ম্যাগাজিন মোড়ক উম্মোচন, পুরুষবাদ ও নারীবাদ। সৈয়দ আতিকুর রব (শাহী)
গত ১৫ মার্চ ডাবলিনের একটি কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্টিত হয়ে গেল অনলাইন পোর্টাল আইরিশ বাংলা টাইমসের ১ম ম্যাগাজিনের মোড়ক উম্মোচন উৎসব। ২০১৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আইরিশ বাংলা টাইমসের নানাবিধ কার্যক্রম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তথ্য আকারে সংগৃহীত করে রাখার উদ্দেশ্যে তাদের এই মহতী উদ্যেগ অবর্ণনীয় প্রশংসার দাবীদার। উৎসব অনুষ্টানের সবকিছু ছিল সাজানো, গোছানো ও পরিপাটি। বিশেষ করে আইরিশ বাংলা টাইমসের একদল উদ্যমী, মেধাবী এবং সৃষ্টিশীল তারুণ্যে উদ্দীপ্ত সম্পাদক মন্ডলীর অসধারণ আয়োজনে মোড়ক উন্মোচনের সন্ধ্যাটি অনেকের স্মৃতির মিনারে অম্লান হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন। এই ধরণের অনুষ্টান করতে অনুপ্রেরণা যোগাবে অন্যদের।
আয়োজকদের জন্য এই ধরনের অনুষ্ঠান প্রথম হলেও তাদের সার্বিক প্রস্তুতিতে পেশাদারিত্বের ছাপ ছিল সেটি বলতেই হবে। অতিথি আপ্যায়ন সহ অনুষ্ঠান পরিচালনা ছিল অসাধারণ। মশিউর ভাইয়ের স্মার্ট উপস্থাপনা অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে। দূর থেকে ম্যাগাজিন বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে আমি ভেবেছিলাম আমেরিকার বিখ্যাত সেই “টাইম” ম্যাগাজিনের কপি এখানে কি করে এলো ?
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে যে কারণে এই অনুষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটি হলো কমিউনিটির গুণীজনদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের সাথে পরিচয় থাকলেও কমিউনিটির অনেকের সাথে আমার সরাসরি দেখা হয়নি। বলতে পারি,আমার পরিচয়ের জগত অত্যন্ত ছোটো। এই দেশে অনেকদিন ধরে থাকি অথচ দুই একজন ছাড়া কমিউনিটির অনেকের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ও নেই। সংগত কারনেই এই অনুষ্ঠানকে কোনোভাবে মিস করতে চাইনি।
সম্পাদক মন্ডলীর সদস্যরা ছাড়াও উপদেষ্টা কমিটির সদস্যবৃন্দ সহ সুধীজনদের কাছে থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল কথা শুনেছি।আমন্ত্রিত জ্ঞান ঋদ্ধ আলোচনায় সমসাময়িক প্রসঙ্গের পাশাপাশি উঠে এসেছে সংঘবদ্ধতা সুস্থ সংস্কৃতি- সাহিত্য চর্চা ও মানবিক কল্যাণে কর্মব্যস্ততার সর্বজনীন গুরুত্ব। ব্যক্তির উন্নয়ন ও সামষ্টিক জাগরণে যার সুদুরপ্রসারী ভূমিকা সর্ব স্বীকার্য সর্ব।
আইরিশ বাংলা টাইমসের পাঠকের উপলদ্ধি জগতকে আলোড়িত ও সংহত করার পাশাপাশি এ ধরনের অনুষ্ঠান কমিউনিটির চিন্তা রাজ্যে সৃষ্টি কল্যাণ তরঙ্গ যোগাবে আত্মবিকাশের পথে অক্লান্ত হেঁটে চলার সাহস ও শক্তি।
কেননা মু্ক্ত চিন্তা মনের জানালা খুলে দেয়। নতুন প্রেরণা যোগায়। মানুষকে আশাবাদী করে তোলে ভবিষ্যতের জন্য। একতা সততা দিয়ে বহু দূর যাওয়া যায। একসাথে থাকলে অনেক কঠিন কাজ সহজে জয় করা যায়। তারই প্রতিফলন ঘটেছে গুণীজনদের পরামর্শে। সবার বক্তব্যের ভেতর দিয়ে কমিউনিটির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার মর্মতা তীব্র আকারে আমি অনুভব করেছি। এই ধরণের সুন্দর সুন্দর কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের কমিউনিটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবার সামগ্রিক প্রচেষ্টার জয়গান হয়েছে পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে।
পূর্ব কোন অভিজ্ঞতা ছাড়া এই ধরনের একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে হাত দিয়ে সফলতার সাথে শেষ করা কতটা কঠিন কাজ,সেটি হয়তো আয়োজক ছাড়া অন্য কারও পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। উপলব্ধি করার কথাও নয়। ম্যাগজিন বইয়ের দিকে তাকালে বোঝা যাবে এর পেছনে কত শ্রম ও সময় ব্যয় হয়েছে।পৃথিবীতে কোন কিছুই পারফেক্ট হয় না। নিজের মত করে নিতে হয়। উদারতা দিয়ে ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো দেখলে তবেই সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব,নতুন কিছু পাওয়া সম্ভব।
বন্দনা, প্রশংসা,সমালোচনা ইত্যাদি বিষয়গুলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমাদের সমাজে একশ্রেণীর মানুষ রয়েছেন, যারা এই প্রবৃত্তিগুলো নিজের মধ্যে লালন করে অন্যের পথে কাঁটা হয়ে থাকতে পছন্দ করেন। আবার একশ্রেণীর মানুষ রয়েছেন যারা এগুলো কখনো গায়ে মাখেন না,পছন্দও করেন না। তারা সব সময় মানুষের ইতিবাচক কাজগুলোকে শ্রদ্ধার সাথে বরণ করেন।প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগীতা অকুন্ঠিত হতে বিলিয়ে দেন। তারা তিরস্কারের বিপরীতে দুই বাহুবলে সৃষ্টিশীল মানুষকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। তাই কোনো সমালোচনা এই শ্রেণীর মানুষের চলার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। রুদ্ধ করে রাখতে পারে না তাদের অগ্রযাত্রা। তারা দূর্বার, তারা দূর্জয়।
আমাদের সমাজে ভালো কাজের স্পৃহার চেয়ে সমালোচনার তীরটা অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ও তীব্র । এক শ্রেণীর মানুষ সব সময় প্রস্তুুত থাকেন কখন এবং কাকে খরধার তীরের আঘাতে বিদ্ধ করবেন। গঠনমূলক সমালোচনা সুস্হ সমাজ গঠনের জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য। কিন্তুু সমালোচনা যদি শুধু হয় মানুষকে মনোরঞ্জন দেবার জন্য, ঢাক-ঢোল পিঠানোর জন্য, তাহলে সেই সমালোচনা সমাজে বিভাজন ছাড়া ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসবে না ।
আইরিশ বাংলা টাইমসের মোড়ক উম্মেচনের অনুষ্টানকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি সমালোচনামূলক পোস্ট প্রত্যক্ষ করলাম। যেখানে আইরিশ বাংলা টাইমস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের একটি ক্ষুদ্র মূদ্রণ ভূলকে হাইলাইট করেছেন জৈনক ভদ্রলোক। কমিউনিটির সামাজিক কার্যক্রমে নারীদের সম্পৃক্তার বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি।
সেখানে দেখলাম কিছু নেতিবাচক মন্তব্যও এসেছে। আবার কিছু অসত্য তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। বলা হয়েছে, অনুষ্টানে নারীদেরকে বক্তব্য দেবার সুযোগ দেওয়া হয়নি। গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, চিরাচরিত পথ ধরে নারীদেরকে নাকি অবজ্ঞা করা হয়েছে। অশ্রদ্ধা করা হয়েছে। একটি অনুষ্টানে না গিয়ে শুধু একজন মানুষের মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে এই ধরণের নেতিবাচক মন্তব্য কোনো শিক্ষিত সমাজের কাছ থেকে শুনা খুবই দুঃখজনক ঘটনা।
পুরুষবাদ ও নারীবাদের মত ন্যাক্ষারজনক বিষয় সেখানে ঠেনে এনে একটি সফল অনুষ্টানের সার্বিক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। কমিউনিটির জন্য ভালো কাজের পরিণাম শেষ পর্যন্ত পুরুষবাদ ও নারীবাদের বিতর্কে জড়িয়ে পড়বে, সেটি ভেবে ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব খারাপ লাগছে।
অথচ অনুষ্টানের শেষের দিকে দুইজন ভদ্রমহিলা বক্তব্য রেখেছেন। আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন শহর ছাড়াও সূদর বেলফাস্ট থেকে নারী অতিথি এসেছেন।অনেকের দাওয়াত ছিল, ব্যস্ততার কারণে আসতে পারেন নি। এই মোড়ক উম্মেচন অনুষ্টানের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে একজন নারী ছিলেন। ম্যাগাজিন বইয়ের ভেতর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী লেখকদের লেখা গল্প ,কবিতা ও উপন্যাস থাকার পরও নারীদের প্রতি অবিচারের প্রশ্ন তুলা কতটা যৌক্তিক? নারীদের অশ্রদ্ধা করার বিষয়টি কতটা সঠিক? সেটি আমি বুঝতে পারছি না।
যাক, তবে আমি মনে করি যে কোনো কাজের আলোচনা- সমালোচনা থাকবে। সমালোচনার উর্ধ্বে কিছুই নয়। কিন্তুু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। যেহেতু আয়োজক কর্তৃপক্ষ অনুষ্টানের শুরুতে বার বার বলেছেন, এই ধরণের অনুষ্টান তাদের জন্য প্রথম এবং সেখানে অনেক ভূল-ত্রুটি রয়েছে। যেটি তারা অনুষ্টানের প্রারম্ভিকে স্বীকার করেছেন। সে- গুলোকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য সবার প্রতি তাদের সবিনয় নিবেদন ছিল। সহযোগীতা ও পরামর্শ দিয়ে তাদের কাজকে এগিয়ে নেবার জন্য কমিউনিটির প্রতি তাদের আকুল আবেদন ছিল।
এরপর এই বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাইলাইট করার কী প্রয়োজন ছিল? তাছাড়া এই ভদ্রলোক নিজেও উক্ত অনুষ্টানে উপস্হিত ছিলেন। এই ধরণের গঠনমূলক সমালোচনা অনুষ্টানের মঞ্চে হলে আয়োজক সহ উপস্হিত সুধীজনদের জন্য আরো ভালো হতো। যেহেতু সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। সমালোচনার অধিকার রয়েছে। সেহেতু ওনার মতের সাথে আমার মতের অমিল থাকলেও ওনার মতকে আমি শ্রদ্ধা করি। ওনার পরামর্শ গুলোকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করতে আমার অসুবিধা নেই।
কমিউনিটির সামাজিক কর্মকান্ডে নারীদের সম্পৃক্তার অবশ্যি প্রয়োজন রয়েছে। এর কোনো বিকল্প নেই। ধর্ম বলেন, কিংবা সমাজ বিজ্ঞানের কথা বলেন, সকল ক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের সমমর্যদার স্বীকৃতি রয়েছে।
নারী এবং পুরুষ উভয়ে একে অপরের পরিপূরক ও সম্পূরক। কেউ কারো প্রতিযোগী নয়, এক অপরের সহযোগী। বিরোধি অবস্হান নয়,উভয়ের ক্ষেত্রে সহবাস্হন হচ্ছে মানবিক মর্যাদার শ্রেষ্টতম স্হান। আজ অনেক নারীরা পৃথিবীর জয়গানে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিচ্ছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং গবেষণা দিয়ে মানবতার কল্যাণে মহিয়সী নারীরা যুগান্তকারী অবদান রাখছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। খেলাধূলায় পুরুষের পাশাপাশি দেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনছেন নারীরাও। তাহলে কে বলছে নারীরা পিছিয়ে?
সবার অভিজ্ঞতা যেমন সমান হয় না, তেমনি প্রত্যেক কাজে সব মানুষের আগ্রহ,উৎসাহ ও উদ্দীপনা সমান থাকে না। তাই কমিউনিটির সামাজিক কর্মকান্ডে অভিজ্ব নারীদের আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত। তাদের সুযোগ তৈরীর জন্য কমিউনিটির অগ্রজ পুরুষদের ভূমিকা রাখতে হবে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত চিন্তা- ভাবনার মধ্য দিয়ে হাজার-লক্ষ-কোটি ভাবনা সৃষ্টি হউক। পৃথিবীর প্রতিটি নগর ও জনপদ নারী-পুরুষের সমান কর্মব্যস্ততায় ভরে উঠুক। আমাদের সবুজ এই বিশ্ব নারী-পুরুষের আবিস্কারে আলোকিত হউক। নারী কিংবা পুরুষের পরিচয়ে নয়, মানুষ তার স্বীয় কর্মের গুণে পৃথিবীতে প্রতিষ্টিত হউক। নারীবাদ ও পুরুষবাদের মত ঘৃণিত মনস্তাত্ত্বিক
ধারণার অবসান হউক।
পরিশেষে আইরিশ বাংলা টাইমসের সম্পাদক মন্ডলীর সকল সদস্যবৃন্দ, যথাক্রমে;
প্রধান সম্পাদক: আব্দুর রহিম ভূ্ঁইয়া, বার্তা সম্পাদক: ওমর ফারুক নিউটন, নির্বাহী সম্পাদক: মশিউর রহমান, সহকারী সম্পাদক: কবীর আহমেদ, সোশ্যাল মিডিয়া সম্পাদক: শওকত আলী খান মাসুমকে প্রানঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি এমন একটি মনোরম সন্ধ্যা কমিউনিটিকে উপহার দেবার জন্য।
এর সাথে সাথে আইরিশ বাংলা টাইমসের উপদেষ্টা মন্ডলীর সকল সদস্যবৃন্দ সহ এর পাঠক, লেখক এবং শুভানুধ্যায়ীগনকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি , যাদের মহতী মিলনে অনুষ্টনাটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা সম্মানিত ভদ্রমহিলার প্রতি, যিনি নিজের কর্ম ব্যস্ততা থাকা সত্বেও সময় দিয়ে মোড়ক উম্মেচনের
অনুষ্টানকে সফল করতে সহযোগিতা করেছেন।
আসুন অনলাইনে এভাবে কাদা ছোড়াছুড়ি না করে বস্তুনির্ভর তথ্য-উপাথ্য, গঠনমূলক সমালোচনা, পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আমরা কমিউনিটির ভালো কাজগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। ধন্যবাদ
সৈয়দ আতিকুর রব (শাহী)