প্রবাসে আমাদের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য

0
463

একটা প্রবাদ আছে, ”বি আ রোমান হোয়েন ইউ আর ইন রোম”, মানে হচ্ছে তুমি যখন রোমে অবস্থান কর, তোমারও উচিত একজন রোমান হয়ে ওঠা। অর্থাৎ যে দেশে আমার অবস্থান ও বাসস্থান, সেই দেশের আইনকানুন, জাতীয় চেতনা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এমনকি রাজনীতি, সমাজের রীতিনীতি, প্রথা, মূল্যবোধ ধারণ করা দরকার, কিন্তু অবশ্যই স্বদেশ-চেতনা ও জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে নয়। কারণ স্বদেশ আমাকে জন্ম দিয়েছে লালন করেছে, কিন্তু প্রবাস আমাকে দিয়েছে জীবন ও জীবীকার সন্ধান।

যে দেশে আমার বসবাস, আমি যদি সেই দেশেরই একজন হয়ে উঠি, তাহলে আমাদের অনেক উচ্চতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। সে জন্য অদক্ষ শ্রমিক থেকে শুরু করে ছাত্র, শিক্ষিত সবাইকেই গন্তব্য দেশের ও সমাজের আইনকানুন, রীতিনীতি, প্রথা, মূল্যবোধ ইত্যাদি সম্পর্কে ধরনা নিয়ে সে মোতাবেক মেনে চলা বাঞ্ছনীয়। যেখানে-সেখানে ময়লা না ফেলা, প্রকাশ্যে থুতু না ফেলা, নিচু স্বরে কথা বলা, বয়স্কদের আসন ছেড়ে দেয়া, অন্যকে পথ ছেড়ে দরজা টেনে ধরা, আড়ালে গিয়ে নাক পরিষ্কার করা, পেপার ন্যাপকিনে মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দেওয়া ইত্যাদি সব ধরনের সৌজন্যবোধের শিক্ষা অর্জন ও পালন করা অবশ্য কর্তব্য। প্রত্যেক প্রবাসী তার নিজ দেশের জন্য এক একজন মুখপাত্র। তার কৃতকর্মই প্রতিফলিত হবে গন্তব্য দেশ ও মানুষের মনে, ভালো হলে ভালো আর খারাপ হলে খারাপ। সুতরাং প্রবাস রাষ্ট্রে নিজ দেশ ও জাতির সুনাম বর্ধনে ও তুলে ধরতে সবারই দায়বদ্ধতা থাকা দরকার। তাহলে বিদেশে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি পাবে, যার সুফল হবে সুদূরপ্রসারী।

ব্যবহার শুধু বংশেরই নয় দেশের পরিচয়ও বহন করে

পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী ও অজস্র স্মৃতি পেছনে ফেলে কেন আমরা মাতৃভূমি ছেড়ে কেন প্রবাসভূমে পড়ে আছি? কারণ তো অবশ্যই আছে, কারণ আমি যা চাই অথবা যে জিনিস আমার প্রয়োজন, যা আমার নিজ মাতৃভূমি আমাকে প্রদান করতে অপারগ বা অসমর্থ সে চাওয়া এবং জিনিসগুলো প্রবাস দেশটি আমাকে দিচ্ছে বা দিতে সক্ষম। সে কারণেই শত কিছু বিসর্জন দিয়ে হলে প্রবাসে পাড়ি জমিয়ে পড়ে থাকা। নিক্তির পাল্লায় মাপলে প্রবাস দেশটি মাতৃভূমি থেকে একটু হলেও বেশি ভারি বিধায়ই আমরা প্রবাসে থাকতে আগ্রহী।

সুতরাং যে প্রবাস আমাকে আমার মাতৃভূমির থেকে বেশি সুবিধা প্রদান করতেছে, যে প্রবাসের কল্যাণে শুধু একক প্রবাসী ব্যক্তিটিই নন তার সাথে জড়িত অনেকেই সুবিধা পাচ্ছেন, তাহলে সে দেশকে নিজের দেশ মনে করে থাকাটাও আমার জন্য অবশ্য কর্তব্য। প্রবাস দেশটিকেও আমার দেয়ার অনেক কিছু রয়েছে। সে দেশের নিয়ম কানুন মানা, দেশের জনগণকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা, কোন অপ্রীতিকর কিছু না করা, সঠিক ট্যাক্স প্রদান করা, অনৈতিকভাবে সরকারি সুবিধা ভোগ না করা, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সুবিধা আদায় না করা, সে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে হেয় প্রতিপন্ন না করা ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন থাকা হচ্ছে একজন সুনাগরিকের বৈশিষ্ট্য। দেশ ও দেশের নাগরিক একে অন্যের পরিপূরক। দেশ যেমন আমাকে সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে, তেমনি দেশের জন্যও আমাদের অবদান থাকা উচিত। অন্যথায় সেদেশের সুবিধাভোগী স্বার্থপরের নামান্তর বলে নিজেকে গণ্য করা হবে।

প্রবাসে আমরা যেখানেই যাই, যা কিছুই করি, সর্বত্র আমরা আমাদের পদচিহ্ন রেখে আসেই। আমি আমার কর্মস্থলে আমি যদি ভালো কাজ করি, সততার সাথে দায়িত্ব পালন করি তাহলে সে কোম্পানিতে আমি আমার দেশের সুনাম রেখে আসতেছি। পরবর্তীতে ঐ কোম্পানি আমার দেশের কোন কর্মী নিয়োগ করতে দ্বিধা করবে না। আমরা প্রতিনিয়ত দোকানপাট, হাসপাতাল, স্কুল, খেলার মাঠ ইত্যাদি স্থানে গমন করি। সর্বত্র আমরা যেন আমাদের ভালো দিকটা রেখে আসি। রাস্তায় চলার পথে, পদব্রজে কিংবা গাড়িতে, পাবলিক যানে কিংবা পাবলিক স্থানে আমাদের কথায়, চলনে, কর্মে কেউ যেন বিরক্ত, মনঃক্ষুণ্ণ কিংবা কষ্ট না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ম্যাজিক শব্দ স্মরণ রাখুন

প্রয়োজনে বিদেশগামী সকল দক্ষ-অদক্ষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছাত্র-কর্মজীবী, পর্যটক সবাইকেই গন্তব্য দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সৌজন্যতাবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যারা প্রবাসে অবস্থানরত, স্থানীয় কমিউনিটি দ্বারা কিংবা স্থানীয় হাই কমিশনের উদ্যোগে প্রশিক্ষনশালা ঘটন করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি কমিউনিটি বর্ধিত হচ্ছে। জনশক্তিকে রপ্তানি করার পথ যাতে আরও বিস্তৃত হয় সে জন্য আগে দেশের সুনাম বর্ধন জরুরি।

প্রবাসে ক্ষণিকের জন্য থাকি আর স্থায়ীভাবে থাকি, সর্বাবস্থায় আমাদেরকে সেদেশে সুনাগরিকের মত থাকা বাঞ্ছনীয়। 

সংস্কৃতে একটি কথা আছে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’, অর্থাৎ ”জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ”। জন্মভূমি অবশ্যই আমাদের প্রিয়। কিন্তু যে দেশ আমাদেরকে জীবন ও জীবিকা প্রদান করে, প্রদান করে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা সে দেশের প্রতিও আমাদের ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা কোন অংশেই কম থাকা উচিত নয়।

”আমি দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিশ্বকে ভালোবাসি’’। রবীন্দ্রনাথের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও বলতে পারি, ”বিশ্বের দরবারে দাঁড়িয়ে আমি দেশকে ভালবাসি’’। তারমানে নিজ দেশকে যেমন ভালোবাসি, আমি বিশ্বকেও তেমনি ভালোবাসব।

ওমর এফ নিউটন
বার্তা সম্পাদক
আইরিশ বাংলা টাইমস

Facebook Comments Box