বিদেশী পরিচয়ে নিজ দেশে
[এই রিপোর্টটি দৈনিক নয়াদিগন্তে ২১/০৭/২০১৭ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল]
তারা এখন বহুজাতিক। মা চাইনিজ। বাবা বাংলাদেশী। আর নিজেরা আইরিশ। তবে ১৫ বছর বয়সী মুস্তাকিম-উল-হক এবং ১৩ বছর বয়সী মুহতারিম-উল-হকের বাংলাদেশে আসা আয়ারল্যান্ডের দাবাড়ু হিসেবে। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন আয়োজিত সাইফ গ্লোবাল স্পোর্টস আন্তর্জাতিক রেটিং দাবায় অংশ নেয়া ছয় বিদেশীর দু’জন তারা।
অল্প স্বল্প বাংলা বলতে পারেন। মুস্তাকিম এবং মুহতারিম নিজ দেশে এলেন বিদেশী পরিচয়ে। অবশ্য দাবা খেলতে এই প্রথম আসা। অতীতে আসা হয়েছে বেড়াতে। বাবা মাহফুজুল হক ও মা প্যাং চিং। বৃত্তি নিয়ে ১৯৯৩ সালে চীনের হুবেই প্রদেশে পড়তে চান মাহফুজুল হক। সেখানেই পরিচয়, প্রেম ও বিয়ে প্যাং চিয়ের সাথে। বিয়েটা অবশ্য ’৯৬ সালে। এই দম্পতি তিন বছর বাংলাদেশে ছিলেন। মাহফুজুল শিক্ষকতা করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে। এরপর আয়ারল্যান্ডে চলে যান তারা। সেখানে ওয়েভ ডেভেলপারের কাজ করেন। সেখানেই জন্ম এই দুই ছেলের। প্যাং চিং অবশ্য মুসলমান হয়েছেন। ধর্মকর্মের প্রতি বেশ সিরিয়াস। গতকালও দাবা ফেডারেশনে দেখা গেল আসরের নামাজের আযান কানে আসা মাত্রই মাথাটা ওড়না দিয়ে ঢেকে দিলেন। জানান, ’আমি রোজাও রাখি’।
আয়ারল্যান্ডে ফুটবল খুবই জনপ্রিয়। এর পরেই আছে ক্রিকেট। মুস্তাকিম ও মুহতারিম ক্রিকেট ও ফুটবল দুটোই খেলেন। তবে দু’জনের দুষ্টামি কমাতে তাদের দাবায় অভ্যস্থ করেন বাবা-মা। বাবা মাহফুজুল হকের মতে, দাবা বিচক্ষণতা বাড়ায়। তা ছাড়া লেখাপড়ার পর অবসর সময়ে মোবাইলের প্রতি আসক্তি কমাতেই দাবা খেলার প্রতি আগ্রহী করা হয় তাদের। এ খেলা মানুষকে চুপচাপ থাকতে সহায়তা করে। এ ছাড়া একদিন স্কুল থেকে দাবা শিখে আসে বড় ছেলে মুস্তাকিম। সাথে নিয়ে আসে দাবা বোর্ড। এরপর তার সাথে ছোট ছেলে মুহতারিমও দাবায় জড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে মুস্তাকিমের রেটিং ১৯০০। মুহতারিমের ১৭৯৭। দু’জনই আয়ারল্যান্ডের বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলেছেন২০১৩ সাল থেকে। প্রথমে এক ভাই খেলতেন। অন্যজন থাকতেন রিজার্ভ হিসেবে। তবে গত বছর থেকে দু’জনই আইরিশ জার্সিধারী। খেলে যাচ্ছেন চার জাতি টুর্নামেন্টসহ বিভিন্ন আসরে। গত মে মাসে মালাহাইড টুর্নামেন্টে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হন মুহতারিম। ২০১৬তে কর্ক টুর্নামেন্টেও চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। আর ২০১৫তে আইরিশ জুনিয়র দাবায় রানার্সআপ হন মুস্তাকিম। মুহতারিমের জোটে তৃতীয় স্থান।
ইতোমধ্যে দুই ছেলে আয়ারল্যান্ডে দাবা প্রশিক্ষণ দেয়াও শুরু করেছেন। টাকাও মিলছে এতে। বড় ছেলে আবার ডাবলিনের স্কুলের মসজিদে জোহরের নামাজে ইমামতি করেন। এবার ছুটিতে বাংলাদেশে আসবেন এমন পরিকল্পনা থেকে ছয় মাস ধরে ফেসবুকে বাংলাদেশের দাবা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন মাহফুজুল। ফেডারেশন সেক্রেটারি সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীমের ফোন নাম্বার পেয়ে বাংলাদেশের টুর্নামেন্টে দুই ছেলেকে খেলার সুযোগের কথা জানান। শামীমের আশ্বাসেই ঢাকায় আসা ও রেটিং দাবায় দুই ছেলের অংশগ্রহণ। সাথে তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মেহেদী হাসান পরাগ ও জিয়াউর রহমানের কাছে। রাজীবও তাদের ট্রেনিং দেবেন জানালেন মাহফুজ। ক’দিন পরেই চলে যাবেন আয়ারল্যান্ডে। আবারো আসবেন ছুটি ও বাংলাদেশের আসরকে সামনে রেখে।
গত কয়েক দিনে পিতৃভূমিকে বেশ ভালোবেসে ফেলেছেন মুস্তাকিম ও মুহতারিম। ঢাকার ফুচকা তাদের পছন্দের খাদ্য তালিকায়। বাবা মাহফুজ জানান, ওরা এখন দাবা নিয়ে এত ব্যস্ত যে গরম ও মশা এসব নিয়ে কথা বলার সময় নেই।
মুস্তাকিম ধাপে ধাপে ফিদেমাস্টার থেকে গ্র্যান্ডমাস্টার পর্যন্ত হতে চান। মুহতারিম এখনই লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছেন। আমি বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে চাই। দুই ভাইয়ের মন্তব্য, ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতে প্রচুর শক্তিক্ষয় হয়। সে তুলনায় দাবা অনেক রিলাক্সের খেলা। তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ দাবা দলের সদস্য হবেন কি না সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারলেন না। তাদের বাবাও দিতে পারলেন না তেমন কোনো আশ্বাস। এরপরও এই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রতি তাদের আগ্রহ আরো বৃদ্ধি করবে। এটা যে তাদের শেকড়। আশাবাদ বাবার।