে এসব কি ভাবছে! অবশ্যই আল্লাহ আছেন। আল্লাহ আছেন বলেই লুত নবীর আমলে তিনি পাপিষ্ঠদের ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। নুহ নবীর আমলে প্লাবনে ভাসিয়েছিলেন। আবার ইব্রাহিম (আঃ) কে আগুন থেকে, ইউসুফ (আঃ) কে কূয়া থেকে এবং আমাদের সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কে মাকরাশার জাল বুনে দিয়ে শত্রুদের ক্রোধ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। আল্লাহ আছেন বলেই সমাজ যখন তাকে অচ্যুত অপবাদ দিয়ে ধূর ধূর করছিলো, অপবাদ সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলো তখন ফেরেশতার মতো একজনকে পাঠিয়ে তাকে রক্ষা করেছিলেন।

জমিলা তখন দুচোখে অন্ধকার দেখছিলো। আপন বলতে কেউ নেই। কোথাও দাঁড়াবার জায়গাটুকু তার ছিলোনা। এ পৃথিবীর সবাই যেনো তাকে হেয় আর ঘৃণার চোখে দেখছিলো। তার কথা কেউ শুনতনা। মনে হতো তার কথা শুনা বা তার দিকে তাকানোও পাপ। এমন দুর্বিষহ জীবনের ভার সে যখন আর সইতে পারছিলোনা ঠিক সে মুহূর্তে সগীর ফেরেশতার মতো ডানা মেলে তার কাছে আসে। আত্মহত্যার নির্মম গ্লানি থেকে বাঁচিয়ে তার ডানায় করে নিয়ে এলো নতুন গন্তব্যে। নতুন পৃথিবীতে।

সোনার চামুচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি জমিলা। এক হতদরিদ্র অভাগা পরিবারে তার জন্ম। বাবা দিনমজুর। মা মানুষের বাড়িতে কাজকাম করতো। তবু মা বাবার আদুরে দুলালি সে। চৈত্র মাসে যখন বান্নি (মেলা) হতো তার বাবা তাকে নিয়ে গিয়ে জিলাপি খাওয়াতো। আঙ্গুরভাজা কিনে দিতো। লাল রংয়ের ফিতা কিনে দিতো। কিন্তু তার সে সুখও বেশি দিন টেকেনি। অনেকদিন ধরেই অসুখবিসুখে ভুগছিলো তার বাবা। হঠাৎ একদিন পরপারে পাড়ি জমায়। বাবার কতো ইচ্ছে ছিলো মেয়েকে যে করেই হোক হাইস্কুল পাস দেওয়াবে। কিন্তু খোদার ইচ্ছের উপরে কি কারো হাত আছে! আল্লাহ যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। পড়াশুনা আর এগুতে পারেনি। নয় বছরের মেয়েকে নিয়ে পেটের ভাত যোগানোই মায়ের জন্য কষ্টের। মেয়ে বিদ্যান হবে সে স্বপ্ন কি তাদের জন্য? বাবা তো একমাত্র ভিটেটা ছাড়া আর কিছুই রেখে যায়নি। ওই ভিটেটাই তাদের সম্বল। সে ভিটেও আর ধরে রাখতে পারেনি। বাবার শেষ স্মৃতিচিহ্নটাকেও হারিয়ে ফেলে। মা মেয়ে কষ্টশিষ্ট করে যেভাবেই হোক দিন পার করছিলো। কিন্তু নিয়তির অমোঘ নির্মোহ থেকে রক্ষা পায় সে সাধ্য কার! বাবা মৃত্যুর কয়েক বছর পর মাও হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। গ্রামে কিছু দিন কবিরাজী চিকিৎসা চালায়। কিছুতেই কিছু হয়না। শহরে নিয়ে চিকিৎসা করাবে সে পয়সাও নেই। অবশেষে মাতব্বর চাচার কাছে কিছু টাকা ধার চায়। ধারের কথা শুনে তিনি যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। পাগল মেয়ে বলে কি! এ সময়ে কি ধার দেয়ার সময়? চারদিকে লোকজন জমিক্ষেতি রাখছে। তিনি নিজেও মানিক মিয়ার বিশ কাটা জমি রেখেছেন। ওই টাকা পরিশোধ করতেই তার হিমশিম খেতে হচ্ছে। ধার দেবে কোত্থেকে? টাকা কি গাছে ধরে? জমিলা অনেক অনুনয় বিনয় করলো। কান্নাকাটি করলো। তার আর্তচিৎকার ও কান্নায় পাথর বিগলিত হলেও পাষান্ড মাতাব্বরের পাষান হৃদয় গলেনি। পরিশেষে মাথা গুজাবার যে ভিটেটুকু ছিলো তাও আধাদামে মাতব্বরের কাছে বিক্রি করে দেয়। 

কপালপুড়া জমিলা। এতো চেষ্টা করেও মাকে বাঁচাতে পারেনি। বাবাকে হারিয়েছে সেই ছোটবেলায়। বাবা, মা ও ভিটে হারিয়ে সে আজ নিঃস্ব। কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই। মা’র বড়ো ইচ্ছে ছিলো মরার আগে মেয়েটাকে কারো হাতে তুলে দিয়ে যাওয়ার। নিয়তি সে সুযোগ দেয়নি। সতেরো বছরের জমিলা। দেহে তার কাঁচা যৌবনের নীল রুপোলি ঢেউ। সবারই ক্ষুধার্ত চোখ কেবল ওই দিকে। সুযোগ পেলেই দাঁত বসিয়ে দেবে। এ পাশবিক লোলুপ দৃষ্টি থেকে কে তাকে মা’র মতো আগলে রাখবে? ভেবে চিন্তে একমাত্র স্বজন মামার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। অদৃষ্টের কষ্টি পাথরে হতভাগীনী হিসেবে যার নাম লিখা রয়েছে তা বদলানোর সাধ্য কি তার! তাকে দেখেই মামা মামী দুজনেই বারুদের মতো জ্বলে উঠলো। ব্যগ্র কন্ঠে অপবাদের তীর ছুড়তে লাগলো। ছেলেপুলে নিয়ে তারা তাদের মতো করে আছে। অগত্যা এ আপদ কোন শনি ডেকে আনে কে জানে! এ অপয়াকে এখানে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। 

দমফাটা অবস্থায় কোনো রকমে রাতটা কাটালো জমিলা। একমাত্র সম্বল একটি কাপড়ের পোটলা হাতে নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লো। কোথায় যাবে জানেনা। রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলো। একটি গন্জে গিয়ে থামলো। ওখান থেকে কেবল নৌপথে চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে একটি ট্রলারে চেপে বসলো। কয়েক ঘন্টা পর ট্রলারটি শেষ গন্তব্যে পৌঁছালো। সব যাত্রী যার যার মতো নেমে গেলো। জমিলা নামেনি। ট্রলারের ভেতরই বসে রইলো। কোথায় যাবে, কি করবে ভেবে পাচ্ছিলোনা। এমন সময় ট্রলারের সারেং তাকে দেখে জলদি নেমে যাওয়ার তাগাদা দিলো। ট্রলার আর সামনে যাইবনা, তুমি ওহনো বইয়া আছ ক্যারে? তাড়াতাড়ি নাম্যা পড়। করুন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো জমিলা। কিছুই বললো না। কাপড়ের পোটলাটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লো। 

নতুন জায়গা। ভয় ভয় লাগছে। বিশাল বাজার। বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধনু নদী। এ নদীটিই সিলেটে গিয়ে নাম ধারণ করেছে সুরমা আবার দক্ষিন পশ্চিমে ভৈরবের দিকে নাম ধারণ করেছে মেঘনা। উত্তর পূর্ব ও দক্ষিণ পশ্চিম সব দিক থেকে অতি সহজেই লোকজন নদীপথে মালামাল নিয়ে বাজারে পৌছাতে পারে। লন্চ, কার্গো জাহাজ সহ বিভিন্ন নৌযান ভীড় জমায় প্রতিদিন। রংবেরঙের লোকের আড্ডাখানা এ লেপসিয়া বাজার। এমোন একটি বাজারে পা ফেলে থমকে যায় জমিলা। মনে হতে লাগলো, সবাই যেনো তাকে চেয়ে চেয়ে দেখছে! কোথায় যাবে কোথায় উঠবে কিছুই ঠিক করতে পারছে না। ক্ষিদেয় পেট ছু ছু করছে। কিছু খাওয়া দরকার। হাঁটতে হাঁটতে পুড়ি সিংগারার একটি দোকান চোখে পড়লো। দ্বিধা কাটিয়ে ঢুকে পড়ে এর ভেতর। দেখতে পেলো ওখানে কেবল পুড়ি সিংগারাই নয়, ভাত, মাছ, ডাল মিষ্টি পরোটা সবই আছে। মিষ্টি দেখে জিহ্বায় পানি এসে গেলো। ছোট বেলায় বাবা খাওয়াতো। এরপর আর কখন খেয়েছে তার মনে নেই। আজ আর লোভ সামলাতে পারলোনা। দুটো মিষ্টি সহ একটি পরোটা খেলো। গদ গদ করে পেট ভরে পানি খেলো। আবার কখন খাবার জোটে কে জানে! 

জমিলা যখন খাচ্ছিলো হোটেলের বেয়ারা গুলো কেমন কেমন করে যেনো তাকাচ্ছিলো। ক্যাশে বসে থাকা লোকটাও কম বদ-না। মিন মিন করে তাকায়। ভাবটা এমন যেনো তার মতো ভদ্রলোক আর নেই। জমিলার চোখাচোখি হতেই এক পাগলী দোকান থেকে সিংগারা নিয়ে দৌড়ে পালায় । হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। বেয়ারারা পিছু নিতে চায়। কিন্তু তিনি থামিয়ে দেন। ঠিক ওই সময় জমিলার মাথায় একটি বুদ্ধি আসে। নিজেকে পাগলের ভান ধরে থাকতে হবে। ঠিক ওই পাগলীর মতো। তাহলে অন্তত শকুনদের শ্যান দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। 

পাগলের বেশে জমিলা নিজেকে বেশ ভালোই খাপ খাইয়ে নিয়েছে। চুল এলোমেলো করে, ময়লা কাপড় চোপড় পড়ে মলিন চেহারায় আনমনে নিজে নিজে ভির ভির করে পুরো বাজার জুড়ে ঘুরে বেড়ায় দিনভর। কপালে যখন যা জোটে তাই খায়। কোনোদিন আধা পেটে বা কোনোদিন সিকি পেটে ঘুমোতে যায়। ওইদিন পাগলীর পিছু নিয়ে ঘুমোনোর জায়গাটা খুঁজে নিয়েছে। উপরে টিনের চাউনি দেয়া বিশাল বড়ো ঘর। হাটবারে শুধু গরুর হাট হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য দিন খালি পড়ে থাকে। ভিক্ষুক, পাগল ও বাস্তুহারা শ্রেণীর লোকজন সহ কুকুর ছাগলের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এটি। সবার সাথে জমিলা এখানেই কয়েকদিন যাবত ঘুমোচ্ছে। দিনটা পাগলীনীর বেশে কোনোরকমে কাটিয়ে দিতে পারলেও রাত এলেই তার কষ্ট বেড়ে যায়। রাজ্যের দুশ্চিন্তা এসে মাথায় ভর করে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখ লেগে যায়। কিন্তু ঘুমোতে পারেনা। কখনো কুকুর ঘেউঘেউ করে ওঠে, কখনো বাজারের নাইট প্রহরী টর্চের আলো জ্বালিয়ে পুরো ঘর সমেত তাকিয়ে তুকিয়ে দেখবে সব ঠিকঠাক আছে কিনা কিংবা কেউ কেউ কখনো বাংলা মদ খেয়ে মাতালামি করবে, চেঁচামেচি করবে। এভাবেই আধো সজাগ আধো ঘুমের মধ্য দিয়ে রাতটা পার করতে হয়। 

হিসেব নিকেশ শেষ করে দোকান থেকে বেরুলেন সগীর ও মারফত আলী সাহেব। হাটের দিন বেচাকেনা অনেক বেড়ে যায়। তাই সব গুছিয়ে বেরুতে বেরুতে অনেক রাত হয়ে যায়। আজও তাই হলো। সগীর দোকানের সাঁটার লাগাতে যাবে ঠিক এমন সময় বাজারের অন্য প্রান্ত থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে এলো। মারফত সাহেব সগীরকে থামিয়ে নিজেই সাঁটারটি লাগাবেন ঈশারা দিয়ে দ্রুত ব্যপারটি জেনে আসার জন্য তাকে আদেশ দিলেন। মিনিট তিনেক পর সগীর দৌড়ে খবর নিয়ে এলো। পাশের গ্রামের বজলু মেম্বারের ছেলে মাতালবস্থায় এক পাগলীকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। “আল্লাহগো বাঁচাও, মাগো বাঁচাও” বলে আর্তনাদ করছে। তার কথা সে কানেই নিচ্ছে না। উপরন্তু নৈশপ্রহরী সহ উপস্থিত সবাই তামাশা দেখছে। এ কথা শুনে মারফত আলী দ্রুত ঘটনাস্থলে গেলেন। তাকে দেখে সবাই থতমত খেয়ে গেলো। মাতাল ছেলেটিও মাথা নুইয়ে রাখলো। মারফত আলী খুব দাপটে লোক। বাজার কমিটির সভাপতি তিনি। তার সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলে সে সাহস কার! তিনি কিছু বলার আগেই পাগলীকে ছেড়ে দেয়া হলো। এরপরও মারফত আলী খুব করে শাসালেন। “মিয়ারা তোমরা চাইয়া চাইয়া কিতা দেখতাছিলা? এই পুলার হাড্ডিগুড্ডি ফাডাইয়া ফাল্লানা ক্যারে?” বলেই মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সগীরকে ইংগিত করলেন। 

সগীর তখন অন্ধকারে পাগলীর চেহারাটা ভালো ভাবে খেয়াল করতে পারেনি। এবার কাছে থেকে দেখে সে আৎকে উঠলো। এতো সেই মেয়ে যে কয়েকদিন আগে দোকানে এসে মিষ্টি পরোটা খেয়েছিলো। ক্যাশে বসে থেকে সে তাকে দেখছিলো। একবার ওই মেয়ের চোখে তার চোখও পড়েছিলো। এবার সে বুঝতে পারলো এই মেয়ে মোটেও পাগলনা। নিশ্চয়ই কোনো কাহিনী আছে। পুরো ঘটনা সে মারফত আলীকে খুলে বললো। মারফত আলী এবার জমিলার দিকে তাকালেন। ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে। এসব সত্য কিনা মারফত আলী জানতে চাইলে সে “হু” সূচক মাথা নাড়ালো। মারফত আলী মনে মনে একটা কাজের মেয়ে খুঁজছিলো। তার স্ত্রী প্রায়ই কাজের মেয়ের কথা বলে। মারফত আলী সুযোগটা লুফে নিলো। জমিলাকে তার বাড়িতে থাকতে বললো। কাজ করবে, খাবে ঘুমোবে। নিজের বাড়ির মতো থাকতে পারবে। জমিলা কোনো আপত্তি করলো না বরং একটা কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে রাজি হয়ে গেলো। 

অবশেষে আল্লাহ জমিলার দিকে মুখ ফিরে তাকালেন। দুবেলা দুমুটো খেয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁইতো হলো। শকুনদের উৎপাত থেকেতো রেহাই পেলো। এর চেয়ে বেশি তার আর কি চাই! আল্লাহর দরবারে সে মনে মনে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো। কাজে জমিলার কোনো ফাঁকিজুকি নেই। আলসেমি নেই। রাত নেই দিন নেই যখন যা দরকার তখনই তা সে করে। কাপড় ধুয়া, ধান শুকানো, কলসি ভরে পানি আনা, গরুর গোবর শুকানো থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা সে করেনা। এতে তার খেদ নেই, কষ্ট নেই। তবু সে ভালো আছে। ক্ষুধার জ্বালা নেই, ঘুমানোর চিন্তা নেই। দিনভর কাজ করে, রাতে অন্তত নিশ্চিন্তে নিরাপদে ঘুমোতে পারে। 

রান্না ঘরের সাথেই একটি ঘর। এখানে ভাত তরকারির হাঁড়িপাতিল সহ রান্নাবান্নার সরঞ্জামাদি রাখা হয়। এ ঘরটিতেই ঘুমায় জমিলা। মাঝরাত পার হয় হয় মতো অবস্থা। জমিলা ঘুমোচ্ছে। গভীর ঘুম। স্বপ্ন দেখছে। মা এসেছে। কোলে ফুটফুটে এক শিশু বাচ্চা। একবার শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার জমিলার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। বুকফাটা কান্না। জমিলা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলোনা। মা’র কান্না দেখে তারও বুক ভেসে যাচ্ছিলো। মা মা বলে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের ভেতর সে কাঁদছিলো। এমন সময় তার গায়ে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো। কানে বাজতে লাগলো, কে যেনো অস্ফুট স্বরে ডাকছে “জমিলা, জমিলা”। ঘুমের ঘোর কাটছে না। তবু চোখ মেলে তাকালো। অন্ধকারে চিনতে না পেরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, কেলা, কেলা? মুখ চেপে ধরে বললো, চুপ, একবারে চুপ। এবার সম্মিৎ ফিরে পায়। বুঝতে পারে এটা মারফত আলীর কন্ঠ। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তার মাথায়। একি দেখছে সে! এও কি সম্ভব! ভয়ার্ত কন্ঠে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো, চাচা আমনের পায়ে পড়ি, দয়া কইরা আমার এমন সর্বনাশ করবাইননা। মারফত আলী এসবের কোনো কিছুই ভ্রুক্ষেপ করলো না। তার পশুসত্তা জেগে উঠেছে। হিংস্র নেকড়ের মতো হুল ফোঁটায় তার দেহে। জমিলা ভাষা হারিয়ে ফেললো। চিৎ হয়ে শুয়ে থেকে অসহায় দৃষ্টিতে দেখতে পেলো তার বুকে মারফত আলীর সাদা লম্বা দাড়ি গুলো কেবল দোল খাচ্ছে। পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে যাবার বেলায় মারফত আলী সাবধান করে গিয়েছে যদি এ ব্যাপারে জমিলা মুখ খোলে তবে তার জিব কেটে ফেলা হবে। 

পাশের রুমেই ঘুমায় মারফত আলীর অনার্স পড়ুয়া ছেলে সুহেল। কলেজ বন্ধ থাকায় কিছুদিন যাবত বাড়িতেই আছে। তার চোখেও ঘুম নেই। সম্ভবত প্রেমিকার সাথে চাটিং করছিলো। তার বাবা যখন জমিলার কাছে যাচ্ছিলো তখন সে টের পায়। বাবার পায়ের আওয়াজ তার কাছে খুবই পরিচিত। বিশ্বাস করতে পারছিলোনা সে। কিন্তু নিজের কানকে অবিশ্বাস করবে কিভাবে! শেষ পর্যন্ত বাবা ওই মেয়েটার সাথে…..। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে জমিলার মুখখানা। গরীব মেয়ে। ভালো কাপড়চোপড় পড়ে সুন্দর করে সাজলে আর দশটা সুন্দরী মেয়ের চেয়ে সেও কম না। যুবক ছেলে সুহেল। এসব ভাবতে ভাবতে তার ভেতরেও কামসত্তা জেগে ওঠে। ছি ছি সে এসব কি ভাবছে! বিবেকের রিপু গুলো তাকে বাঁধা দিচ্ছিলো। কিন্তু নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। অসুর সত্তার কাছে হেরে যায়। বাবার মতো সেও জমিলার কাছে যায়। জমিলার কোনো অনুনয় বিনয়ই তাকে থামাতে পারেনি। অশ্লীল তীরের রক্তক্ষরণে জমিলার ব্যথাতুর হৃদয়টা ঝাঁঝরা হয়ে গেলো। ছাব্বিশ বছরের শিক্ষা, আদর্শ ও নৈতিকতার নিষ্ঠুর কবর রচনা করলো সুহেল জমিলার অসহায় বুকে। 

বাপ পুতের এমন কান্ডে রাতের আঁধার লজ্জা পেলো। উঠোনের কুকুরটর চোখ ভেজে উঠলো। চাঁদ তারা মলিন হয়ে গেলো। বাঘ তার শিকারকে অর্ধ গ্রাস থেকে বমি করে বের করে ফেললো। গাছ পাথর পাখীকূল হু হু করে কেঁদে উঠলো। প্রকৃতি লজ্জায় মাথা নুয়ালো। সাত আসমান ভেদ করে আল্লাহর আরস কেঁপে উঠলো। তবু ওদের পাপিষ্ঠ হৃদয় কেঁপে উঠলোনা। অনুশোচনা হলোনা। অনুতপ্ত হলোনা। অন্যথায় দুজনেই নিশ্চিন্তে নাক ডেকে ঘুমোতে পারতোনা। 

মাস তিনেক পর জমিলা বুঝতে পারে সে মা হতে যাচ্ছে। গর্ভবতী। কিন্তু কথাটা কাউকে বলতে পারছিলোনা। একদিন উঠোনে ধান শুকোতে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়। সবাই ধরাধরি করে জমিলাকে ঘরে নিয়ে গেলো। তখন দাই বাড়ির মিছিলের মাও ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলো। কবিরাজ হেকিমের চেয়ে তিনিও কোনো অংশে কম নন। একশর মতো বাচ্চার প্রসব তার হাত দিয়েই হয়েছে। চেহারা দেখেই আলবৎ অনেক কিছু বলে দিতে পারেন। জমিলার মুখ দেখেই তিনি আন্দাজ করে ফেললেন। বলে উঠলেন, “আল্লা আল্লা এই ছ্যারিতো পোয়াতি।” সবাই বিস্ময় ভরে তাকালো মিছিলের মার দিকে। আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেনো মারফত আলীর স্ত্রীর মাথায়। তিনি জমিলার মুখের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিছিলের মার কথার সত্যতা নিরূপণের চেষ্টা করলেন। হতবিহ্বল জমিলা অনেকটা উদাস হয়ে যায়। আমতা আমতা করছিলো। কি বলবে? ওরা কি বিশ্বাস করবে আসল সত্য? এমন সময় মারফত আলী নদীতে গোসল করে বাড়ি ফিরলেন। উঠোনের তারে ভেজা লুঙ্গিটা রোদে শুকোতে দিতে দিতে আপন মনেই প্রলাপ বকছিলেন। দিনকাল যা পড়েছে! বেগুনা মহিলার দল আদবের লেহাজ মাত্র নেই। লজ্জা শরমের মাথা পুড়ে খেয়েছে। তোরা মেয়েছেলে মানুষ। গা গতর দেখিয়ে গোসল করার কি দরকার! আখিরাতের দুশমন! জাহান্নামের আগুনে পোড়ার কোনো ভয় নেই! 

মারফত আলী বাড়ি ফিরেছে বুঝতে পেরে ঘরে ঢুকার আগেই স্ত্রী লতিফা বেগম বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাগত কন্ঠে বলতে থাকলেন, কিতা বগর বগর করতাছুইন। না জান্যা না হুন্যা যে ছিনাল হুরিরে বাড়িত আন্যা জাগা দিছুইন হেতো পেট লাগাইছে। এহনই এর একটা বিহিত করুইন। মারফত আলীর ভ্রু কুঁচকে গেলো। যেনো আকাশ থেকে পড়লো। এইডা কিতা কইতাছ? এই হারামজাদী এমন কামডা কিভায় করলো? এরে বাড়ি থাইক্যা বাইর কইরা দিয়াম। হের আগে এর বিচার করতে ওইব। কঠিন বিচার! এই ব্যাভিচারের বিচার না করলে আল্লার কাছে দ্বায়ী থাহন লাগব। নামাজঢা পইড়াই। 

মসজিদের ইমাম সাব সহ পাড়ার আরও দুই চারজন মাতব্বর নিয়ে মারফত আলী শালিসীতে বসলেন। জমিলাকে ডেকে আনা হলো। উপস্থিত সবাই তাকে ছি ছি করতে লাগলো। কুৎসিৎ ভাষায় নসিহত করতে শুরু করলো। কেউ তার কথা কানে নিতে চাইলোনা। ইমাম সাহেব বললেন, “নাউজুবিল্লাহ, এর চেহারা দেখাও পাপ। একুশটা দুররা মেরে মাথা কামিয়ে এখনি গ্রামছাড়া করতে হবে।” মারফত আলী এবার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মিয়ারা আপনারার কেউর আপত্তি আছে নাহি?” না, না এইডাই এর উচিত শিক্ষা ওইব, সমস্বরে সবাই বলে উঠলেন।

আকাশে বাতাসে জমিলার ক্রন্দন রোল ভেসে উঠলো। কিন্তু এ কান্নার রোল পাষান হৃদয়কে টলাতে পারেনি। তার আকুলিবিকুলি মাটিচাপা পড়ে যায় নষ্ট সমাজের ওই যৌবনখেকোদের কদর্য ভাষণের ভেতর। ওদের জন্যই নির্মম ক্ষতির পথে আজ তার ভাগ্য। ভাগ্যের কুটিল বিধানে চিহ্নিত হয়ে গেছে যেনো তার নিয়তি। ভাগ্যদোষে অন্তরের সমস্ত তেজস্বিতা ম্লান আজ তার। যন্ত্রের মতো কাজ করেও জীবনের কোনো মানে খুঁজে পেলোনা। জীবন যেখানে এতোটা অসহায়, এতোটা অভিশপ্ত, এতোটা অর্থহীন সে জীবন রেখে তার লাভ কি? নদীতে ঝাঁপ দেবে। আল্লাহর মাল আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবে। কিন্তু চাইলেই কি পারা যায়! যে ভাগ্যবিধাতা চাঁদ সূর্য পৃথিবী ভূমণ্ডল সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন, যার ঈশারা ছাড়া একটি গাছের পাতাও নড়েনা সেই মহাশক্তিধর মহা নিয়ন্ত্রকের ইচ্ছে ছাড়া কি তার কাছে যাওয়া যায়? সগীর এসে সামনে দাঁড়ালো। আত্মহত্যার মতো জগন্য পাপ থেকে তাকে বাঁচালো। 

ভৈরবের ছেলে সগীর। মিষ্টির কারিগর। মারফত আলীর দোকানে বেশ ক’বছর যাবত আছে। মিষ্টি বানায়। মাঝেমধ্যে ক্যাশে বসে। ধনুনদী খননকালে অনেক মাটি নদীর পাড়ে ফেলানো হয়। এমন উঁচু করে ফেলানো হয় যা ঘরবাড়ির ভিটে তৈরির উপযুক্ত হয়ে দাঁড়ায়। একসময় তা গুচ্ছ গ্রামে পরিণত হয়। নদীর তীরে গড়ে ওঠা ওই গুচ্ছ গ্রামের কোনো এক বাড়িতেই সগীরের বসবাস। জমিলা যখন নদীতে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলো সগীর তা দেখে ফেলে। দৌড়ে গিয়ে তাকে বাঁধা দেয়। জীবন বাঁচায়। জমিলার করুণ কাহিনী শুনে বেশ কষ্ট পায়। মর্মাহত হয়। বিশ্বাসই করতে পারছিলোনা। হেরা বুলি পড়াশুনা জানলেওয়ালা লোক। এরা এমন অসভ্য বর্বর হয় কি করে! ধিক এদের পড়াশুনার উপরে! মানুষ খারাপ ওয়, এতো খারাপ! কার কাছে যেনো সগীর শুনেছে, ধর্ষণের জন্য নাকি নতুন আইন হয়েছে। সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি। সে মনে মনে হাসে। কে ওই মুখোশধারী ধর্ষকদের ফাঁসি দেবে? আর ওদের জন্য কি কেবল ফাঁসিই যথেষ্ট? যদি তার হাতে ক্ষমতা থাকতো, তবে ওদেরকে ধরে এনে জনসমক্ষে গুলি করে হত্যা করতো। মাথাটা ঝুলিয়ে রাখতো যেনো মানুষ এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। কিন্তু অসহায়ত্বের বেড়িবাঁধে তার হাত পা বাঁধা। সে অক্ষম। এ অক্ষমতার জ্বালা নিয়ে জমিলাকে সাথে করে নিজ গ্রামে চলে যায়। সেই থেকে জমিলা সগীরের আশ্রয়ে আছে। তারই সহমর্মিতা ও সহযোগিতায় জমিলা আজ সন্তানের মুখ দেখতে পাচ্ছে। 

হাসিখুশি মন নিয়ে সগীর আজ বাড়ি ফিরলো। বাজারে একটা মিষ্টির দোকান খুঁজছিলো বহুদিন যাবত। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। আজ তার ব্যবস্থা হয়ে যায়। কিছু দিনের মধ্যেই নিজে দোকান নিয়ে বসতে পারবে। কিন্তু জমিলার চোখে অশ্রু দেখে তার মন ভারী হয়ে গেলো। আনন্দ দমে গেলো। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো- কিতা ওইছে জমিলা, কানতাছ ক্যারে? মা কি তোমারে কিছতুয়া কইছে? 

– ছি ছি মা কিতা কইবো! আমি কানতাছি আমার পুড়া কপালের কথা ভাব্যা। আমনেরা আমারে আশ্রয় দিছুইন, খাওয়াইতাছুইন পড়াইতাছুইন, বাচ্চাডারে দেখ্যা হুন্যা রাখতাছুইন, সারা জীবন গোলামি করলেও আমনেরার ঋন শূধ ওইবোনা। 

– এইডা কেমন কথা! একজন মানুষ হিসাবে খালি দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি। 

– হু মানুষ! হেরাও মানুষ আমনেও মানুষ! 

– রাহ এইতা। পিছের কথা ভুল্যা যাও।

– চাইলেই কি ভুল্যা যাওন যায়! পুলাডা যহন বড় ওইব আমি হেরে কিতা কইয়াম? বাপের পরিচয় জানতে চাইব যহন আমি কিতা উত্তর দিয়াম! 

– উত্তর দেওনের বহুত সময় আছে। হেই কথা তোমার এহন না ভাবলেও চলব। 

– আমনেরার বুঝা ওইয়া আমি আর কতদিন থাহাম? 

– এইডাও আমার চিন্তা। তোমার মাথা ঘামানোর দরহার নাই। মার সাথে কথা কইছি। এহন থাক্যা তোমার হুলা আমার পরিচয়েই বড় ওইব। 

কথাটা শুনে জমিলার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেলো। ইচ্ছে করলো সগীরের পায়ে মাথা রেখে চুমু খেতো। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, এই অপয়াকে যা করছুইন হেই যথেষ্ট। এর বেশি কিছু পাওনের যোগ্য আমিনা। 

– কেলা কইছে তুমি অপয়া? তুমি অপয়ানা। তুমি ওই নরপশুদের নির্মম শিকার। এই পচা সমাজের উলঙ্গ শিকার। নয়া কইরা তুমি আরও পশুত্বের শিকার হও হেইডা আমি চাইনা। তুমি নতুন কইরা বাঁচবা। আমি তোমারে হেই অধিকার দিয়াম। বলেই জমিলাকে বুকে টেনে নিলো পরম মমতায়। মনে দোলা দিয়ে উঠলো হুমায়ুন আহমেদের সেই গানটি। নিজের মতো করে একটু বদলিয়ে গুন গুন করে গাইলো, 

তুই যদি আমার হস আমি হইয়াম তর

কোলেতে বওয়াইয়া তরে করাম আদর। 

জমিলার বুকটা আনন্দে ভরে ওঠে। চোখে পানি চলে আসে। আনন্দের পানি। এমন আনন্দের দিন তার জীবনে আর একটিও আসেনি। এ আনন্দঘন মুহূর্তে তাই জমিলা সগীরের বুকে মাথা রাখলো। মনে হলো এ বুক তার একমাত্র আশ্রয়, শান্তির আশ্রয়। 

লিমরিক, আয়ারল্যান্ড 

১৫ অক্টোবর ২০২০

Facebook Comments Box