ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নেপালি নাগরিক গোর্খাদের নিয়োগ করার যে বহু পুরনো পরম্পরা আছে, নেপালে তা নিয়ে বিতর্কের পরও সেই রীতি আপাতত বজায় থাকছে বলেই জানা যাচ্ছে।
ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল এম এম নারাভানে এই মুহূর্তে নেপাল সফল করছেন। তাকে বৃহস্পতিবার নেপাল সেনাবাহিনীর সাম্মানিক ‘জেনারেল’ খেতাবেও ভূষিত করা হয়েছে। খবর বিবিসির।
সেনাপ্রধান নারাভানের সঙ্গে নেপালে তার কাউন্টারপার্ট জেনারেল পূর্ণচন্দ্র থাপার বৈঠকেই গোর্খাদের নিয়োগের বিষয়টির মীমাংসা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
কিন্তু নেপালে বিষয়টি কেন বারবারই বিতর্কের মুখে পড়ছে? এতো বিতর্কের পরও কেন ভারত তাদের সেনাবাহিনীতে গোর্খাদের পেতে এত উৎসুক? ভারতের সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীগুলো মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো গোর্খা সেনা কর্মরত- যারা সবাই প্রতিবেশী নেপালের নাগরিক। দেশটির সেনাবাহিনীতে নেপালের গোর্খারা যোগ দিয়ে আসছেন সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে, যে ট্র্যাডিশন সাতচল্লিশের দেশভাগের পরও অব্যাহত থেকেছে।
কিন্তু তিন মাস আগে নেপাল ও ভারতের মধ্যে সীমানা নিয়ে বিরোধের পটভূমিতে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ গাওয়ালি ঘোষণা করেন, ‘যে চুক্তির আওতায় এই নিয়োগ হয়ে আসছে তা এখন অপ্রাসঙ্গিক।’ এরপরই ভারতীয় বাহিনীতে গোর্খাদের নিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
কাঠমান্ডুতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ভাষ্যকার ইন্দ্রা অধিকারী বলেন, ‘এই ইস্যুটা নিয়ে নেপালে আসলে নানা রকমের মত আছে। আল্ট্রা ন্যাশনালিস্ট বা উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বলেন, নেপালের মানুষ কেন ভারতের হয়ে লড়তে যাবেন! কোনোদিন যদি নেপালের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ বা সংঘর্ষ হয় তাহলে তাদের ভূমিকাই বা কী হবে? আবার লিবারাল বা উদারপন্থীদের মত হলো, নেপালিরা যদি বিশ্বের নানা দেশে নিরাপত্তাবাহিনীতে কাজ করতে যেতে পারেন তাহলে ভারতই বা নয় কেন? ভারত ঘরের কাছে, সহজেই দেশেও আসা যায়। সেখানে সেনাবাহিনীতে বেতন ও সুযোগ-সুবিধাও অনেক বেশি। ফলে নেপাল যদি তার তরুণদের অন্য চাকরি না দিতে পারেন তাহলে তারা ভারতে যাবেন না-ই বা কেন?’
বস্তুত স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশের নাগরিকরা কেন অন্য দেশের সেনাবাহিনীর হয়ে লড়বেন, এই মৌলিক প্রশ্নটাই ভারতের বাহিনীতে গোর্খা সেনাদের নিয়োগ নিয়ে নেপালে বারে বারে অস্বস্তি তৈরি করেছে। আট বছর আগেও একবার নেপালে এই প্রথা বন্ধের জোরলো দাবি উঠেছিল।
তবে ভারতের সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও গোর্খা রাইফেলসের সাবেক কমান্ডার মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জি বলেন, ‘নিয়োগে দুইশো বছরের বেশি পুরনো ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। আমার রেজিমেন্ট ছিল ফার্স্ট গোর্খা রাইফেলস, যেটাকে বলা যায় আদি গোর্খা রাইফেলস – আর সেটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮১৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। ওই বাহিনীর দুইশো বছর পূর্তিও আমরা উদযাপন করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্বভাবতই ভারতের সেনাবাহিনী বহরে অনেক বৃদ্ধি পায়, প্রায় ২০ লাখ সদস্য ছিল তখন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বাহিনীর আকার কমানো হয়, গোর্খাদের সংখ্যাও কমে আসে। তখনই কিন্তু গোর্খাদের অপশন দেওয়া হয়েছিল, তারা ভারত না ব্রিটেনের বাহিনীতে যোগ দেবে, না-কি বাহিনীর চাকরি ছেড়ে নেপালে ফিরে যাবে। ভারত, নেপাল ও ব্রিটেনের মধ্যে এ নিয়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তিও হয়েছিল তখন। সেই ধারাবাহিকতায় আজও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রতি বছর প্রায় তেরোশো গোর্খা রিক্রুট করে থাকে। তাছাড়া ব্রিটিশ আর্মি ও সিঙ্গাপুর পুলিশের জন্যও নেপাল থেকে বাছাই করা হয় শদুয়েক গোর্খাকে।’
দীপঙ্কর ব্যানার্জি বলেন, ‘ভারতের প্রতি আনুগত্যেও এই গোর্খারা ভারতের কোনো সৈন্যের চেয়ে এতটুকু কম নয়। বরং বেশি। ধরুন দক্ষিণ ভারতে বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নানা জাতিগত কারণে বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কারণে বিভিন্ন রেজিমেন্টের সেনা মোতায়েন নিয়ে কিছুটা ভাবতে হয়, কিন্তু গোর্খাদের নিয়ে সেই সমস্যাও নেই। তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত ও সাহসিকতা অতুলনীয়। তারা এটা নিয়েও অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, যে নেপালের বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় ভারতের এই সেনাবাহিনীই রুটিরুজির সবচেয়ে বড় ও নির্ভরযোগ্য উৎস।’
ভারতের প্রথম ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ একবার বলেছিলেন, ‘ভারতে যদি কোনো সৈন্য বলে সে জীবন দিতে ভয় পায় না- তাহলে সে হয় মিথ্যে বলছে, নয়তো সে গোর্খা!’
আর গোর্খাদের সেই অপরিসীম অবদানের কারণেই নানা বিতর্ক সত্ত্বেও ভারতীয় সেনাবাহিনীও তাদের নিয়োগ দিতে আজও এতো উদগ্রীব।