ফেসবুকের নতুন কর্পোরেট নাম ও মেটাভার্স প্রযুক্তি – ওমর এফ নিউটন

0
829

প্রযুক্তি আমাদেরকে কি দেয় নি? বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ভ্রমণ থেকে শুরু করে ভ্রমণ ছাড়াই ধরণীর যে কোন প্রান্ত থেকে যে কারো সাথে চাক্ষুষ যোগাযোগ সবই এখন নিত্যকার ব্যাপার। কিন্তু এরপরেও থেমে নেই প্রযুক্তি। আপনি হয়ত ভাবতে পারেন প্রযুক্তি এর থেকে আর কি দিতে পারে যা ভাবনারও বাহিরে। কিন্তু মানুষের গন্তব্য যে ইনেভিটেবল।

একসময় আপনার কাছে পত্রবাহকের মাধ্যমে বার্তা পৌঁছাত আপনার কাছে, যা ছিল সময় সাপেক্ষ এবং কষ্টসাধ্য। এরপর কোন বাহক ছাড়াই বার্তা পৌঁছত বেতার টেলিফোনের মাধ্যমে, যেটাও সবার নাগালের মধ্যে ছিলনা। এর পর মোবাইল প্রযুক্তি সবকিছু বদলে দিল নিমিষে। মুহূর্তের মধ্যে বার্তা পৌঁছে যেতে লাগল পৃথিবীর প্রতিটি কোনায়। এরপরের পরিবর্তন যা কিছু, তা হয়ে গেল চোখের নিমিষেই। আপনার হস্তচালিত যন্ত্রটিতে কোন তার সংযোগ ছাড়াই উঠে এল ইন্টারনেট। এরপর থেকে প্রিয়জনের কথা শুধু আপনার কর্ণকুহূরেই প্রবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, প্রিয়জনের ছবিও ভেসে উঠল আপনার হাতের ছোট সেই যন্ত্রটিতে। শুধু প্রিয়জনই না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলার মাধ্যমে আপনাকে যুক্ত করল বিশ্ব পরিবারের সাথে।

আগেই বলেছি, প্রযুক্তি তার সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে প্রস্তুত। প্রযুক্তি আপনাকে শুধু কথা বলা আর চাক্ষুষ দেখার মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে চাচ্ছে না এখন আর। প্রযুক্তি আপনাকে দিতে চাচ্ছে বাস্তব অনুভূতিও। আপনার ফোনে কথা বলাটাই মনে হবে আপনার লিভিং রুমে বসে আপনার প্রিয়জনের সাথে একসাথে চা খাচ্ছেন আর কথা বলতেছেন। যা আপনার প্রিয়জনের উপস্থিতির অনুভূতি অনুভব করবেন। ধরুন আপনার কোন এক বন্ধু এন্টার্কটিকায় কনকনে ঠাণ্ডায় বসে পেঙ্গুইন দেখতেছে আর সেই ছবি বা ভিডিও আপনি বাংলাদেশে বসে দেখে থরথর করে কাঁপতেছেন অথবা সাহারায় মরুর উঠের পৃষ্ঠদেশে বসে সাহারা পাড়ি জমাচ্ছেন, কেউ একজন ফেসবুকে পোস্ট করা সে ছবি রাশিয়ায় হিমাংকের নিচের তাপমাত্রায় বসে থেকে দেখে দরদর করে ঘামতেছেন।

বহুমাত্রিক এই অনুভূতি দিতেই কাজ করছে মেটাভার্স প্রযুক্তি। মেটাভার্স এমন মূর্ত ও শরীরী ইন্টারনেট, যেখানে আপনি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবেন না, নিজেও ঢুকে পড়বেন যাবতীয় অভিজ্ঞতার কেন্দ্রবিন্দুতে। যা হবে কল্পনার এক পৃথিবী, নতুন এক ভবিষ্যৎ।

মেটাভার্স প্রযুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই ফেসবুক কর্পোরেশনের নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘মেটা’। 

এই মেটাভার্স প্রযুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই ফেসবুক কর্পোরেশনের নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘মেটা’। ‘মেটা’ শব্দটি এসেছে একটি গ্রিক শব্দ থেকে যার ইংরেজি অর্থ ‘বিয়ন্ড’, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘’আপাত দৃশ্যমান নির্দিষ্ট সমাপ্তির পরও যার আরো অস্তিত্ব রয়ে যায়’’।

এই নতুন কল্পনার ভবিষ্যতে কোন যানবাহন ব্যবহার না করেই আপনি হলোগ্রাম হিসেবে একটি টেলিপোর্ট করতে পারবেন যা আপনাকে ভার্চুয়ালি পৌঁছে দিবে আপনার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। যা ফলে শারীরিকভাবে উপস্থিত না হয়েও আপনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন যেকোন মিটিং, সম্মেলন, কনসার্ট কিংবা দূরদেশে আপনার পরিবারের খাবার টেবিলে। শারীরিকভাবে উপস্থিত না থেকে উপস্থিতির আরকেটি সুবিধাজনক দিক হচ্ছে আপনাকে ট্রাফিকে আটকে থাকতে হচ্ছেনা, কিংবা আপনার কারণে ট্রাফিক তৈরি হচ্ছেনা। সেই সঙ্গে হ্রাস ঘটাতে পারবেন আপনার কার্বন ফুটপ্রিন্টেও।

আজকে আপনার কাছে মূর্তমান অবস্থায় রয়েছে এমন কত জিনিসই ভবিষ্যতে পরিণত হবে নিছক হলোগ্রামে। আপনার টিভি, একাধিক মনিটর সহযোগে আপনার পারফেক্ট ওয়ার্ক সেটআপ, আপনার বোর্ড গেম এবং আরো কত কিছু- কারখানায় সেসব জিনিসের প্রতিটি অংশ জোড়া লাগানোর বদলে, সেগুলো কেবল হলোগ্রাম হয়েই থাকবে, আর সেগুলো তৈরি করবে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নির্মাতারা।

আপনি বিভিন্ন ডিভাইস ঘুরে ঘুরে এসব অভিজ্ঞতা লাভ করবেন- অগমেন্টেড রিয়েলিটি গ্লাসের মাধ্যমে শারীরিক পৃথিবীতে উপস্থিত থাকবেন, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি দিয়ে নিমজ্জিত হবেন অন্য আরেক পৃথিবীতে, এবং ফোন ও কম্পিউটার দিয়ে প্রবেশ করবেন ইতোমধ্যেই বিদ্যমান প্ল্যাটফর্মগুলোতে। তবে এর মানে কিন্তু আরো বেশি সময় স্ক্রিনে কাটানো নয়; এটি হলো আমরা ইতোমধ্যেই যেসব সময় কাজে ব্যয় করি, সেগুলোর আরো ভালোভাবে ব্যবহার। বলেছেন ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ।

মার্ক জুকারবার্গ আরো বলেন, মেটাভার্সটি কেবল একটি কোম্পানিই তৈরি করবে না। এটি তৈরি হবে সেসব নির্মাতা ও ডেভেলপারদের হাত ধরে, যারা ইন্টারঅপারেবল (আন্তঃব্যবহারযোগ্য) নতুন নতুন অভিজ্ঞতা ও ডিজিটাল আইটেম তৈরি করছে।

মার্ক জুকারবার্গ – ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা

এই মুহূর্তে আমাদের ভূমিকা হবে মৌলিক প্রযুক্তি, সামাজিক প্ল্যাটফর্ম এবং সৃজনশীল উপকরণসমূহের উন্নতিকে আরো ত্বরান্বিত করা, যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় মেটাভার্সে, এবং আমাদের সামাজিক মাধ্যম অ্যাপগুলোর মাধ্যমে এসব প্রযুক্তি যেন ছড়িয়ে পড়ে। মার্ক জুকারবার্গ বিশ্বাস করেন যে, মেটাভার্স এখনকার চেয়ে শ্রেয়তর সামাজিক অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে পারবে।

প্রথম দিন থেকেই মেটাভার্সে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আরো প্রতিষ্ঠা করা হবে ওপেন স্ট্যান্ডার্ড ও ইন্টারঅপারেবিলিটি।

আগামী দশকের মধ্যে মেটাভার্স এক বিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মার্ক জুকারবার্গ। মেটাভার্সের ডিভাইসগুলো অলাভজনক মূল্যে বা ভর্তুকির মাধ্যমে প্রদান করা হবে যাতে করে বেশি সংখ্যক মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসা যায়। সাথে সাথে পিসি থেকে সাইড-লোডিং এবং স্ট্রিমিং সমর্থনও অব্যাহত থাকবে, যাতে মানুষের কাছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থাকে এবং তাদের যেন কোয়েস্ট স্টোরে গিয়ে অ্যাপ খুঁজতে বা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে বাধ্য হতে না হতে হয়। পাশাপাশি ডেভেলপার ও ক্রিয়েটর সার্ভিসও খুবই স্বল্প ফিতে প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে, যেন সামগ্রিকভাবে আমরা সৃজনশীল অর্থনীতির প্রসারণ ঘটাতে সক্ষম হয়। তবে সবই করা হবে কোম্পানিকে লাভজনক অবস্থায় রেখে, যাতে সামগ্রিক কোম্পানির লোকসান না ঘটে।

মার্ক জুকারবার্গ বলেন, ‘’আজ আমাদের দেখা হয় একটি সামাজিক মাধ্যম কোম্পানি হিসেবে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্রযুক্তি পণ্যের একটি হলো ফেসবুক। এটি একটি আইকনিক সামাজিক মাধ্যম ব্র্যান্ড। সামাজিক অ্যাপ তৈরি করা সবসময়ই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ থাকবে, এবং এমন আরো অনেক অ্যাপ বানাতে হবে। তবে বলাই বাহুল্য, আসন্ন ভবিষ্যতে আমরা শুধু এই কাজই করব না। আমরা মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য প্রযুক্তি তৈরি করি। মেটাভার্স হবে মানুষের মধ্যকার আন্তঃযোগাযোগের পরবর্তী অধ্যায়, ঠিক যেমনটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ছিল আমাদের প্রথম যাত্রা শুরুর সময়ে’’।

”এখন থেকে আমরা আর ফেসবুক-ফার্স্ট নই, আমরা হবো মেটাভার্স-ফার্স্ট”

জুকারবার্গ আরো বলেন, ‘’এখন থেকে আমরা আর ফেসবুক-ফার্স্ট নই, আমরা হবো মেটাভার্স-ফার্স্ট। এর অর্থ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের আর আমাদের অন্যান্য পরিষেবা গ্রহণ করতে হলে আগে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকার প্রয়োজন হবে না। যেহেতু আমাদের সকল পণ্যে আমাদের নতুন ব্র্যান্ডটি দেখা দিতে শুরু করেছে, আমি আশা করছি বিশ্বব্যাপী মানুষ খুব শীঘ্রই জেনে যাবে মেটা ব্র্যান্ড কী, আর ভবিষ্যতেই বা কী অপেক্ষা করছে’’।

পরিশেষে বলা চলে, সময় এসেছে মেটাভার্সকে সাদর সম্ভাষণ জানানোর। হ্যালো ‘মেটা’।

ফেসবুক ইনকর্পোরেশনের নতুন নাম ‘মেটা’

 

 

Facebook Comments Box