ধর্মের আলোকে সৃষ্টি রহস্য – সাজেদুল চৌধুরী রুবেল

0
774
Shajedul Chowdhury Rubel
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল, Irish Bangla Times

করোনার ভয়াবহ থাবায় পৃথিবী বেশ বদলে গেছে। নেমে এসেছে অদ্ভুত এক আঁধার। ক্রমান্বয়ে এ আঁধার বেড়েই চলছে। দিনের আলোতেও যেনো আজকাল নেই কোনো প্রাণ। সারা বিশ্ব কেবল কাঁদছে আর কাঁদছে। নীরব বোবা কান্না। যে কান্নায় কোনো শব্দ নেই, অশ্রু নেই, নেই গড়িয়ে পড়া চোখের জল। আছে শুধু আর্তি আর আহাজারি।

এমন এক ক্রান্তিলগ্নে একদল লোক বেশ নড়ে চড়ে বসেছেন। সক্রিয় হয়ে উঠেছেন তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নীলনক্সায়। পত্র পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এদের সরব উপস্থিতি বেশ লক্ষ্য করার মতো। ধর্মীয় বিশ্বাসকে তারা বিজ্ঞানের ফলা দিয়ে গুঁতো দিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের মতে, করোনা ভাইরাস পৃথিবীতে এসেছে সমতার দাবি নিয়ে। তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য মানুষকে গিলে খাওয়ার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। বিজ্ঞানের এসব পুত্ররা বলছে, মানুষ সহ সকল প্রজাতিই যেহেতু প্রকৃতির অংশ সেহেতু প্রকৃতির উপর সবারই সমান অধিকার রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য প্রজাতিকে ঠকিয়ে আনুপাতিক হারের তুলনায় প্রকৃতির উপর মানবের অনেক বেশি আধিপত্য বিস্তারের জন্যই আজকের এ বিপর্যয়।

এ রকম একজন বিজ্ঞানপুত্রের সঙ্গে কিছু দিন আগে আমার দেখা। অশরীরী দেখা। কোন স্বাপ্নিক বা আধ্যাত্মিক দেখা নয়। ডিজিটাল সাক্ষাত। দেশের প্রখ্যাত একটি অনলাইন পোর্টালের মতামত কলামে দেখা মেলে তার। সেখানে তিনি বলেন, চারশো কোটি বছর আগে যখন এ পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটেনি, জীবন্ত জগতের পূর্বশর্ত যে কোষ তারও যখন আত্মপ্রকাশ ঘটেনি তখনো ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিলো। এ ভাইরাস জীবন্ত কোষ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে তাদের চেয়েও অনেক বেশী উন্নত এককোষী ব্যাকটেরিয়া প্রায় তিনশো কোটি বছর আগে সালোক সংশ্লেষনের কাজটি শুরু করে এবং একটি পর্যায়ে পৃথিবীকে দান করে অক্সিজেন। তারই হাত ধরে পঁচাত্তর কোটি বছর আগে সবুজ শৈবাল আর পঁয়তাল্লিশ কোটি বছর আগে বহুকোষী সবুজ পত্রাবলির উদ্ভিদরাজি ফুলে-ফলে পৃথিবীকে অপূর্ব সুন্দর ও বর্ণাঢ্য করে তোলে। পোকা-মাকড়, স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখী, বানরকুল হয়ে সোজা হয়ে হাঁটা প্রবুদ্ধ মানুষের(হোমো সেপিয়ান্স) আগমন ঘটে গত চল্লিশ কোটি থেকে আড়াই লক্ষ বছরের মধ্যে। তার এই হোমো সেপিয়ান্স তত্ত্বকে যদি সঠিক বা সত্য বলে ধরে নিতে হয় তাহলে সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে হাজার হাজার বছর ধরে যে ধর্মের সত্যবাণী প্রকাশ পেয়েছে তা কি মিথ্যে? তা কি অমূলক? ধর্মবিশ্বাসী একজন মানুষ হিসেবে এ প্রশ্নটি আমাকে খুব খুরে খুরে খাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে ধর্ম কি বা এর স্বরূপ কি রকম সে সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা নেহায়েত জরুরি হয়ে পড়েছে বলে আমি মনে করছি।

ধর্ম শব্দটিকে বিশ্লষণ করলে দেখা যায় “ধৃ” ধাতু থেকে এর উদ্ভব। “ধৃ” ধাতুর সঙ্গে মন প্রত্যয় যোগ করে ধর্ম শব্দটির উৎপত্তি। “ধৃ” ধাতুর অর্থ ধারণ করা। এ অর্থে যাকে ধারণ করে মানুষ পরম সত্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তার নৈকট্য লাভে সক্ষম হয় তাই ধর্ম। সাধারণত সামাজিক জীবনের বৃহত্তর ঐক্যের মধ্যে যা মানুষের জীবনকে ধরে রাখে বা রাখতে চায় তাকেই ধর্ম বলে অভিহিত করা যেতে পারে।

তবে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করলে ধর্মের বিভিন্ন স্বরূপের মুখোমুখি হতে হয়। বিভিন্ন দার্শনিক, চিন্তাবিদ ও ধর্মবেত্তা গন বিভিন্ন ভাবে ধর্মকে পাওয়ায় প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে ধর্ম সম্বন্ধে গড়ে ওঠে অসংখ্য মতবাদ। তন্মধ্যে কতিপয় উল্লেখযোগ্য মতবাদ পাঠকদের সফল জ্ঞাতার্থে তুলে ধরলাম।

ধর্মের স্বরূপ সম্বন্ধে দার্শনিক মূড় হেড এর ভাষায় বলা যায়, “Religion is a feeling of dependence upon unseen Powery which control our destiny, accompanied by a desire to come into friendly relation with men.” অর্থাৎ ধর্ম হলো এক অদৃষ্ট শক্তির উপর আত্মসমর্পণের অনুভূতি এবং সেই অদৃষ্ট শক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিলনের ইচ্ছা, যে শক্তি আমাদের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে।

অনুভূতির দিক থেকে ধর্মের সংগা দিতে গিয়ে প্রখ্যাত দার্শনিক শ্লায়ার মায়ার বলেন, “স্রষ্টার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতার অনুভূতিই ধর্ম।” ম্যাক্সমুলারের মতে, “ধর্ম হলো অসীমের প্রত্যক্ষণ বা উপলব্ধি।” আবার কান্ট ও ম্যাথুঅনিস্থ বলেন, “কর্তব্য পালন করাই ধর্ম”। অন্য একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের মতে, “ধর্ম হলো ঈশ্বরের ভালোবাসা এবং পরমাত্মার সাথে মিলন। এ হলো অতি উৎকৃষ্টের প্রতি আনুগত্য।” এভাবে বিভিন্ন দার্শনিক ও ধর্মবেত্তা গন ধর্মের স্বরূপ খোঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন।

প্রকৃত পক্ষে যে স্রষ্টার উপর মানুষের নির্ভরতা বোধ জাগে, সেই স্রষ্টার প্রতি সক্রিয় বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণই ধর্ম। বেত্তা গনের দৃষ্টিতে ধর্ম আবার দুটো আংগিকে বিভক্ত। একটি হলো অন্তরঙ্গ ও অন্যটি হলো বহিরাঙ্গ দিক। প্রেম, ভ্রাতৃত্ব, সেবা তথা মানবতাই ধর্মের অন্তরঙ্গ দিক, পক্ষান্তরে আচার অনুষ্ঠান তথা সামাজিকতাই ধর্মের বহিরাঙ্গ দিক। তাই বলা যায়, ধর্ম হলো মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ মূল্য গুলোর স্বীকৃত অর্থাৎ সত্য শুভ ও সুন্দরের উপলব্ধি।

কেউ কেউ এ উপলব্ধিকে ধারণ করে আবার কেউ কেউ এর বাইরে থেকে যুগ যুগ ধরে সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে চিন্তা ভাবনা, পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণা করে আসছেন। তারা যতোই এর নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করতে চেয়েছেন ততোই কৌতূহলী ও জিজ্ঞাসু হয়ে উঠেছেন। বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার এ আধুনিক যুগেও তারা এ ব্যাপারে সমাধানের শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে পারেননি। বিজ্ঞান মনস্ক একটি দল এখন পর্যন্ত ভিন্ন মতাবলম্বীতে বিশ্বাসী থাকলেও সৃষ্টি সম্পর্কে যা জোরালো মতবাদ হিসেবে স্বীকৃত তার মূল কথা হলো, যে কোনো বিশেষ মূহুর্তে খোদার বিশেষ ইচ্ছার রূপায়ণ হিসেবে অবলীলাক্রমে জগৎ ও জাগতিক উপাদান সৃষ্টি করেন। সাধারণত ধর্মবেত্তা গন এই নিরপক্ষে সৃষ্টিবাদেরই বলিষ্ঠ সমর্থক এবং সকল ধর্মেই তা সমানভাবে সমাদৃত।

বস্তুত একমাত্র মহা শক্তির আধার আলেমুল গায়েব আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনই মানব সৃষ্টির দৃঢ় তথ্য ও সুগভীর রহস্য জানেন। তিনি কেনো যে মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে তৈরি করেছেন তা কেবল তাঁরই জগত। কারণ মানব সৃষ্টির ব্যাপারে ফেরেস্তাকুলের প্রতিবাদের উত্তরে মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন, “ইন্নি আয়লামু মা লা তায়লামুন” অবশ্যই আমি যা জানি তোমরা তা জাননা। অর্থাৎ মানব সৃষ্টির পেছনে কি হিকমত বা রহস্য রয়েছে তা একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তাই জানেন।

হিকমত বা রহস্য যাই থাকুক না কেনো উপরোক্ত আলোচনা ও সার্বিক বিচার বিশ্লষণের প্রেক্ষাপটে এ কথা অনস্বীকার্য যে, এ পৃথিবী, বিশ্বমন্ডল, নভোমন্ডল যা কিছু আছে তা ওই এক আল্লাহরই সৃষ্টি। যে সব বিজ্ঞানমনস্করা মনে করে পৃথিবী আপনাআপনিই তৈরি হয়ে গিয়েছে এবং ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার “হোমো সেপিয়ান্স” তত্ত্ব কথার ঢোল দিয়ে বেড়ায় তাদের জন্য আমার করুণা হয়। কারণ তাদের এসব তত্ত্ব কথা মোটেও সঠিক ও সত্য নয়। কোনো শিল্পীর নিখুঁত শিল্পায়ন ছাড়া কি এ পৃথিবী, এ বিশ্ব ভ্রম্মান্ড এতো জৌলুস ও সুবিন্যস্ত হতে পারে? মানব সৃষ্টি, এর দেহ ও আকৃতি এক বিস্ময়কর শিল্প। কে এই শিল্প কলার শিল্পী? ভাইরাস? ব্যাকটেরিয়া? ওইসব বিজ্ঞানপুত্ররা? নাকি এক ফোঁটা রক্ত জমাটের মাঝে যিনি প্রতিস্থাপন করেন এক সুন্দরের অবয়ব তিনি?

জন্মে বিশ্বাসী নয় এমন বেজন্মা বুদ্ধি বিক্রেতাদের আমি শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই, ধর্ম মানুষকে অধিকার দিয়েছে। ইচ্ছে করলে কেউ ধর্ম পালন করবে, কেউ করবেনা। এটা নিজস্ব এখতিয়ার। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসীদের মনে বা অনুভূতিতে আঘাত হানার অধিকার ধর্ম কাউকে দেয়নি।

লিমরিক

Facebook Comments Box