আজ ২০২১ জানুয়ারির প্রথম দিন, ইইউ থেকে ইউকের বেরিয়ে যাবার দিন। আজ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর সাথে ইংল্যান্ডের মধ্যকার সম্পর্ক আর আগের মত থাকতেছে না। ইউরোপীয় দেশ হলেও আয়ারল্যান্ডের সাথে ইংল্যান্ডের মধ্যে চুক্তির কিছুটা ভিন্নতা থাকবে, যা অন্যান্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশগুলোর সাথে থাকবেনা।
১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড একই সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর সদস্য হিসেবে যোগদান করে। কিন্তু ইংল্যান্ডের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার ঘোষণায় ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের সম্পর্কের ব্যাপারে যে প্রশ্নগুলোর উদ্রেক করে সেগুলো হলঃ
– নর্দান আয়ারল্যান্ডে শান্তি চুক্তি, যা গুড ফ্রাইডে বা বেলফাস্ট চুক্তি নামে পরিচিত; তার কি হবে?
– কিভাবে নর্দান আয়ারল্যান্ড ও রিপাবলিক আয়ারল্যান্ডের সীমানা পরিচালিত হবে? উভয় পণ্য আমদানি রপ্তানি ও মানুষের চলাচলের ক্ষেত্রে।
– কিভাবে নর্দান আয়ারল্যান্ড এবং রিপাবলিক আয়ারল্যান্ড, এবং রিপাবলিক আয়ারল্যান্ড ও ইউকে এর মধ্যে সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড বজায় থাকবে?
তবে এরই মধ্যে কিছু ইস্যু ইতিমধ্যে সমাধান হয়েছে আয়ারল্যান্ড এবং নর্দান আয়ারল্যান্ডে ব্রেক্সিট প্রোটকোলের মাধ্যমে। যেটা রিপাবলিক আয়ারল্যান্ড এবং নর্দান আয়ারল্যান্ডের মাঝে হার্ড বর্ডার হওয়া থেকে বিরত রেখেছে।
গুড ফ্রাইডে/বেলফাস্ট চুক্তি এবং ব্রেক্সিট পরবর্তী প্রোটকোল
সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের অবসান ও নর্দান আয়ারল্যান্ডের শক্তি ভাগাভাগির লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে গুড ফ্রাইডে/বেলফাস্ট চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নর্দান আয়ারল্যান্ডের জনগণের আইরিশ নাগরিকত্ব নেয়ার এবং ইইউ জনগণের অবাধ প্রবেশের অনুমতি প্রদান করে। এতে করে উভয় দেশের জনগণের অবাধ চলাচল, শুল্কমুক্ত দ্রব্য আমদানি রপ্তানি ও সীমানায় কোন শারীরিক চেক ও হার্ড বর্ডার বা প্রহরী চৌকি না থাকার প্রতিশ্রুতি চুক্তিতে লিপিবদ্ধ করা হয়।
গুড ফ্রাইডে চুক্তির কারণেই মূলত রিপাবলিক আয়ারল্যান্ড এবং নর্দান আয়ারল্যান্ডের মাঝে কোন হার্ড বর্ডার থাকবে না এবং কমন ট্রাভেল এরিয়া হিসেবে ফ্রি মুভমেন্ট আগের মতই বজায় থাকবে। যেমন, ব্রেক্সিট পূর্ববর্তীতে এক জন আইরিশ নাগরিক ইউকে তে এবং একজন ব্রিটিশ নাগরিক আয়ারল্যান্ডে যেভাবে চলাচল করে আসছিল, ব্রেক্সিট পরবর্তীতেও ঠিক একইভাবে চলাচল করতে পারবে। সরকারী সুযোগ সুবিধা এবং চাকুরী করার ক্ষেত্রেও নিয়ম একই থাকবে। যা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের জন্য প্রযোজ্য হবেনা।
ব্রেক্সিট বাণিজ্য চুক্তি/ট্রেড-ডিল
অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ব্রেক্সিট ডিল সম্পন্ন হয়। ব্রেক্সিট ডিলের প্রধান উপকরণ হচ্ছে শুল্কমুক্ত ও কাস্টম মুক্ত আমদানি রপ্তানি। যার ফলে আমদানি রপ্তানিতে অতিরিক্ত খরচ ও সময় দুইই সাশ্রয় হবে। এতে উভয়ই ইউরোপীয় দেশগুলা ও ইউকে উপকৃত হবে। তবুও কিছু কাস্টম নিয়ম মেনেই দ্রব্য আমদানি রপ্তানি করতে হবে এবং তা হবে গ্রেট ব্রিটেন ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের বর্ডারে।
নো-ডিল ব্রেক্সিট হলে আমদানি ও রপ্তানিতে গুড ফ্রাইডে চুক্তির আওতায় পড়ত না। যার ফলে আয়ারল্যান্ডকেও শুল্ক দিয়েই দ্রব্য আমদানি রপ্তানি করা লাগত। যা আয়ারল্যান্ড এর উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারত। ব্রেক্সিট ডিল আয়ারল্যান্ডের জন্য সুখবরই বটে।
যদি নো-ডিল ব্রেক্সিট হত!
আয়ারল্যান্ডের অর্থনীতি ইংল্যান্ডের বাণিজ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আয়ারল্যান্ড বর্তমানে প্রায় ৮০% পণ্য ইংল্যান্ডে কিংবা ইংল্যান্ডের মাধ্যমে রপ্তানি করে থাকে। মোট খাদ্যদ্রব্য আমদানির ৪১% এবং ৫৫% জ্বালানি ইংল্যান্ড থেকেই আমদানি করে থাকে। দ্রব্যের উপর শুল্ক আরোপ মানে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আয়ারল্যান্ডের সুপারমার্কেটগুলোতে বহু ব্রিটিশ পণ্য রয়েছে, মোটামুটি নিশ্চিতভাবে ধারণা করা হচ্ছিল যে, নো-ডিল ব্রেক্সিট হলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেতে পারত। ইংল্যান্ডকে বলা হত আয়ারল্যান্ড এবং ইইউ এর মধ্যকার ল্যান্ডব্রিজ বা জমিন সেতু, যার মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় দেড় লক্ষাধিক ট্রাক আসা যাওয়া করত। ব্রেক্সিটের পরে ওসব ট্রাকগুলোর ফ্রি মুভমেন্ট আর থাকতনা, যার ফলশ্রুতিতে ইউরোপ এর অন্য দেশ থেকেও পণ্য আমদানি করতে গুনতে হত বাড়তি খরচ। যার প্রভাব গিয়ে পড়ত মূলত ভোক্তাদের উপর।
একইভাবে রপ্তানিকৃত পণ্যের উপরও পড়তে পারে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারত। সবচেয়ে বেশি শুল্ক আরোপ হবে খাদ্য সেক্টরে। যা আয়ারল্যান্ডের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারত। খাদ্য রপ্তানিতে আইরিশ বিফ এবং ডেইরি পণ্য অন্যতম। উৎপাদনের প্রায় ৯০% বিফ রপ্তানি করা হয়, এর মধ্যে অর্ধেকই যায় ইউকে তে। নো-ডিল ব্রেক্সিট হলে ইংল্যান্ডের মার্কেট সম্পূর্ণই হাতছাড়া হয়ে যায় কিনা আইরিশ বিফ সেক্টর এ নিয়ে ছিল সংশয় এবং যার উপর নির্ভর ছিল করে ৮০ হাজার কৃষকের ভাগ্য।
আইরিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, নো-ডিল ব্রেক্সিট হলে আয়ারল্যান্ডের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিহল মার্টিন সংশয় প্রকাশ করে বলতেছেন, ‘’এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইউকে এবং ইইউ নো-ডিল ব্রেক্সিট এড়ানোর চেষ্টা করবে, তা না হলে এটা আমাদের সবার জন্যই খারাপ হবে’’। নো-ডিল ব্রেক্সিট এর ফলে ইকোনমিক গ্রোথ এর ৩% হ্রাস হবার সম্ভাবনা রয়েছে। Irish Fiscal Advisory Council অবশ্য এর দুইগুণ মানে ৬% GDP হ্রাস এর সংশয় প্রকাশ করতেছিল। যার প্রস্তুতিস্বরূপ আইরিশ সরকার আইরিশ ব্যবসায়ীদেরকে ব্রেক্সিটের জন্য তৈরি থাকতে জাতীয় প্রচারণা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসাকে গ্রান্ট প্রদান করার উদ্যেগ নিয়ে রেখেছিল।
সাম্প্রতিক ব্রেক্সিট ডিলের ফলে অনেকগুলা সংশয় থেকে ইতিমধ্যে মুক্তি ঘটেছে। তারপরেও কিছু প্রভাব তো আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সময়ই বলে দিবে কোথাকার পানি আসলে কোথায় গিয়ে গড়ায়। ব্রেক্সিটের সুবিধা অসুবিধাগুলো ধীরে ধীরে সময়ের সাথে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
পরিশেষে বলা যায়, গুড ফ্রাইডে চুক্তির ফলে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের থেকে একটু বাড়তি সুবিধা পাবে আয়ারল্যান্ড। তা কেবলমাত্র সাধারণ জনগণের ফ্রি মুভমেন্টের ক্ষেত্রে। অপরদিকে নো-ডিল ব্রেক্সিট হলে বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে আয়ারল্যান্ডই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। কারণ, আয়ারল্যান্ডই কেবলমাত্র অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের থেকে এখন বিচ্ছিন্ন দেশ, যেখানে ইংল্যান্ডই ছিল একমাত্র সংযোগ মাধ্যম। গুড ফ্রাইডে চুক্তি এবং ব্রেক্সিট বাণিজ্য চুক্তির কারণে আয়ারল্যান্ড কিছুটা হলেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তারপরেও সব শেষই শেষ না। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমন কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করবে যা হবে সবার জন্যই মঙ্গল।