
মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তার সভার জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লা শিরাজীর সহযোগিতায় ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘তারিখ-এ-এলাহি’ নামে নতুন একটি বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন। এটি কৃষকদের কাছে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়, যা পরে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ নামে প্রচলিত হয়ে ওঠে।
বাংলা সন শূন্য থেকে শুরু হয়নি, যে বছর বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়, সে বছর হিজরি সন ছিল ৯২৩ হিজরি। সে অনুযায়ী সম্রাটের নির্দেশে প্রবর্তনের বছরই ৯২৩ বছর বয়স নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বাংলা সনের।
কবি আব্দুল হাই শিকদার এর লেখায় নিম্নোক্ত বাংলা সনের ইতিহাস বর্ণনা করেছেনঃ
১) বাংলা সনের স্রষ্টা মুঘল ভারতের শ্রেষ্ঠ গনিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ উল্লাহ খান সিরাজী
২) যাঁর নির্দেশে এই সনের জন্ম তিনি হলেন সম্রাট জালালউদ্দীন মোহাম্মদ আকবর
৩) পরবর্তী সংস্কারক সম্রাট শাহজাহান ও ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
৪) বাংলা সন প্রবর্তিত হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে
৫) বাংলা সনের প্রথম নাম: তারিখ – ই – ইলাহী
৬) বঙ্গাব্দ নামকরণ হয়: ১৫৮৪ সালের ১১ মার্চ
৭) বাংলা সনের গণনা শুরু: ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। ২য় পানিপথ যুদ্ধে হিমুর বিরুদ্ধে আকবরের বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য
৮) বাংলা সন প্রবর্তনের কারণ: মুঘল শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতো হিজরী সন অনুসারে। আর সুবেহ বাংলায় ফসল তোলা ও খাজনা আদায় হতো সৌরবর্ষ অনুযায়ী ।এতে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যা দূর করার দায়িত্ব দেয়া হ্য় আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে। তিনি একটি নতুন বর্ষপন্জি প্রণয়নের তাগিদ অনুভব করে যে প্রস্তাবনা পাঠান, তার ভিত্তিতেই সম্রাটের আদেশের প্রেক্ষিতে তিনিই জন্ম দেন বাংলা সনের
৯) সিরাজী হিজরী সনকে মডেল হিসাবে নিয়ে কাজ শুরু করেন। সেই হিসাবকে সামনে রেখে ৯৬৩ হিজরীর মোহররম মাস থেকে বাংলা বর্ষের ৯৬৩ অব্দের সূত্রপাত করা হয়
১০) হিজরী মোহররম মাসের সাথে বৈশাখের মিল থাকাতে, ভারতের প্রচলিত শকাব্দের চৈত্র মাসকে বাতিল করে বৈশাখকে করা হলো বঙ্গাব্দের প্রথম মাস
১১) ৪৪৫ বছর পরে হিজরীর সাথে বঙ্গাব্দের পার্থক্য দাঁড়ালো ১৪ বছর
১২) প্রবর্তনের সময় বঙ্গাব্দের সাথে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের (খ্রিস্টাব্দ) পার্থক্য ছিল ৫৯৩ বছর। অর্থাৎ বাংলা সনের সঙ্গে ৫৯৩ যোগ করলেই পাওয়া যাবে খ্রিস্টাব্দ। সাধারণের ইংরাজী সাল।
১৩) যাত্রা শুরুর লগ্নে বাংলা মাসের ৩০ দিনের ৩০টা নাম ছিল। নামগুলো মনে রাখাও ছিল কষ্টসাধ্য ।
১৪) প্রথম সংস্কার: বাংলা সনের প্রথম সংস্কারক সম্রাট শাহজাহান এক পর্তুগিজের সাথে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা সাপেক্ষে প্রতিটি মাসকে ৪ টি ভাগে ভাগ করে সূচনা করেন সপ্তাহের।প্রতিটি সপ্তাহ ৭ দিন। গ্রেগরিয়ান পদ্ধতিতে দিনের নাম ঠিক করা হয়, sun থেকে রবিবার, moon থেকে সোমবার ইত্যাদি।
১৫) সূচনার সময় বাংলা মাসগুলোর নাম ছিল খোরদাদ, মেহের, শাহরিয়ার, ইসফান্দ ইত্যাদি
পরে বিভিন্ন তারকা ও গ্রহের নাম থেকে নাম রাখা হয় বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ইত্যাদি।
১৬) দ্বিতীয় সংস্কার: বিশ্ব চলে খ্রিস্টাব্দের পথ ধরে। বাংলা সনকে তার সাথে সঙ্গত রাখা দরকার ।বিশেষ করে লিপইয়ারের ঝামেলা দূর করা এবং বাংলা সনকে যুগোপযোগী করার ভাবনা থেকেই, ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠন করে পন্জিকা সংস্কার কমিটি।
বাংলা সনের বর্তমান রূপটি এই কমিটিরই অবদান।
১৭) পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূচনা করেছিলেন সম্রাট আকবর। তিনিই এই উৎসবের প্রতিয্ঠাতা, স্থপতি ও সত্যিকারের জনক।
১৮) সম্রাট আকবরই নির্ধারণ করেন শেষ চৈত্র হবে খাজনা পরিশোধের। ১ বৈশাখ দেশের মানুষ উৎসব করবে, মিস্টিমুখ করবে। হবে হালখাতা। মেতে উঠবে মেলা, খেলা, হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে ।
১৯) সম্রাট আকবর দি গ্রেট শুয়ে আছেন ফতেহপুর সিক্রিতে। সম্রাট শাহ জাহানের কবর আগ্রার তাজমহলে,
আমির ফতেহ উল্লাহ খান সিরাজীর কবর নারায়ণগন্জের ফতুল্লায়। বাংলাদেশকে ভালোবেসে এ দেশকেই শেষ শয্যার জন্য বেছে নিয়েছিলেন এই কীর্তিমান। পরে তাঁর সম্মানে স্থানটির নাম রাখা হয় ফতেহ উল্লাহ । যা আজ “ ফতুল্লা”য় নিমজ্জিত হয়েছে।
ড. শহাদুল্লাহর মাজারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে, বার ভূঁইয়া নেতা বীর ঈশা খানের পুত্র মুসা খানের কবর ও মসজিদের পাশে।
২০) ছায়ানটের রমনা-বৈশাখ উদযাপন, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, সভা সেমিনার, রেডিও ,টিভি- মিডিয়া, পত্রপত্রিকা, সংস্কৃতি মন্ত্রনালয় , বাংলা একাডেমি , শিল্পকলা একাডেমি… মোট কথা কোথাও আকবর , সিরাজী, শাহজাহান ও শহীদুল্লাহকে স্মরণ করা হয় না। জানানো হয় না সামান্য শ্রদ্ধা।
২১) ড মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সংস্কারকৃত আধুনিক বাংলা ক্যালেন্ডার বিশ্ব জুড়ে গৃহিত হলেও ভারতীয় বাঙ্গালীরা এটা মানে না। তারা আঁকড়ে আছে সম্রাট শাহজাহানের জমানা । আর বঙ্গাব্দ নয় তাদের মাথায় বাস করে শকাব্দ।
২২) তবে এ কথা ঠিক, দৈনন্দিন জীবনে বাংলাদেশী বাঙ্গালী ও ভারতীয় বাঙ্গালী কেউই বাংলা সন অনুসরণ করে না।সেখান একচ্ছত্র আধিপত্য খ্রিস্টাব্দের।
