তোফাজ্জল সাহেব আজ আগে আগেই বাড়ি ফিরে এলেন। বিষয়টি তার স্ত্রীর কাছে বেশ খটকা লাগলো। এর আগে তিনি কতোবার তাকে আগে আগে বাড়ি ফেরার জন্য বলেছেন, কিন্তু কাজ হয়নি। এখন আর বলেননা। অভ্যেস হয়ে গেছে। তার কতো শখ ছিলো স্বামী বাড়ি ফিরে এলে বিকেলে এক সঙ্গে বসে চা খাবে, গল্প করবে, টিভি দেখবে, ছেলেকে নিয়ে হৈ হুল্লোর করবে। কিন্তু তোফাজ্জলের কাছে এ আবদারের কোনো দাম নেই। নিছক আবেগ ছাড়া আর কিছুইনা। এ আবেগের ধার তিনি ধারেন না। তাইতো কলেজ থেকে বেরিয়েই প্রতিদিন চলে যান চাস্টলে। সেখানে চেয়ারম্যান মেম্বার সহ স্থানীয় গন্য মান্য লোকেরা একে একে এসে ভিড় জমান। জমে ওঠে আড্ডা। রাজনৈতিক ও সামাজিক কথাবার্তার পাশাপাশি বিচার’শালিসীর কাজকামও সম্পন্ন হয় এসব আড্ডার মধ্য দিয়ে। সেই বিকেল থেকে সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত চলতে থাকে তাদের চায়ের পেয়ালায় ঝড়। আজ নিয়মের অনিয়ম ঘটলো। চেয়ারম্যান সাহেব কানে কানে কি বলতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
তোফাজ্জল সাহেব একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। বাংলার অধ্যাপক। জীবন যাপনে বেশ সাদামাটা। পাজামা পাঞ্জাবীই তার প্রধান পোশাক। কখনো স্ত্রী ইস্ত্রি করে দেন আবার কখনো ইস্ত্রি ছাড়াই পড়েন। পোশাকআশাকে ইদানিং তার কোনো বাতিক নেই। এককালে ছিলো। ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়াশুনা করতেন তখন কড়া ইস্ত্রি ছাড়া কোনো জামাকাপড় গায়ে তুলতেন না। চোখে দামী সানগ্লাস। আর এখন বুড়ো নিকেলের চশমা। ছাত্ররাজনীতি করতো। একটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলো। খুব ভালো বক্তৃতা করতে পারতো। তন্ময় হয়ে মানুষ শুনতো তাঁর বক্তব্য। কখনো কখনো ঘন্টা দেড় পার হয়ে যেতো তবু মানুষ টেরই পেতোনা। ঢাকার বাইরে যে কয়জন ছাত্রনেতাকে বক্তব্য দানের জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করে নেয়া হতো তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। প্রখ্যাত এ রাজনৈতিক বাগ্মির এক পর্যায়ে এসে রাজনীতি ছেড়ে দেন। যখন বুঝতে পারলেন, রাজনীতি আর নীতির রাজা নয়, রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই কিংবা রাজনীতি কেবল আখের গোছানোর একটা জমজমাট ব্যাবসা মাত্র তখন তিনি তা ত্যাগ করলেন।
কর্ম জীবনে শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে বেছে নিয়ে তিনি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করলেন। রাজনীতি ছেড়ে না আসলে হয়তো এমপি মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারতেন। কিন্তু যে রাজনীতি মানুষের ভাষা বুঝেনা, মানুষ বা মানবতার কথা বলেনা সে রাজনীতি তার জন্য নয়। এমন দীন, কর্দমাক্ত রাজনীতি তাকে মোটেও কাছে টানে না। তার মনের ভেতরে দোল খাওয়া রাজনীতি আর সমাজে চলমান রাজনীতি এক নয়। বরং তা রেললাইনের মতো সমান্তরাল। কোনো দিনই অভিন্ন আদর্শের কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হবার নয়। আদর্শের ভিন্নতার জন্য রাজনীতি ছেড়েছেন ঠিকই কিন্তু বক্তব্য ছাড়তে পারেননি। তবে তা মাঠ গরম করার মতো রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। অন্য রকম বক্তব্য। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কোন্নয়নের বক্তব্য। ছাত্রদের মনোন্নয়নের বক্তব্য। বস্তুত একজন ছাত্র যেনো উগ্রবাদী হয়ে না উঠে, ধর্ষকের কালিমা নিয়ে যেনো কোনো ছাত্রকে এ সমাজে বেঁচে থাকতে না হয় কিংবা একজন ছাত্র যেনো হতে পারে মানবতার আইকন তথা মানুষ ও মানবতার পুজারী তাই ফুটে ওঠে তাঁর বক্তব্যে।
প্রথম বর্ষের নবীন ছাত্রদের উদ্যশ্যে প্রায়ই তিনি একটি বক্তব্য দেন। আজও তার পুনরাবৃত্তি করলেন। প্রিয় ছাত্র ছাত্রী বৃন্দ, তোমরা সমাজের সূর সৈনিক। সূর্য সৈনিক। কোনো অদৃশ্য হাতের পুতুল বনে রাজনীতির নামে হত্যা, মারামারিতে লিপ্ত হওয়া তোমাদের কাজ নয়। সকাল হিংসা দ্বেষ ভুলে একই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে একটি প্লাটফর্মে দাঁড়ানোই তোমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তোমাদের রয়েছে এক মহিমান্বিত অতীত। ছাত্ররা যুগ যুগ ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়েছে, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছে জীবনের জয়গান, দেশ মাতৃকার জন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে করেছে অগ্নি উদ্গীরণ, বিষের পেয়ালা কন্ঠে করে করেছে অমৃত বর্ষণ, মৃত্যুর মন্দির সোপান তলে দিয়েছে প্রান। সক্রেটিস থেকে সাত্র এবং ফল এলোয়ার থেকে নজরুল পর্যন্ত এ দৃষ্টান্তের অভাব নেই। তাই তোমাদের পূর্বসূরিদের এ গৌরবময় ইতিহাস ভুলে গেলে চলবেনা। বরং তাঁরা যে মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে জাতির কল্যাণে নিজেদেরকে নিবেদন করেছে তোমাদেরকেও সে পথে হাঁটা বেশ জরুরি।
পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে ছাত্ররা তাঁর বক্তব্য শুনছিলো। বস্তুত একজন শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদেরকে জ্ঞান সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য তাঁর কোনো কৃপণতা নেই। তিনি বিশ্বাস করেন, উঠতি বয়সের এসব ছেলে মেয়েরাই জাতির একমাত্র ভবিষ্যত। এদেরকে নৈতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ করতে না পারলে, এদের মানষ পরিমণ্ডলের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা আমরা যতোই বলিনা কেনো সত্যিকারার্থে জাতির উন্নয়ন আদৌ সম্ভব নয়। সে আদর্শিক চিন্তা ভাবনা থেকেই তিনি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পুঁথিগত জ্ঞান ছাড়াও নৈতিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। তবে তার এ চেষ্টা যে পুরোপুরি সফল হচ্ছে তা নয়। না হলেই বা কি? পুরোপুরি সফল হচ্ছে না বলেতো আর হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা যাবেনা! চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তবে তার মতে, এ চেষ্টাটা যদি বাল্যকালে পারিবারিক ভাবে কিংবা প্রাইমারি লেভেলে স্বতস্ফূর্ত ভাবে করা যায় তবে তা নৈতিক শিক্ষার ভিতকে শক্তিশালী করতে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে।
কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করুয়া ছেলেমেয়েদের অনেকের মধ্যে গুরুভক্তি ভাবটা তেমন বেশি কাজ করেনা। ছোট বেলায় শিক্ষকের কথা শিক্ষার্থীদের মনে যেভাবে দাগ কাটে বড়ো হলে তা আর সেভাবে কাটেনা। এটা বুঝাতে খুব বেশি দূর থেকে উদাহরণ টানার দরকার নেই। তাঁর হাতেই রয়েছে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ। তাঁরই কিছু ছাত্র যাদেরকে তিনি মানবতার মন্ত্র শেখাতে সবসময় চেষ্টা করে গেছেন তারাই বিভিন্ন অনৈতিক কাজে কর্মে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলছে। তার বিরুদ্ধাচরণ করছে। তাঁকে অপমান অপদস্থ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। চেয়ারম্যান সাহেবতো কানে কানে ওই কথাটিই তাকে বলেছিলেন। অধ্যাপক সাহেবকে এ কথাটি জানিয়ে নিজের আসল চেহারাটা গোপন রাখার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু অধ্যাপক সাহেব তো আর বোকা নন। তিনি সবই বুঝেন। সকল অপকর্মের হোতা ও আস্কারাদাতা যে ওই চেয়ারম্যান তা বুঝতে তার বাকি নেই। তিনিই প্রকৃত নাটেরগুরু।
অধ্যাপক সাহেব রাজনীতি ছেড়ে দিলেও রাজনীতি তাকে ছাড়তে চায়না। তবে সে রাাজনীতি নষ্ট রাজনীতি। অপরাজনীতি। এ অপরাজনীতির দাপটে পুরো দেশ অতিষ্ঠ। এক কালে এর মাত্রা ছিলো কেবল শহর নগর বা থানা উপজেলা পর্যন্ত। কিন্তু ইদানিং তা গ্রামে গন্জেও পৌছে গেছে। সেখানেও গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কমিটি। আর এসব কমিটিতে অক্ষর জ্ঞানহীন অনেক ব্যক্তিবর্গই সভাপতি সেক্রেটারি হিসেবে স্থান পাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, ইউনিভার্সিটি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়েও অনেক ছেলেমেয়েকে সরকারি চাকরি বাকরি নিতে গেলে ওদের সনাক্তকরনের মুখাপেক্ষী হতে হয় আজকাল। জাতি কতোটা দুর্ভাগা হলে একটি দেশের শিক্ষিত শ্রেণীকে জীবনের মানোন্নয়নের জন্য রাখাল সমেত কোনো রাজনৈতিক টাউট বাটপারের ছাড়পত্রের উপর নির্ভর করতে হয়। লজ্জা! বড়ো লজ্জা! এ লজ্জা মাথায় নিয়েই তোফাজ্জল সাহেবদের মতো ভদ্র ও সুশীল মানুষদেরকে এ সমাজে বেঁচে থাকতে হচ্ছে অসহায় ভাবে। শুধু তাই নয়, সময়ে অসময়ে তাঁদেরকে অন্যায় ক্রোধেরও শিকার হতে হয়।
কিছু দিন আগের কথা। গ্রামের একদল দরিদ্র লোক তোফাজ্জল সাহেবের বাড়িতে হাজির। খেটে খাওয়া জেলে শ্রেণীর মানুষ তারা। সারাদিন জাল বেয়ে যে মাছ ধরে তা বিক্রি করে কোনো রকমে তাদের সংসার চালায়। কিন্তু বিধি বাম। যেখানে তারা মাছ ধরে সেখানে আরোপিত হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। হাজার বছর ধরে জেলেরা বর্ষার হাওরে ইচ্ছে মতো মাছ ধরে আসছে। এটাই রেওয়াজ। এ রেওয়াজের বিঘ্নতা ঘটাচ্ছে গ্রামেরই কিছু নব্য রাজনৈতিক রাখাল। তারা সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়েছে। তাই তাদের অনুমতি ছাড়া কেউ জাল বাইতে পারবেনা। এ যেনো গরিবের পেটে লাথি মারা ছাড়া আর কিছুই নয়। উপস্থিত জনগণ তাই তোফাজ্জল সাহেবকে সমস্বরে বলতে লাগলো, “স্যার আমনে আমরারে বাঁচাইন। এইঢার একঢা বিহিত করুইন।”
তোফাজ্জল সাহেবের দরদী হৃদয় কেঁপে উঠলো। কিন্তু তাঁর কিছুই করার নেই। তাই তিনি অক্ষম কন্ঠে বললেন,, “আমি কোনো সরকারি অফিসার বা জনপ্রতিনিধি নই যে তোমাদের জন্য কিছু করতে পারবো। তার চেয়ে বরং তোমরা চেয়ারম্যানের কাছে যাও। তার হাতে অনেক ক্ষমতা।”
- ঠিকই কইছেন, হের অনেক ক্ষমতা। কিন্তু হেই ক্ষমতা আমরারে কিছতুয়া দেওনের লাগ্যা না বরং আমরারে চুষ্যা খাওনের লাগ্যা। আমনের বাড়াত আওনের আগেই আমরা বেহেই চেয়ারম্যান, উপজেলার চেয়ারম্যান, ইউএনও সহ সরকারি দলের নেতারার আতে পাওয়ে ধরছি। কাম ওইছেনা। হেরা বেহেই এক চাউলের ভাত খায়। এমপি নিজেও ব্যাপারঢা জানে। হেই ব্যাডিও কিছতুয়া কয়না। ওহন আমনেই আমরার শেষ ভরসা। দয়া কইরা কিছু একঢা করুইন।
- এমপি সহ চেয়ারম্যান ও উপজেলা পর্যায়ের নেতারা যেখানে একজোট সেখানে তার মতো একজন সাধারণ কলেজ শিক্ষক কি-ইবা করতে পারে! তাই তিনি বেশ বিনয়ের সঙ্গে তাঁর অপারগতার কথা বলে তাদেরকে চলে যেতে বললেন।
কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। এতো সহজে হাল ছাড়ার লোক তারা নয়। তাই আবারো তাঁকে তারা অনুনয় বিনয় করলো। অবশেষে তিনি রাজি হলেন। তবে তাদেরকে তিনি একটি শর্ত দিলেন। কোনো অবস্থাতেই তারা যেনো কারো কানপড়া আমলে না নেয় এবং তাঁর কথার বাইরে গিয়ে এক কদমও যেনো অগ্রসর না হয়।
স্ত্রী চাননা তোফাজ্জল সাহেব কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ুক। অযথা মানুষের সাথে শত্রুতা বাড়িয়ে লাভ কি! তাছাড়া যাদের জন্য তিনি কোমর ভেজাবেন তারা কি শেষপর্যন্ত তার সাথে থাকবে? থাকবে কি থাকবেনা তোফাজ্জল সাহেব তা জানেন না। এ নিয়ে তিনি মাথাও ঘামাননা। একজন মানুষ হিসেবে যা করনীয় তাই তিনি করবেন।
শাকিল চৌধুরী। তোফাজ্জল সাহেবের স্কুল জীবনের বন্ধু। বেশ নামীদামি সাংবাদিক। এক ডাকে সবাই চেনে। সচিবালয়, মন্ত্রনালয় কেঁপে ওঠে তার রিপোর্টে। সেই সাংবাদিক বন্ধুকে পুরো ব্যাপারটা তিনি খুলে বললেন। এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, স্থানীয় নেতা, পাতি নেতা, গ্রামের ছিচকে নেতা ও ইউএনও সহ একটি সিন্ডিকেট যা কিনা সরকারি বিধি বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গরিবের পেটে লাথি মারার মতো নিকৃষ্টতম কাজে লিপ্ত। সাংবাদিক সাহেব যা বুঝার তিনি বুঝে ফেলেন।অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কলম ধরাই তাঁর কাজ। বানালেন ফিচার ধর্মী এক রিপোর্ট। প্রকাশ পেলো তার পত্রিকায়। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত খবর হয়ে গেলো। সংশ্লিষ্ট সচিবরা নড়েচড়ে বসলো। ইউএনও কে ধমকালো। দ্রুত বিষয়টি নিষ্পত্তি করার আদেশ দিলো।
কথায় আছে, “ঠ্যালার নাম বাবাজি”। ইউএনওর শুভ বুদ্ধির উদয় হলো। কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী নিয়ে গ্রামে গেলো। মাইকিং করালো। হাওর উন্মুক্তকরনের কথা ঘোষণা করা হলো। এলাকায় জনগনের মুখে মুখে খবরটি ছড়িয়ে পড়লো। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মুখে ফুটে উঠলো আনন্দের হাসি। বিজয় হলো সত্যের। বিজয় হলো মানবতার। কিন্তু হাওর খেকোরা এ বিজয় সহজে মেনে নিতে পারলোনা। তাদের মাথায় বাজ পড়লো। বুকে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠলো। কূটপরায়ন হয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে টাকা দিয়ে কিনে ফেললো। তাদের মধ্যে অন্তরদ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হলো। এক পক্ষ অন্য পক্ষের একজনকে মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে ফেললো। এ সবকিছুর দায়ভার চাপানো হলো অধ্যাপকের ঘাড়ে। তরুণ ছাত্রসমাজের কয়েকজন যাদেরকে তিনি মানবতার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন তারাও নির্লজ্জ ভাবে তাকে দোষারোপ করছে। এ সব কিছুর মূল হোতা একজন। চেয়ারম্যান সাহেব। তিনি তলে তলে সবাইকে প্ররোচিত করে অধ্যাপক সাহেবের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। অথচ ভালো মানুষের প্রতিরূপে তিনিই অধ্যাপক সাহেবকে আগে আগে বাড়ি চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। যেনো রাতের আঁধারের সুযোগে ক্ষেপে যাওয়া মানুষেরা তার কোনো ক্ষতি করতে না পারে। অধ্যাপক সাহেব বুঝতে পারলেন, এ কোনো পরামর্শ নয়, এ ছিলো এক চপেটাঘাত।
তোফাজ্জল সাহেব বেশ মর্মাহত হন। কষ্ট পান। এরা কেমন মানুষ! যাদেরকে মানুষ বানানোর জন্য তিনি নিজে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শপথ নিয়েছেন তাদেরই কেউ কেউ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করছে! যাদের অধিকার আদায়ে ধনিক শ্রেণীর রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে প্রকাশ্যে লড়েছেন তাদের অনেকেই গোপনে কুচক্রীদের সাথে হাত মিলিয়েছে। এ কেমন মানসিকতা! কেমন মনুষ্যত্ববোধ! চেয়ারম্যান সহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধি ও নেতৃস্থানীয় লোকদের সাথে ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর কোনো খারাপ সম্পর্ক নেই। সবার সাথেই তিনি মার্জিত ও বন্ধুসুলভ আচরণ করেন। অথচ তারাও তাকে সহ্য করতে পারেনা। প্রতিদ্বনদ্বী ভাবে। অধ্যাপক সাহেবকে হেস্তনেস্ত করতেই যেনো তারা বেশি তৎপর। এ তৎপরতা যে কোনো ভালো মানুষের কাজ হতে পারেনা তা তোফাজ্জল সাহেব অতি সহজেই বুঝতে পারেন। তবু তিনি নীরব থাকেন। কারণ তাঁর মতো সত্যিকার মানুষেরা এসব অমানুষদের ভীরে বড্ড অসহায়।
অসহায়ত্বের জ্বালা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তোফাজ্জল সাহেব। অনেক দিন ছেলের পড়াশুনার খোঁজ খবর নেয়া হয়নি। সুযোগও হয়ে ওঠে না। আজ আগে আগে বাড়ি ফেরায় সে সুযোগটা হয়ে ওঠলো। আর তিনি তা হাতছাড়া করতে চাইলেন না। এগিয়ে গেলেন ছেলের কাছে। বললেন, ” বাংলা ভাষায় তোমার দখলদারিত্বের পরীক্ষাটা হয়ে যাক আজ। লিখতো বাবা “আমার জীবনের লক্ষ্য” রচনাটা।”
আব্বুকে পেয়ে ছেলে বেশ উৎফুল্ল। খুশি। আর ওই খুশি খুশি মন নিয়ে সে লিখতে শুরু করলো। বড়ো হয়ে দেশে লেখাপড়া শেষ করে বিলেতে ব্যরিষ্টারি পড়তে যাবে। ব্যরিষ্টারি পড়া শেষে এক বিদেশী ম্যামকে বিয়ে করে সাথে নিয়ে দেশে ফিরবে। বাবা পড়ছিলেন আর মুচকি মুচকি হাসছিলেন। সহসা তিনি গম্ভীর হয়ে যান। রক্তচাপ বেড়ে যায়। উত্তেজিত হয়ে পড়েন। “এসব কি লিখেছো” বলেই খুব জোরে গালে একটি চড় কষে দেন। ছেলে অবাক হয়ে যায়। বাবাকে কোনোদিন এভাবে রাগতে দেখেনি। কখনো তার গায়ে হাত তোলেনি। অথচ আজ বাবার ভিন্ন রূপ দেখে চমকে যায়। সে কি তবে ভুল কিছু লিখেছে? মায়াভরা চোখ নিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো বাবার দিকে। বললো, ‘বাবা, আমাকে নিয়ে আপনার যে কল্পিত রূপরেখা, তা আঁকতে কি আমি ব্যর্থ হয়েছি? আপনার মনে চিত্রায়িত ছবি কার কথা বলে? ডারউইন, বারটান্ড রাসেল কিংবা সক্রেটিস এমন কিছু?”
বাবা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন। কপোলে চুমু খেয়ে বললেন, “না বাবা এমন কিছুই চাইনা। সারা জীবন মানুষকে মানুষ বানাবার যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছি। তাই তোমার জজ, ব্যরিষ্টার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র কিংবা দার্শনিক বিজ্ঞানী কিছুই হওয়ার দরকার নেই। আমি চাই তুমি একজন ভালো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠ। মানুষের মতো মানুষ।”
লিমরিক
২৩ নভেম্বর ২০২০