প্রবাসীর অছিয়ত নামা

0
867

বাংলার কোন এক কবি বলে ছিলেন “এ পৃথিবী যেমন আছে, তেমনই রবে, সুন্দর এ পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে।” 

জন্ম নিলেই মৃত‌্যুকে বরন করতে হবে, মানুষের জীবনের এ এক চরম সত‌্য মূহুর্ত। মানুষ দুনিয়াতে আসে আবার চলে যাওয়ার জন‌্যই। আমার আপনার সামনে যেকোন সময় মৃত‌্যুর দুত এসে বলবে “চলো’ , আর তখনই আমাদের চলে যেতে হবে সবকিছু পেছনে ফেলে। 

কিন্তু আমি মরে যাব এই কথাটা বলতেও আমরা ভয় পাই। আবার যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি মরে গেলে আমাকে কোথায় কবর দেওয়া হবে ? তখন আমরা এর উত্তর দিতেও ভয় পাই কিংবা এড়িয়ে যাই । 

অথচ প্রত‌্যেক প্রবাসীর উচিত অত‌্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আপন জনের নিকট অছিয়ত করা বলে দেওয়া যে আমি মারা গেলে আমার কবর কোথায় হবে । মারা যাওয়ার পর আমাদের কবর কি আয়ারল‌্যান্ডে হবে নাকি বাংলাদেশে হবে? এই বিষয়টা পরিস্কার করে রাখতে হবে। নয়তো আপনার মৃত‌্যুর পর কেউ আপনাকে আয়ারল‌্যান্ডে কবর দেওয়ার জন‌্য প্রস্তুতি নিবে আবার দেখা যাবে আপনার দেশের আত্মিয় স্বজন আপনার লাশ দেশে নেয়ার জন‌্য চাপ প্রয়োগ করছে। তখন আপনার লাশটা কাটা ছেড়া করে লাশের ভিতর থেকে সব ফেলে দিয়ে শুধু চেহারাটা নিয়ে  দীর্ঘ ৭/৮ দিন পর আপনার পচা্ঁ র্দূঘন্ধ লাশ নিয়ে দেশে উপস্থিত হবে। মানুষ মনে করে, দাফনে অংশগ্রহণ করাটাই একমাত্র ফজিলতের বিষয়। ওয়ারিসের জন্য একমাত্র কর্তব্য পালনীয় বিষয়। কেউ এ দাফনে বা জানাযায় অংশ নিতে না পারলে তাকে অন্যচো্ঁখে দেখা হয়। অথচ মৃত ব্যক্তির জন্য দু’য়া  মাগফিরাত করা, কবর জিয়ারত করা, দান সদকার সওয়াব পৌঁছানোসহ আরো কাজ আছে যা আত্মীয়রা সবসময় করতে পারে।  

প্রথমত , একজন মৃত ব‌্যাক্তির লাশ প্রবাস থেকে নিয়ে দেশে কবর দিতে গেলে টাকা একটা প্রধান বিষয়। আর দ্বিতীয়ত সমস‌্যা হলো ধর্মীয় বিষয় ।একজন মৃত ব‌্যাক্তির লাশ অন‌্য দেশে নিয়ে যাওয়া রাসুল সা্ঃ এর সুন্নত অনুসারে সম্পূর্ন অপছন্দনিয়। একটি হাদীসে নবীজী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব সুন্দর বলেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তোমরা তাকে আটকে রেখো না। তাকে দ্রুত দাফন করে দিও। [আলমুজামুল কাবীর, তাবারানী, হাদীস : ১৩৬১৩; ফাতহুল বারী ৩/২১৯]। আবার এক দেশ থেকে অন‌্য দেশে লাশ নিতে দীর্ঘ  প্রায় ৭ /৮দিন সময় লাগে যা কোরআন এর  সমর্থন পাওয়া যায় না। হাদীস গবেষনা করলে যা পাওয়া যায় তাতে এটাকে বলা হয় “মাকরুহ তাহরিমি” । ইসলামে “মাকরুহ” হলো আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ আর “মাকরুহ তাহরিমি” আরো বেশী অপছন্দনীয়। 

এটাও আমাদের ভেবে দেখার বিষয় যে, মৃত ব‌্যাক্তির লাশ দেশে পাঠানোর জন‌্য আপনি যদি অর্থ দান করেন তাহলে আপনি পরোক্ষ ভাবে রাসুলের সুন্নতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন কি না? আমরা ইসলামে এই রকম অনেক কিছুই প্র‌্যাক্টিস করি যা ইসলাম দ্বারা সমর্থন যোগ‌্য হয় না। 

এবার আসুন দেখি দূর-দেশে লাশ নিতে লাশ’কে কি করতে হয়।  লাশ দূর দেশে নেওয়ার জন‌্য লাশটি  Process করতে হয় আর এটাকে বলে Embalming করা যার অর্থ মমি করা। ইসলাম এটাকে সমর্থন করে না । 

IATA (a worldwide airline trade association) rules state that if moved from one country to another, a body should have an embalming certificate. Tony Rowland, senior partner at Rowland Brothers International funeral directors, warns: “In many cases when embalming is not up to US or UK standards, the result is that a body is totally unviewable when it returns to its homeland.”

Embalming করতে লাশটাকে প্রথমে কাটা ছেড়া করে ভেতরের সমস্ত কিছু ফেলে দেয়া হয়। এটা মৃত ব‌্যাক্তির জন‌্য অবশ‌্যই অসম্মান জনক। আর মৃত মানুষটি যদি মুসলিম নারী হয় তবে সেটা হবে তার জন‌্য, তার পরিবারের জন‌্য আরো অপমান জনক। কারন, হতে পারে কোন অমুসলিম পুরুষ ডাক্তার এই মৃত মুসলিম মহিলার লাশকে কাটা ছেড়া করে Embalming করছেন। যেখানে ইসলাম বলে মৃত ব‌্যাক্তির লাশকে আস্তে করে ধরে সম্মান এবং পর্দার সাথে তাকে সমাহিত করতে আর সেখানে করা হচ্ছে  ইসলামের উল্টো কাজ।

তার পর যেটা হয় তাহলো, লাশের শরীর থেকে তার সমস্ত রক্ত মেশিন দিয়ে টেনে বের করা হয়। আমি বলব, এটা লাশকে কবরস্ত করার আগেই এক প্রকার “আযাব” । তার পর লাশের শিরা উপশিরা দিয়ে মেশিনের সাহায‌্যে ফরমালডিহাইড জাতীয় Fluid ডুকানো হয়। লাশকে দীর্ঘ দিন তাজা দেখানোর জন‌্য এই Formaldehyde Fluid ব‌্যবহার করা হয় যদিও লাশ এত দীর্ঘ সময় তাজা রাখা সম্ভব নয়।

এই ফরমালডিহাইড ( Formaldehyde) তৈরী হয় মিথান্যাল আর এথান‌্যাল দিয়ে। এই গুলো হলো Impure Substances যা অপবিত্র । এগুলো দিয়ে তৈরী হয় মদ। অর্থাত এলকোহল ​তৈরীর জন‌্য এক ধরনের প্রধান রাসায়নিক যৌগ। যা বর্ণহীন ও দূর্গন্ধযুক্ত  হিসেবে এর সবিশেষ পরিচিতি রয়েছে। এটি আগুনে জ্বলে এবং বিষাক্ত পদার্থবিশেষ।

এখন আপনিই বলুন  মরে গিয়ে বা মৃত লাশের সাথে আল্লাহ এবং তার রাসুল সাঃ এর অপছন্দনিয় কাজ করবেন কি না। সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। মৃতদেহকে বিলম্বে দাফন করতে দুনিয়ার কষ্টদায়ক নানা প্রকৃতির জিনিস ব্যবহার করতে হয় যা সুস্থ মানুষও ব্যবহার করে না। হিমাগারে রাখা ফর্মালিন, মেডিসিন ইত্যাদি হলো মৃতব্যক্তিকে পঁচন থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টামাত্র। ইসলামী শারিয়াহ অনুসারে মৃতের গোসল দিয়ে আতর লোবান লাগিয়ে সম্মানের সহিত কাফন-দাফন ও জানাযা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা উত্তম। আর যদি শুধুমাত্র লাশ নিজ দেশে নেয়ার জন‌্য কেটে ছিড়ে লাশের শরীরের নাপাক এলকোহল দিয়ে কষ্ট দিয়ে দীর্ঘ ৭/৮ দিন পর পচা্ঁ র্দূঘন্ধ দেহটা দেশে নেয়া কতটা যুক্তি সংগত। 

সচেতন মুসলমান হিসেবে আপনি নিঃশ্চয়ই আপনার লাশ এই ভাবে দেশে নিতে অছিয়ত করবেন না। আর যদি আপনি প্রবাসে ব‌্যাচেলর বা একাকি বাস করেন তাহলে আজই আপনার ফ‌্যামেলীকে দেশে ফোন করে অছিয়ত করুন। তাদের বলুন আপনি যেখানে মারা যাবেন সেখানেই আপনার কবর হবে এবং তারা যেন এটা মেনে নেয়।  কখন কার মৃত‌্যু হবে কেউ জানে না কারন জন্ম এবং মৃত‌্যু আল্লাহর হাতে।

আর যারা প্রবাসে ফ‌্যামেলী নিয়ে বসবাস করেন তারা যদি এখনও কোন অছিয়ত না করে থাকেন তাহলে আজই আপনার স্বামী বা স্ত্রীর সামনে দাড়িয়ে সাহস করে অছিয়ত করে ফেলুন। তা না হলে আপনার মৃত‌্যুর পর আপনার লাশ দাফন করা নিয়ে ফিতনা সৃষ্টি হতেও পারে। 

আল্লাহ সুবাহ নাহু তা’য়ালা আমাদের সকলকে ঈমানের সাথে মৃত‌্যুকে আলিঙ্গন করার তৌফিক দান করুন,আমীন।

[ এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল “জুন ২০১৮”  “আইরিশ নোটিশ বোর্ড” ফেইস বুক পেইজে]

লেখক : মশিউর রহমান।
Swords, Dublin,Ireland.
email: myrobisallah@gmail.com

[তারিখ: ৪ জুলাই ২০২০]

Facebook Comments Box