চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমার জন্মভূমি বনাম আমার প্রবাসভূমি – ওমর এফ নিউটন

0
920
Omar F Newton - Irish Bangla times
Omar F Newton - Irish Bangla times
Omar F Newton - Irish Bangla Times
Omar F Newton – Irish Bangla Times

– ঘটনা একঃ কয়দিন আগের ঘটনা, একমাস ও গড়ায় নি। আমার ছোট মামার একটা ছোট স্ট্রোক হয়েছিল। এমারজেন্সি তে কল দেয়ার সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বুঝতে পারে অপারেশান লাগবে। কালবিলম্ব না করে অপারেশান করে উনার হার্টে তিনটি রিং স্থানান্তরিত করা হয়। স্ট্রোক হবার দিনই তড়িৎ অপারেশন হয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে মামা ঘরে ফিরে আসে। মামার এই চিকিৎসার জন্য কাউকেই দৌড়াদৌড়ি করতে হয় নাই, টাকা পয়সাও লাগে নাই।

– ঘটনা দুইঃ তখন লন্ডনে ছিলাম। ছেলেটি কাছের সম্পর্কের কেউ ছিলনা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যদি বলি, সে আমার চেনাশোনা ছিল কিন্তু জানাশোনা ছিল না। একদিন কল দিল দেখা করবে বলে। বাসার নিকটবর্তী হবার পর দেখলাম সে বাহিরে দাঁড়িয়ে, দেখে বোঝা গেল সে ভালোই অসুস্থ। আমাকে বলল, ভাই একটা ট্যাক্সি ডাকেন। ট্যাক্সি তে করে একটা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে সে হাসপাতালে ঢোকার আগ মুহূর্তেই রাস্তায়ই শুয়ে পড়ল। হাসপাতালের কর্তব্যরত এক সিকিউরিটির দৃষ্টিগোছর হলে সে ভেতরে দৌড়ে যায় এবং একটু পরেই দেখি একদল ডাক্তার, নার্স, অক্সিজেনের সিলিন্ডার, ট্রলি, চিকিৎসার সরঞ্জামাদিসমেত হাজির। তারপর তাকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর অক্সিজেন দিয়ে এমারজেন্সি নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে কিছুই করতে ও বলতেও হয়নি, যা করার তারাই করেছে। তার জ্ঞান ফেরার পর নাম ঠিকানা নিয়ে ভর্তি করিয়ে নেয়। সে কি বৈধ না অবৈধ, টাকা আছে কি নাই কিছুই জিজ্ঞেস করা হয় নি। তাকে সুস্থ করে তোলানোটাই তাদের কাছে মুখ্য বিষয় ছিল। আমি তার পরিচিতদের তার অবস্থান জানিয়ে চলে আসি, কারণ আমি জানি হাসপাতালে সে সম্পূর্ণ নিরাপদ। হাসপাতালে তার চিকিৎসার বিন্দুমাত্র কমতি হবে না।

– ঘটনা তিনঃ ইংল্যান্ডে ফ্রি চিকিৎসার জন্য রেজিস্ট্রেশন থাকা লাগে। যারা ওইখানে থাকে সবারই রেজিস্টেশন থাকে। আমার বউ দুই মাস ওইখানে ছিল। এর মাঝে সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়ে, কিন্তু তার রেজিস্ট্রেশন ছিল না। তারপরেও ডাক্তারের কাছে যাবার পর ফিরিয়ে দেয় নি। ফ্রি পরীক্ষা নিরীক্ষার পর প্রেস্ক্রিপশান দিয়ে দেয়। কয় দিনের মাথায় বউ আমার সুস্থ।

– আমি নিজেও ফ্রি চিকিৎসা সুবিধা পেয়েছি। আর বয়স্কদের জন্য তো সবরকম চিকিৎসাই বিনামূল্যে। আমি প্রায়ই নানার নটীংহামের বাসায় যেতাম। দেখতাম প্রতি মাসের ঔষধ নানাকে পোস্ট করা হত একধরনের বিশেষ ধরণের প্যাকেটে। যেখানে প্রতিদিনের, প্রতিবেলার ঔষধ আলাদা করে করে দেয়া থাকত যাতে উনার খেতে অসুবিধা না হয়। আর নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা তো থাকেই। নানা এখন বেশীরভাগ সময় দেশে কাটালেও বছরে একবার হলেও ইংল্যান্ডে আসেন শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্য। যার আপাদমস্তকই বিনামূল্যে।

– উপরোক্ত ঘটনাগুলো আমার প্রবাসভূমির উপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত। আমরা ভিনদেশের মানুষ, আমাদের প্রতি এত দয়া পরবশ না হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু তাদের কাছ থেকে এমনটি পাওয়া আমাদের চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য। আর আমরা আমাদের নিজ দেশ, নিজ মাতৃভূমির মানুষদের কাছ থেকে হতে হচ্ছে নিগ্রিত ও অবহেলিত। যেখানে অর্থ থাকলেও সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা নাই, আর অর্থ না থাকলে তো চিকিৎসা অকল্পনীয়।

– ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠা বেসরকারী হাসপাতাল আর ক্লিনিকই প্রমাণ করে দেয় দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন। সরকারীভাবে সু-চিকিৎসা পেলে কেইবা যায় টাকা খরচ করে বেসরকারিতে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু হায়! যে মানুষের শ্রমের ঘামের টাকায় যে ডাক্তারদের বেতন ভাতা দেয়া হয় সে ডাক্তারদের কাছ থেকে রোগীদের খারাপ ব্যবহার পেতে হয়। প্রত্যেক ডাক্তারের চোখ প্রাইভেট আয়ের উপর, সরকারী চাকুরীটা শুধু তারা পদবির জন্যই ব্যবহার করে। আমাদের প্রশাসন, সরকার সবাই সবকিছু জানলেও কেউ এইসব অবৈধ প্র্যাকটিস বন্ধ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আর আমাদের হাসপাতালের পরিবেশ রোগ ভালোর জন্য নয়, রোগ সৃষ্টি করার জন্য মোক্ষম জায়গা।

– প্রাইভেট ক্লিনিক হাসপাতাল গুলাতো টাকা উপার্জনের টোল খুলে বসে আছে। মানুষ তো নিরুপায়, যেতেই হবে তাদের কাছে। আর চিকিৎসা দেয় যতটুকু নিয়ে যায় তার থেকে অধিক। সু-চিকিৎসা না হয় বাদই দিলাম, নূন্যতম যে চিকিৎসা দরকার তাও পাওয়া যায়না। প্রত্যেক ভুক্তভোগী মাত্রই আমার কথার সত্যতা উপলব্ধি করতে পারবে।

– আমি বলতেছি না আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উপরোল্লিখিত দেশের মত হোক। সে আশাও করি না। কিন্তু আমাদের যা আছে তার মধ্যেই চেষ্টা করুক। ডাক্তার যারা আছে তারাই ঠিক আছে। শুধু তারা কর্তব্য পরায়ন হোক, রোগীদের সাথে একটু ভালো ব্যবহার করুক, সুপরামর্শ দিক; এতে রোগীর শারীরিক ও মানসিক কষ্টের একটু হলেও লাঘব হবে। যে হাসপাতালগুলা আছে তাতেই চলবে, শুধু একটু ভালো পরিবেশ সৃষ্টি করুক, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় থাকুক, কর্মকর্তা কর্মচারীরা রোগী ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের হয়রানি না করে কিভাবে রোগীর দ্রুত আরোগ্য লাভ হয় তাতে সহযোগিতা করুক তাতেই হবে।

– যে যার কাজে সৎ ও পেশাদারী হলে আর প্রশাসনের কড়া নজরদারি থাকলে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো অনেক উপরে থাকত। চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমাদের ভোগান্তি দুর্বিষহ অবস্থায় পৌঁছেছে। এর অবস্থার উন্নতি আদৌ হবে কিনা আমার অন্তত জানা নাই। তারপরেও আশাবাদী। তারপরেও আশাবাদী আমাদের আইনপ্রনেতারা, দেশনেতাদের নিজ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থাশীল হয়ে দেশের বাহিরে চিকিৎসার জন্য গমন করতে হবে না।

Facebook Comments Box