বইমেলা আয়ারল্যান্ড ২০২২নিয়ে একান্ত ভাবনা।
উত্তর পশ্চিম ইউরোপের দ্বীপ রাষ্ট্র আয়ারল্যান্ড।
কয়েকশ বছর বৃটিশ উপনিবেশের অধীনে থাকা দেশটি,এক পর্যায়ে যুদ্ধ ও সংগ্রামের ভিতর দিয়ে
স্বাধীন হয় বৃটিশ শাসন থেকে। বৃটিশ উপনিবেশের
শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে আইরিশরা ধীরে ধীরে গড়ে
তুলে নিজস্ব সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
একশত বছর আগেও যে দেশটি ছিল কৃষি নির্ভর,
সেই দেশটি আজ বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি। পাহড়ি ভূ-খন্ড ,পোতাশ্রয় ও সবুজের সমারোহে মিশ্রিত আয়ারল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বিশ্বের পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্হিতিশীলতার জন্য বিদেশীদের কাছে এই ছোট্ট দ্বীপ দেশটির রয়েছে বেশ সুপরিচিতি।
আয়ারল্যান্ডে রয়েছে আধূনিকতা ও বিলাসিতার
নানা উপকরণ। অন্যান্য কমিউনিটির মত বাংলাদেশী কমিউনিটিও সময়ের ব্যবধানে শক্ত অবস্হান গড়ে তুলেছে আয়ারল্যান্ডে।পেশাগত কাজের পাশাপাশি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বাংলাদেশীরা নিজেদের অক্লান্ত সাধনার মাধ্যমে দেশের মর্যাদাকে নিয়ে গেছেন অসীম এক উচ্চতায়।
বিশেষ করে নিজ ভূ-খন্ডে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মত কাজগুলো যতটা সহজ, ততটা সহজ নয় প্রবাসের মাঠিতে। পরবাসে নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে ভিন্ন পরিবেশে এই কাজগুলো করতে হয় প্রবাসীদের। শত বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে কিছু আলোকিত মানুষ তবুও এই কাজগুলো করেন। সুস্হ সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মানের চেষ্টায় কিছু মানুষ সব সময় নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেন ।
আয়ারল্যান্ড প্রবাসী কিছু আলোকিত মানুষ গত কয়েক বছর ধরে কমিউনিটির জন্য এমন কিছু সৃষ্টিশীল কাজ করছেন, যেগুলো কমিউনিটির মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করেছে অনেকাংশে। তাঁরা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার আলোক রশ্মি দিয়ে কমিউনিটিকে আলোকিত করছেন, কমিউনিটিকে দেখাচ্ছেন সুপথ।
দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলে, হৃদয়ে মা-মাঠির প্রতি ভক্তি থাকলে, লক্ষ-কোটি মাইল দূরে থেকেও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সামাজিক কর্মকান্ডের দ্বারা প্রবাসের বুকে যে, এক টুকরো বাংলাদেশের নির্মল প্রতিচ্ছবি আঁকা যায়, তার কিছু দৃষ্টান্ত স্হাপন করে দেখিয়েছেন কমিউনিটির শ্রদ্ধেয় অগ্রজরা। তাদের বহুল নন্দিত কাজের মধ্যে একটি হলো “বইমেলা”। আগামী ১৫ই মে ২০২২ ডাবলিনে অনুষ্টিত হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় “বইমেলা আয়ারল্যান্ড ২০২২”। প্রথম বইমেলা অনুষ্টিত হয়েছিল ২০২০ সালের ১৬ই ফ্রেব্রুয়ারি।
“বইমেলা” বা “গ্রন্হমেলা” শব্দ দুটি বাঙালির প্রাণের স্পন্দে স্পন্দে রন্ধিত রয়েছে। শব্দ দুটি বাঙালি জাতির প্রতিধ্বনি। ফেব্রুয়ারী মাস আসলে অমর বইমেলার আনন্দে মুখরিত হয় পুরো দেশ। সমস্ত দেশজুড়ে গড়ে উঠে বইমেলার স্টল। সেই অমর একুশে বইমেলা উৎসব আজ ৬৮ হাজারের ভৌগলিক সীমানা পেরিয়ে বিদেশে উৎযাপন হচ্ছে নানা কলরবে। শত ব্যস্ততাও সত্বেও নিজেদের ইতিহাস,সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালনের জন্য প্রাণের বইমেলায় উপস্হিত হচ্ছেন প্রবাসীরা।
উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশ্বে যতরকম মেলা হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো বইমেলা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক বইমেলা হয়। লাখ লাখ জ্ঞান পিপাসু মানুষের পদাচরণে সেই বইমেলাগুলো পরিনত হয় আলোর মেলায় ।
পৃথিবীতে এই বই সংগ্রহের রীতি বেশ পুরনো। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, প্রাচীন চীনারা বইকে খুবই গুরুত্ব দিত। তাই নিজেদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্যই চীনারা খ্রিষ্টীয় ৯৬০ সাল থেকে বই সংগ্রহ শুরু করে।
খ্রিষ্টীয় পনেরো শতকে জার্মান নাগরিক জোহানস গুটেনবার্গ Johansnes Gutenberg মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কার করার পর অনেকে মনে করেন সেই সময় থেকেই বইমেলার সূচনা হয় ইউরোপের জার্মানি থেকে। জার্মানির লিপজিগ শহরে বিশ্বের প্রথম বইমেলা অনুষ্টিত হয়েছিল বলে অনেকের দাবী।
কিন্তু কিছু সূত্রমতে প্রথমে বইমেলা শুরু হয়েছিল জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে। তবে লিপজিগ খুব বড় করে মেলার আয়োজন করায় ওটার নামই বেশি প্রচার পায় লোকজনের মুখে। সে সময় বইমেলাগুলো তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এর প্রভাব। সতের শতকের পর ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য কিছু দেশে বইমেলা শুরু হয়।
আর লাল সবুজের বাংলাদেশে অমর একুশে “গ্রন্থমেলা” নামে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে যে “বইমেলা” চলে, সেটির
ইতিহাস খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।
বইমেলার চিন্তাটি প্রথমে মাথায় আসে ষাটের দশকের প্রয়াত কথাসাহিত্যিক এবং ন্যাশনাল বুক সেন্টার (বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র) সাবেক পরিচালক সরদার জয়েনউদদীনের কাছ থেকে। তিনি এক সময় বাংলা একাডেমিতে কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯১৮ – ২২ ডিসেম্বর, ১৯৮৬) ছিলেন একজন বাংলাদেশী লেখক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও সম্পাদক।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশে বইমেলার প্রবর্তক। সরদার জয়েনউদ্দীন বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক-এ ভূষিত হন।
জয়েনউদ্দীন ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত থাকা অবস্হায় তাঁর তত্ববাধানে বাংলা একাডেমি প্রচুর বিদেশি বই সংগ্রহ করে। এর মধ্যে একটি বই ছিল Wonderful World of Books. এই বইটি পড়তে গিয়ে তিনি হঠাৎ দুটি শব্দ দেখে পুলকিত বোধ করেন। শব্দ দুটি হলো : ‘Book’ এবং ‘Fair, (বই+মেলা)। অন্যান্য মেলার ন্যায় বইয়েরও যে মেলা হতে পারে এবং বইয়ের প্রচার-প্রসারের কাজে বইমেলার গুরুত্ব, এই বই পড়েই তিনি উপলব্ধি করেন।
সেই সময় তিনি ইউনেস্কোর শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন। কাজটি শেষ হওয়ার পর তিনি ভাবলেন বিষয়গুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবেন। তখন প্রদর্শনীর পরিবর্তে মেলার চিন্তাটি জয়েনউদ্দীনের মাথায় আসে।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। অবশেষে ১৯৬৫ সালে
তিনি একটি শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) নিচতলায়। যত দূর জানা যায়, এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা।
জাতির মেধা, মনন, সৃজনশীলতা নিয়ে সবচেয়ে বড় এই আয়োজন সাধারণ মানুষের কাছে এখন প্রাণের মেলা হিসেবেও সমাদৃত।
আয়ারল্যান্ডে বইমেলা একবারে নতুন ।এটির বিকাশ হয়েছে বেশি দিন হয়নি। কমিউনিটি বান্ধব বিশিষ্ট সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমানের চিন্তা থেকে এবং পরবর্তীতে কমিউনিটির অন্যান্য বিছু সৃষ্টিশীল ব্যক্তিবর্গ যথা, মোহাম্মদ মোস্তফা, শাহাদাত হোসেন,আখতার হোসেন, লুবনা হোসেন,কাজী কবির, শামীম আহমেদ সহ আরো কিছু বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে ২০২০ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি ডাবলিনে আনুষ্টানিকভাবে প্রথম বইমেলা অনুষ্টিত হয়।
আয়ারল্যান্ডব্যাপী বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল উক্ত বইমেলা। প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ও পুরুষের পাশাপাশি সেই মেলায় উপস্হিত হয়েছিল প্রচুর তরুণ-তরুণী এবং ছোট্ট শিশুরা। আনন্দে উদ্ভাসিত ছিল পুরো কমিউনিটি। ২০২০ এর বইমেলাকে কেন্দ্র করে কমিউনিটির মধ্যে বাঁধভাঙা উল্লাস লক্ষ্য করা গেছে। সময়ের স্বল্পতা থাকা সত্বেও উদযাপন কমিঠির নিরলস প্রচেষ্টার কারণে “বইমেলা আয়ারল্যান্ড ২০২০” অত্যন্ত সফল হয়েছিল বলে কমিউনিটি মনে করে।
আধুনিকতা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া অসম্ভব। প্রত্যেক মানুষই আনন্দপ্রিয়, বইও আনন্দের একটি বড় মাধ্যম ।তাই যে কোনো বই মানুষের সুকুমারবৃত্তির জন্য খুব সহায়ক।
করোনার কারণে গত বছর এ বইমেলা আয়োজন করা যায়নি। বলতে দ্বিধা নেই যে, বাংলাদেশী কমিউনিটি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিল পরবর্তী বইমেলার। অবশেষে আসল সেই মহেন্দ্রক্ষণ। কমিউনিটির ব্যাপক আগ্রহ এবং উদ্দীপনার কথা চিন্তা করে ” বইমেলা আয়ারল্যান্ড ২০২২” এর উদযাপন কমিঠি এর ব্যাপক প্রস্তুুতি নিয়ে এবার কিছুটা বড় পরিসরে দ্বিতীয় বইমেলা অনুষ্টানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ১৫ই মে ২০২২ ইং রোজ রবিবার । স্হান : স্ট্রোক বিল্ডিং, ডাবলিন সিটি ইউনিভার্সিটি।
সংঘত কারণে এবারের বহুল প্রতীক্ষিত বইমেলায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আশা করা যাচ্ছে।
জনাব মোহাম্মদ মোস্তফা, শাহাদাত হোসেন, আক্তার হোসেন,আরিফ ভূঁইয়া,নিপা,সাজীলা চৌধুরী, মেহেদী হাসান, মাসুদ সিকদার,ডঃ বিলাল হোসেন প্রমুখ সহ অন্যান্যদের সমন্বয়ে “বইমেলা আয়ারল্যান্ড ২০২২” উদযাপন কমিঠি এই বইমেলাকে সার্বিকভাবে সফল করে তুলতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কমিউনিটিকে নতুন কিছু দেবার তাদের এই প্রত্যয় কৃতজ্ঞতা চিত্তে স্মরণ রাখবে কমিউনিটি দীর্ঘদিন।
আলো যেমন জাগতিক নিয়মে অন্ধকার দূর করে সব কিছু মূর্ত করে, তেমনি বই মানুষের মনের ভেতরে জ্ঞানের আলো এনে যাবতীয় অন্ধকারকে দূর করে চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত করে। আলো অনেক সময় পৃথিবীর অনেক জায়গায় পৌঁছতে পারে না প্রাকৃতিক জঠিলতার কারণে। কিন্তুু বই অতীত থেকে ভবিষ্যৎ , নিকট থেকে দূরে , প্রান্ত থেকে অন্তে এমনকি যুগ থেকে যুগান্তরে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দিতে পারে । তাই দেশ -কালের সীমানা অতিক্রম করে জ্ঞানের আলো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে একমাত্র বই।
পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হল আত্মশিখন । আর বই সেই আত্মশিখনের শ্রেষ্ঠ সহায়ক । বই এমন এক পরম বন্ধু, যার সাথে কখনো ঝগড়া হয়না। ঘরের চার দেয়ালে বিনোদন থেকে শিক্ষা ,আত্ম উপলব্ধি, অবসর যাপন থেকে নিঃসঙ্গতা দূর — সব কিছুর শ্রেষ্ঠ অবলম্বন হতে পারে একমাত্র বই। তাই বই পড়া এবং বই সংগ্রহ করে রাখার জন্য বইমেলার বিকল্প নাই।
পরিশেষে আয়ারল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটির “বইমেলা আয়ারল্যান্ড ২০২২ “এর উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি। এই ধরণের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক মূলক অনুষ্টান চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশী কমিউনিটি আলোয় আলোকিত হউক, এই প্রত্যাশা নিরন্তর।
সৈয়দ আতিকুর রব,
আয়ারল্যান্ড