১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। বাঙ্গালী জাতির জন্য এক গৌরবময় দিন। আনন্দের দিন। কিন্ত এ গৌরব ও আনন্দের দিনটি কোনো আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়ায় হঠাৎ করে বাঙ্গালীর হাতের মুঠোয় চলে আসেনি। এ জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাধনা ও সংগ্রাম করতে হয়েছে। রক্ত দিতে হয়েছে। তাই বিজয়ের অনুভূতি যেমন আনন্দের তেমনি বেদনারও। বিশেষ করে যারা স্বজন হারিয়েছেন, যাদের মা-বোনেরা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাদের কাছে এই দিনটি যতোটুকু আনন্দের ঠিক ততোটুকুই বেদনার। তাই এ লেখার শুরুতেই আমি ওইসব স্বজন হারানোদের সহমর্মিতা ও সহানুভূতি জানিয়ে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের এবং সম্ভ্রম হারানো বীরাঙ্গনাদের ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের।
তা ছাড়া এ দেশের মানুষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দেন যে মহান পুরুষ তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কোটি কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন একই লক্ষ্যে অবিচল জাতীয় চার নেতা সহ একদল রাজনৈতিক নেতা। তাদের সবাইকেই আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে। ৫১ বছরের এ পথপরিক্রমায় সে স্বপ্নের কতটা পূরণ হয়েছে, সেটাই আজ ভাববার বিষয়। স্বাধীনতার আগে যেমন এদেশের মানুষকে অনেক বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে তেমনি স্বাধীনতার পরও তাদেরকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করতে হয়েছে। অমসৃণ রাজনৈতিক পথে হাঁটতে হয়েছে তাদেরক বার বার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়। জনবহুল ও সীমিত সম্পদের এ দেশকে স্বয়ম্ভর করে তোলার কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। বস্তুত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্গঠন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র চালু করা সহ আজকের বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা, এ সবই স্বাধীনতার সাফল্য, বিজয়ের আনন্দ।
দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। রাস্তা-ঘাট হচ্ছে। কালবার্ট হচ্ছে। পদ্মাসেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়েছে। এছাড়াও অনেক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রফতানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, তথ্য প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, রফতানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচকে দেশ এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের এমন উন্নয়নে খোদ পাকিস্তানে পর্যন্ত সোরগোল উঠেছে। এই যে সোরগোল,যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো তবে তা উঠতোনা। ক্রিকেটে যখন বাঙ্গালী ছক্কা মারে তখন “সাবাস বাংলাদেশ” ‘সাবাস বাংলাদেশ” বলে যে জয়ধ্বনি উচ্চারিত হয়, তা কোনদিনই হতোনা। বিশ্বখ্যাত এক নাম্বার অলরাউন্ডার সাকিবের জন্ম হতোনা। অভাগা বাঙ্গালী অভাগাই থেকে যেতো। বস্তুত এ সবই স্বাধীনতার সফলতা, স্বাধীনতার প্রাপ্তি ও স্বাধীনতার অর্জন। এ অর্জনের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বিজয়ের আনন্দ।
কিন্ত বলতে দ্বিধা নেই, এ আনন্দ ম্লান হয়ে যায় যখন দেখি এতো উন্নয়নের পরও নৈতিকতার বা মানবিকতার কোনো উন্নয়ন সাধিত হয়নি। সু শিক্ষায় জাতি শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে দেশের প্রতিটি স্তর দুর্নীতির রামরাজ্যে পরিণত হয়েছে। লুটেরা বাহিনী দেশের অর্থসম্পদ লুটপাট করে খাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা বিদেশে পাচার করছে। প্রবাসীদের ঘামের রোজগার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরি হচ্ছে। এ ছাড়া যে গনতন্ত্রের জন্য বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন, যে গণতন্ত্রের জন্য দেশ স্বাধীন হলো সেই গণতন্ত্র আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সংসদ সদস্যের মতো জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই আজ অটোপাস করে সংসদে নির্লজ্জ ভাবে আসন গ্রহণ করেন। গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে খ্যাত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আমলে এমন নড়বরে নির্বাচন সত্যি পীড়াদায়ক। এ কথা বলতেই হয়, আক্ষরিক অর্থে গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা পেলেও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে এখনো শক্তিশালী করা যায়নি সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সত্যিকারার্থে গণতন্ত্রকে সর্বস্তরে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে অঙ্গীকারের অভাব খুবই দুঃখজনক। রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর বিভক্তি; এর পাশাপাশি জাতীয় প্রশ্নে অনৈক্য আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে রয়েছে। এসব বাধা দূর করে দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এখন সময়ের দাবি।
যে কোনো জাতির শক্তির প্রধান উৎস ঐক্য। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন এটি। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের পেছনে কাজ করেছিল মত-পথ-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ। এ জন্যই সম্ভব হয়েছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মাত্র নয় মাসে পরাজিত করা।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার পর আমরা সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারিনি। গুরুত্বহীন বিষয়েও রাজনৈতিক বিভক্তি দেশে গণতন্ত্রের ভিত সুদৃঢ় করার পথে বড় অন্তরায় হয়ে রয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের নেতৃত্বকে। সেই সঙ্গে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোয় অভিন্ন নীতি অনুসরণ অপরিহার্য। আমাদের সামনে অসীম সম্ভাবনা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সব সমস্যা মোকাবেলায় সচেষ্ট হলে আমাদের অগ্রগতি ঘটবে দ্রুত।
আরেকটি কথা টানতেই হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ” সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চুরের খনি”। আজ সে চুরের খনি এক ধাপ এগিয়ে ডাকাতের খনিতে পরিনত হয়েছে। এ খনিকে নির্মূল করতে হবে এবং তা করতে হবে ঐক্যবদ্ধ ভাবে। শুধু ক্ষমতায় যাওয়া বা চিরস্থায়ী ভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার যুদ্ধে লিপ্ত না থেকে সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে সবাইকে “ডাকাতের খনিকে” ঝেটিয়ে বিদায় করার স্লোগান তুলতে হবে। আর এ স্লোগানই হোক এবারের বিজয় দিবসের প্রদীপ্ত অঙ্গীকার।
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
লিমরিক