বাংলাদেশী নক্ষত্র আয়ারল্যান্ডে যেমন আছেন

0
983

আব্দুর রাহিম ভূঁইয়া: বিশ্বজুড়ে বাঙালিরা তাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে প্রতিনিয়ত বিশ্বের দরবারে তুলে ধরে যাচ্ছেন। এ সমস্ত নক্ষত্ররা প্রবাসী বাঙ্গালীদের কাছে একেকটি আইকন স্বরূপ। আয়ারল্যান্ডের আমাদের এমন কিছু আইকন আছে যারা যুগযুগ ধরে এই দ্বীপটিতে আলোর বিকিরণ ছড়িয়ে যাচ্ছেন। শুধুমাত্র বাঙালি কমিউনিটির মধ্যেই এদের অবদান সীমাবদ্ধ না। এই দেশের হাজার হাজার নাগিরকও তাদেরকে রোল মডেল হিসেবে বা পাথেয় হিসেবে স্মরণ করে থাকেন।

আজকে আপনাদেরকে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন অধ্যাপক ডক্টর জাকিয়া রহমানের গল্প বলবো, যার জন্ম ১৯৫০ সালে রংপুরে। তার পুরো নাম ইসমেত জকিয়া রহমান। এই মানুষটি বাংলাদেশে মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম ও বেড়ে উঠে। ১৯৭৩ সালে প্রথম দিকে তিনি জনাব ডক্টর আব্দুর রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৭৩ সালে মাস্টারস ডিগ্রী প্রাপ্ত হবার পর ঢাকা এটমিক এনার্জি সেন্টারে গবেষনার কাজে নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালে জনাব আব্দুর রহমান ইলেক্ট্রনিক ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ গবেষণা করার জন্য কমোনোয়েলথ পিএইচডি স্কলারশিপ পান এবং সপরিবারে ইংলেন্ডে আসেন। সেখানে জাকিয়া রহমান সাউথাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুদিন পদার্থবিদ্যা বিজ্ঞান বিভাগে, মহাশূন্য বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে রিসার্চ সহকারী হিসাবে কাজ করেন ও পরে চুম্বকত্বের উপর রিসার্চ করে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।

পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে তারা দুজনই আয়ারল্যান্ডে লিমেরিকে পাড়ি জমান। সেখানে জাকিয়া রহমান ১৯৮৩ সাল থেকে লিমেরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রনিক ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপনা ও গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । দীর্ঘ ৩৬ বছর আয়ারল্যান্ডের এই বিশ্বখ্যাতি সম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ হাতে হাজার হাজার দেশ ও পৃথিবীর গড়ার বিজ্ঞানী ও কারিগর তৈরী করেন। তিনি নিজস্ব গবেষনাগার Magnetics Research Laboratory নির্মাণ করেন। যেখানে তার উদ্ভাবিত নূতন প্রযুক্তির কার্য্যক্রম পরিচালিত করেন। এই সমস্ত নব প্রযুক্তির চেতনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন সরকারী অনুদান সংস্থা যেমন, Enterprise Ireland, European Union, Industries (Ireland, Europe, USA) এবং পৃথিবীর কিছু দেশ যেমন, ভারত, পাকিস্তান ইত্যাদি থেকে প্রোজেক্ট গ্রান্ট লাভ করেন। ফলশ্রুতিতে নূতন প্রযুক্তি, বাণিজ্যিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, নূতন প্রজন্মের শিক্ষা, প্রশিক্ষন ও জীবিকার সংস্থানের পরিব্যাপ্তি বিস্তার করে। এখন দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার হাতে গড়ে তোলা ছাত্রছাত্রী বাণিজ্যিক প্রযুক্তি ও উৎপাদন, গবেষণা ও শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নাল, পুস্তক, সম্মেলন ও রিপোর্টে তার গবেষনার ফলাফল প্রায় দেড় শতাধিক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে প্রকাশ করেছেন। প্রায় পনেরটির উপর আন্তর্জাতিক জার্নাল, রিসার্চ অনুদান সংস্থা রিভিউয়ার এবং পিএইচডি থিসিসের পরীক্ষক ছিলেন এবং আছেন। কিছু সংখ্যক জার্নাল ও পুস্তকের এডিটর হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন। নূতন গড়ে উঠা লিমেরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য গবেষনায় পোষ্টগ্রাজুয়েট এবং পরবর্তী উত্তরণের প্রারম্ভিক বীজ বপনের একজন উদোক্তা ছিলেন। তার এবং আরও তিনজন গবেষকের রিসার্চকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতির কাঠামো হিসাবে ধরে ১৯৯৮ সালে পরিকল্পনার পথ শুরু হয়। ডিপার্টমেন্ট অব হায়ার এডুকেশন, আয়ারল্যান্ড সেই পরিকল্পনাকে ভিত্তি করে গবেষণাকে বৃহদায়তন করে অধুনা লিমেরিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনা কর্ম সূচি সুচনা করে। এইসব পরিকল্পিত গবেষনাগার এখন হাজার খানেক বৈজ্ঞানিক ধারণ করতে পারে। সুবিধাদি, দক্ষতা, গবেষনা, প্রকাশনা, ইনোভেশন এবং নব বাণিজ্য বস্তু আবিস্কারে পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কম নয়।

২০১৫ সালে তিনি লিমেরিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। লিমেরিক বিশ্ববিদ্যালয় তাকে Emeritus অধ্যাপক পদে ভূষিত করেন। তিনি এখন গবেষণার কাজে কিছু সময় কাটান। বর্তমানে Albukhary International University, Malaysia তে প্রকাশিত “Albukhary Social Business Journal” এর উপদেষ্টা সম্পাদক হিসাবে কাজ করেন।

তিনি নিয়মিত বাংলাদেশে যাতায়াত করেন। বাংলাদেশের জন্য তার মায়া অপরিসীম। এ বছরই তিনি করোনার প্রকোপের প্রারম্ভেই ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সফর করে আসেন। যদিও হাসতে হাসতেই বলে ফেলেন, ‘আমি এসেইতো কোয়ারেন্টাইন চলে গেলাম’।
অধ্যাপক জাকিয়া রহমান দুই সন্তানের মাতা। তার কন্যা যুক্তরাজ্যে বা ইউকেতে রসায়ন বিদ্যায় একজন বিজ্ঞানী এবং ছেলে ডাবলিনে আইটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত।

তার হবির মধ্যে রয়েছে বাগান করা, ছবি আঁকা, কবিতা ও গল্প লেখা। এ সমস্ত তিনি ছোট বেলা থেকেই করেন। আট বছর বয়সে প্রথম বাগান ডিজাইন এবং নির্মাণ করেছিলেন। সেই থেকে এই বাগান করা ও পরিচর্যায় কোনদিন ইতি পড়েনি। আয়ারল্যান্ডে এসে তিনি বড় একটা গোচারণভূমি কিনে তাতে বাগান ও বাড়ি নিজে ডিজাইন করে নিরমাণ করেছেন। বাগানের বয়স এখন ৩০ বছরের বেশী। এই বাগানে রয়েছে অনেক বিরল উদ্ভিদের সমারহ। তাতে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের বৃক্ষ রাশি, ফুল ও সবজির বাগান। তিনি এখন এই বাগানে অনেক সময় অতিবাহিত করতে পারেন বলে খুব সুখী। অন্য হবিগুলি পিএইচডি শুরু করার পর ও কর্ম জীবনে গবেষনায় কিছুটা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হেতু প্রায় চল্লিশ বছর মানসিক কষ্ট হলেও, বর্জন করেছিলেন। বর্তমানে অবসর সময় কিছুটা বারতি পাওয়াতে এই হবিগুলি পুনরায় শুরু করেছেন। বার বছর বয়স থেকে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন সংবাদপত্র যেমন ইত্তাফাক এর ছোটদের বিভাগে ও তারুন্যে বেগম ও অন্যান্য পত্রিকায় বৈজ্ঞানিক ও বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ, ছোট গল্প ও কবিতা লিখতেন। বিদ্যালয়ের ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের দেয়াল পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কয়েক বার রাজশাহী বেতার কেন্দ্র থেকে বিতর্ক ও নিজ কবিতা আবৃতিতে অংশ নেন। কয়েকটি সাহিত্য ও চিত্রাংকন প্রতিযোগীতায় পুরস্কৃত হন। তিনি পছন্দ করেন সামাজিকভাবে সবার সাথে মেলামেশা করতে, গান শোনা, বন্ধুবান্ধবদের খবরাখবর নেয়া।

তিনি কখনই রাজনীতি পছন্দ করেননা। আদর্শগত দিক দিয়ে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, যার সারমর্ম হলো, ‘সবাই সমান, আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি এই পৃথিবীতে সব কিছুই সবার জন্য। রাজনৈতিক সীমানা, মতবাদ ও বর্ণ বিভেদ মানুষের সৃষ্টি, আল্লাহর নয়।‘ কাজেই রাজনীতি করে বিভেদ ডেকে আনে যারা মানুষকে সাহায্য করার কথা বলে, সেই সিস্টেমের উপর তার বিশ্বাস নেই। এই পদ্ধতি কখনই কাজ করেনি এবং করবেওনা।

আইরিশ বাংলাটাইমসের পক্ষ থেকে তার সাথে কুশল বিনিময়ের সময় তিনি তার জীবনের রঙিন ও বৈচিত্রময় অধ্যায়ের স্মৃতিচারণ করেন। আয়ারল্যান্ডকে তিনি কতটুকু পছন্দ করেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘I love Ireland, I love being here and I want to die here.’ তা বলে তিনি নিজের দেশকে কম ভালবাসেননা। কিন্তু দেশমাতা আজ ভারাক্রান্ত। আল্লাহর সৃষ্ট এই বিরাট পৃথিবী আমাদের বসবাসের জন্য। কাজেই বাংলাদেশ এবং আয়ারল্যান্ড সবি তার দেশ।

কিন্তু নিজের জন্মভূমির জন্য তাঁর অশেষ ভালোবাসা। তিনি বিশ্বাস করেন না যে, দেশ সেবার জন্য রাজনীতি করতে হবে। শুধু রাজনীতি করার নামে কিছু অসহযোগিতা করলেই দেশের সেবা হয়না আমি চিরদিন মানুষকে সরাসরি সাহায্য করি অনেকভাবে। মানুষকে দেখিয়ে ছবি তোলার জন্য নয়।

রাজনীতির প্রশ্নে বলেন তিনি রাজনীতি মোটেও পছন্দ করেন না, কখনই জড়িত ছিলেননা এবং তার আদর্শ ও বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন অস্তিত্ব। তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী সেই কারণে ছাত্র জীবনে “ছাত্র ইউনিয়ন’ এ দু’বছর জড়িত ছিলেন। সেখানে সাহিত্য চর্চার পরিবেশ ছিল এবং সিনিয়র সব সুসাহিত্যিক বোনেরা এই দহলিজে বিরাজ করতেন। তাদের সময় “ছাত্র ইউনিয়ন’ কখনই পলিটিক্যাল পার্টি ছিল না। তিনি যখন ১৯৬৭ সালে ইউনিভারসিটি শুরু করেন তখনকার পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন ছিল। তিনি মহিলাদের হলে “ছাত্র ইউনিয়ন’ এ এক বছর সাহিত্য সম্পাদিকা হিসাবেও কাজ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার প্রাক্কালে তার বোধদয় হয়েছিল, এ পথ তার জন্য নয়। প্রচন্ড সময় নষ্ট হওয়াতে পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছিল তাই এসব দলীয় রাজনীতির কি ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে তা সে অনুধাবন করতে পেরে সম্পূর্ণভাবে পড়াশুনা ও গবেষণায় নিজেকে সপে দেন। তিনি বলেন, ‘আমার আদর্শ ও বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন অস্তিত্ব।

তিনি জোর দিয়ে ব্যক্ত করলেন ‘আমরা বাংলাদেশ গড়বার স্বপ্ন দেখেছিলাম, কিন্তু যে দেশ আমরা চেয়েছিলাম তেমন হয়নি। আমার জীবনের সবচেয়ে বৃহৎ উদ্দেশ ছিল একজন পদার্থবিদ এবং গবেষক বিজ্ঞানী হওয়া। বাংলাদেশ মাতার কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি সেটি ছিল আমার সব চেয়ে বড় পুঁজি। বিশ্বের মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য সেটি ছিল আমার বুদ্ধি মত্তার এক অনন্য শক্তি।‘

তিনি বাঙালিদেরকে আহবান করেন সুন্দর ও পরিছন্ন ভাবে জীবন অতিবাহিত করার জন্য যাতে আমাদের নুতন প্রজন্ম চিন্তাশীলতা ও জীবিকায় প্রজ্বলিত হয়ে দুনিয়ায় শান্তি ও সমৃদ্ধি আনতে পারে। এসব বিষয়ে কিছু আলোচনে করতে উনি রাজী আছেন এবং তার দক্ষতার উপর ভিত্তি করে যতটুকু সম্ভব উনি সহায়তা করতে পারেন। তিনি জীবনের কাছ থেকে অনেক কিছুই পেয়েছেন। এখন আর বেশি কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার নাই। সবাই সুন্দর ও সুস্থ জীবন যাপন করুণ সেটাই উনি মনে প্রানে কামনা করেন।

আমরা বাংলাদেশিরা হয়তো অনেকেই এই প্রচার বিমুখ ব্যক্তিটিকে চিনিনা বা খবর রাখিনি। আমরা কি জাকিয়াদের মতো গুণীজনদের খবরাখবর রাখতে পারিনা? আমরা কি পারিনা যারা আমাদের সমাজে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছেন তাদের সম্পর্কে জানতে? তারা তাদের অবস্থান থেকে আমাদের অনেক কিছুই দিয়েছেন, এখন আমাদের পালা আমরা তাদেরকে কতটুকু স্মরণ রাখবো, কিভাবে রাখবো সেটা নিয়ে আমাদের কিছুটা ভাবার। এভাবে প্রবাসে আমাদের এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম আসবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে নতুন প্রজন্ম অবশ্যই আগের প্রজন্মকে স্মরণ করতে পারলে, তাদের সাথে সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে পারলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম লক্ষ্য হারাবে না। এভাবেই গড়ে উঠবে আমাদের মধ্যে সম্প্রীতি। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে পুরাতন প্রজন্মকে নতুনদের কাছে তুলে ধরা। আইরিশ বাংলা টাইমসের পক্ষ থেকে আমরা চেষ্টা করেছি দুই প্রজন্মের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে সহায়তা করতে।

আমরা জাকিয়া রহমান ও তার সমবয়সী সকল প্রবাসী তারকাদের শুভকামনা করি।

Facebook Comments Box