বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ আর খেলার মাঠে সীমাবদ্ধ নেই। ভদ্রলোকদের এই খেলা এখন ২২ গজের পিচ পেরিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির শীর্ষ বিন্দুতে অবস্হান করছে । শুভ্র- সুন্দর এই খেলার আনন্দের ভিতর ঢুকে গেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যুদ্ধ। এই যুদ্ধকে নিজেদের স্বার্থে ব্যাবহারের জন্য কেউ বলছেন, খেলার সঙ্গে রাজনীতি যায় না। খেলার জায়গা খেলা, আর রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি। আবার কেউ বলছেন, ইতিহাসের পরাজিত শত্রুরা, চিরকালই শত্রু—তাদের বিষয়ে কোনো ছাড় নেই । কিন্তুু রাজনীতির গতি ঠিক রাখতে গিয়ে ঠিকই তারা গোপনে শক্র দেশে রসালো আম পাঠান তিক্ত সম্পর্ক মিষ্টির জন্য। তাদের ভাষায় এটি তীক্ষ্ণ “কূটনীতি” ।
সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যকার টি- টুয়েন্টি ক্রিকেট ম্যাচের প্রথম খেলায় কতিপয় বাংলাদেশি দর্শক মাঠের গ্যালারিতে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছেন। এই পতাকা উড়ানোকে কেন্দ্র করে যখন সমালোচনার ঝড় বইছে সারা দেশে তখন সমালোচকদের জবাব দিতে গিয়ে যারা পতাকা ওড়িয়েছেন তারা এটিকে অরাজনৈতিক বলছেন। তাদের দাবী, টিম এবং ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোেভের প্রতিবাদ হিসেবে তারা এই কাজটি করেছেন।এখানে দেশদ্রোহীতা বলতে কিছু নেই বলে তারা মনে করেন। পাকিস্তানের জায়গায় অন্য কোনো দল হলে ঠিক একই কাজ করতেন বলে তাদের বিশ্বাস।
অন্য পক্ষ যারা ক্রিকেটের মাঠ ও গ্যালারিকে জাতীয়তাবাদী শক্তির বীরত্ব দেখানোর ময়দান হিসেবে বিবেচনা করেন ,তারা পাকিস্তানের এই পতাকা উড়ানোর ঘটনাকে দেশ প্রেম বহির্ভূত জগন্যতম অপরাধ বলে মনে করছেন। তাদের দাবী, যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এই যুবকরা পাকিস্তানের দোসর। এই ঘটনায় নীতিনির্ধারকরা বেজায় ক্ষেপেছেন। দেশের মাঠে বাংলাদেশিদের হাতে পাকিস্তানের পতাকা ! কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার ! অপবিত্র! সর্বনাশ ! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনই তাদের ভাব। কোনো যুক্তিতে তারা এটিকে মেনে নিতে পারছেন না। রক্তক্ষরন হচ্ছে তাদের হৃদয়ে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শাসক দলের রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিপত্তি অজয় রাখাতে গিয়ে যদি দেশের রাজনীতি সঠিক জায়গায় না থাকে, এবং রাজনীতির ময়দানে অন্য শক্তি দাঁড়িয়ে যায়, তখন দর্শকদের দোষ দেওয়াটা কি সমীচিন হবে ? এই বিষয় নিয়ে কি নিজেদের আত্মাসমালোচনার দরকার নেই ?
তাছাড়া খেলার সঙ্গে ব্যবসা, ধর্ম, যৌনতা, এমনকি এমপি হওয়াও যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তখন রাজনীতি কেন বাদ পড়বে? খেলার রক্তের সাথে রাজনীতি যেখানে মিশে গেছে সেখানে কিভাবে আলাদা করবেন খেলাকে ! বরং এর চেয়ে ভালো হবে, এ-ক্ষেত্রে কি ধরণের উত্তম রাজনীতি চর্চা করা যায় সেটা নিয়ে তর্ক করা । বাকিগুলো বাদ!
ব্রিটিশ আমলে ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলায় ব্রিটিশদের পরাজিত করার জন্য পরাধীন মানুষগুলো মুখিয়ে থাকতো। ক্রিকেট নিয়ে নির্মিত বলিউডের সবচেয়ে আলোচিত ও সফল সিনেমা ছিল “লগান”(Lagaan)। আশুতোষ গোয়ারিকরের ২০০১ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবির কাহিনি ছিল ইংলিশদের বিরুদ্ধে খেলায় জয়ের ভিতর দিয়ে খাজনা মওকুফের। আমি যে দেশে বাস করছি এই আয়ারল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ক্রিকেট।
বৃটিশ উপনিবেশের শৃঙ্খল ভাঙতে এই ক্রিকেট আইরিশদের সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছিল। ক্ষমতাবান সেতাঙ্গদের অধীনে থাকা কৃষ্ণাঙ্গরা যদি সাদাদের খেলায় হারাতে পারে, তাহলে বাস্তবেও তাদের হারানো সম্ভব — মানুষের মনে এমন আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিল এই ক্রিকেট।
পাকিস্তান ও ভারত বিরোধিতা অনেক দিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির নদীতে পাল্টাপাল্টি স্রোত হিসেবে বহমান।গ্যালারিও এই স্রোতের বাহিরে নয়। খেলা এবং রাজনীতি এক হয়ে গেলে এর প্রভাব সব জায়গায় পড়বে। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। এখন যদি সরকারের ওপর নানা কারণে ক্ষুব্ধ মানুষগুলো জাতীয় দলকে সরকারপক্ষীয় মনে করে সমর্থন না করে, তাহলে এখানে এই মানুষগুলোর কী করার আছে ? সরকার বিরোধী দানা বাঁধা এই ক্ষোভের দায় কার? এর পর্যালোচনা দরকার।
গায়ে পাকিস্তানি জার্সি কিংবা পতাকা উড়ানোর জন্য হয়তো আপনি তাদেরকে রাজাকার,গাদ্দার, দেশদ্রোহী ইত্যাদি বলতে পারেন। রাষ্ট্র শক্তি ব্যবহার করে তাদেরকে জেলেও ঢুকাতে পারেন। কিন্তুু এই কাজগুলো করে রাষ্ট্রের উপর থেকে তাদের ক্ষোভ সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করতে পারবেন?
জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র ও গণমাধ্যম দুটি দেশের ২২ জনের খেলাকে যখন কোটি কোটি মানুষের প্রতিযোগিতা বলে শরীরের শিহরণ জাগিয়ে তুলছে।গায়ে তাদের দিয়েছে জাতীয় পতাকার রং ও জাতীয় প্রাণীর সৌন্দর্য। জাতীয় সংগীতের পবিত্রতার প্রলেপে মুড়িয়েছে তাদে মন-মস্তিস্ক। সেখানে চাইলে কি ১১ জন ব্যক্তিকে নিছক খেলোয়াড় হিসেবে ভাবা যায় ?
পৃথিবীতে জাতীয়তাবাদের যুগ বলতে তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই এখন। যা চলছে সবকিছু বাণিজ্যিক আধিপত্যের লড়াই। খেলা, সিনেমা, ধর্ম, ভ্যাকসিন, সবই সেই লড়াইয়ে বিনিয়োগের উপাদান মাত্র। যেখানে জাতীয়তাবোধ একটি জাতির অধিকাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ, সেই বহুরূপী বর্ণচোরা ক্রিকেটের জার্সি গায়ে করছে দেশের প্রতিনিধিত্ব।
খেলার মাঠের বাহিরেও ভারত এবং পাকিস্তানের পক্ষে-বিপক্ষে শক্তিশালী রাজনৈতিক জনমত রয়েছে বাংলাদেশে। তাই বলে ভিনদেশি দুই-একটি পতাকা উড়লেই লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশের এক ইঞ্চি মাটি কেউ নিতে পারবে না, তেমনি মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি গণহত্যার পর এদেশের মানুষের হৃদয়ে পাকিস্তানের শুদ্ধ-সুন্দর ছবি আঁকাও সম্ভব নয়। তবে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে একটি বন্ধুপ্রতিম সহাবস্হান গড়ে তুলার জন্য কাজ করা যেতে পারে।
অন্যদিকে পাশ্ববর্তীদের বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক অভিযোগ। পানিবঞ্চনা, সীমান্ত হত্যাসহ অজস্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশের বড় একটি অংশ ভারতের ব্যাপারে চরম অসন্তুষ্ট। দেশটির দাদাগিরি নিয়ে তারা ভীত। কিন্তুু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি পক্ষই প্রবল সক্রিয়। চলমান নানা ইস্যু নিয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষকে ভারতের বা পাকিস্তানের ‘তল্পিবাহক’ বলে প্রায় খোটা দেয়। কোন দল কোন দেশের মিত্র, কার সাথে কে কতঠুকু ঘনিষ্ট, তা–ই দিয়ে দলের চরিত্র বিচার হচ্ছে। এবং সেই সূত্র ধরে বাংলাদেশ চলছে।
দুই দেশের অন্ধসুলভ সমর্থন করতে গিয়ে এক পক্ষ স্বদেশির মঙ্গলের চেয়ে ভিনদেশির মঙ্গলে বেশি সুখ খোঁজে পান। অন্য পক্ষ নিজেদের সহায় সম্বল নিয়ে স্বদেশির মঙ্গলে খুশি থাকতে চান। এভাবে সময়ের পরিক্রমায় দুই পক্ষের ভিতর জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠছে চেতনানাশক। হারিয়ে যাচ্ছে আত্মসম্মানবোধ। ঘৃণা-বিদ্বেষ যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান মসলা হয়, তখন বন্ধু হয় শক্র, আর শক্র হয় বন্ধু—যুগ ভেদে এই নিয়মই জয়ী হয়।
কবি জীবনানন্দ দাশ যথার্থই বলেছিলেন, ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট না হলে, এ জীবন হতো একতিল অধিক বিভোর।’ সত্যি জীবনানন্দ দাসের কথাগুলোই যেনো বর্তমান বাংলাদেশের চিত্র। হয়তো রক্তপাত, শোষণ-বঞ্চনা আর আধিপত্যে বিস্তারের খারাপ অভিজ্ঞতা না থাকলে আমরা খেলাকে খেলা হিসেবে নিতে পারতাম। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, অযৌক্তিকভাবে হলেও খেলার সঙ্গে রাজনীতি মিশে গেছে। এখান থেকে বের হবার রাস্তা এখন রাজনীতিবিদদের খোঁজে বের করতে হবে। এ দায় কেবল তাদেরই।
যদি আমরা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ভালোবাসি, তাহলে ভুল ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিকীকরণের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। দেশের ক্রিকেট অবকাঠামোরক গতিশীল করা, ক্লাব এবং খেলার মাঠগুলোকে মাফিয়াদের হাত থেকে বাঁচানোর আওয়াজ তুলতে হবে। জ্বী হুজুর! জ্বী হুজুর না করে কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহির ব্যবস্হা নিশ্চিত করতে হবে ।
হ্যাঁ একটি দেশের জাতীয় ক্রিকেট দল যখন সে দেশের পতাকা, জাতীয় সংগীত বহন করে, তখন সেই দলের জয়-পরাজয় সেই রাষ্ট্রেরই জয়-পরাজয় হিসেবে গণ্য হয়। দেশ হারলে জনগণ ব্যতিথ হয়। এই সুযোগ নিয়েই খেলা আমাদের অনুভূতির সাথে ছলনা করে।
পাকিস্তান দলকে যারা সমর্থন করেছেন, তারা নৈতিক ভুল করেছেন। তাদের ভুল ভাঙানোর দায়িত্ব প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের। তাদের ভিতর আত্মাসম্মানবোধের শিক্ষা দেশপ্রেমিকদের জাগাতে হবে। মনে রাখতে হবে, একধরনের ভাইরাস মানুষের মধ্যে আছে, যা আঘাত পেলে আরো শক্তিশালী হয়। যারা নিজ দেশের হালচালে ত্যক্ত–বিরক্ত, যারা নিজ রাষ্ট্রের দ্বারা অবাঞ্ছিত বোধ করে, কঠিন আঘাতে তারা কিন্তুু আরো দূরে চলে যেতে পারে এবং শক্তিশালী হয়ে আরো বেশি এই কাজটি করবে । তাই জোড় করে নয়, ভালোবাসা দিয়ে তাদের মন জয় করতে হবে।
ভারত না পাকিস্তান ! কে কোন দেশের “তল্পিবাহক”
সে তর্কে যাচ্ছিনা। আমি বাংলাদেশি এবং সেটি আমার একমাত্র পরিচয়। লেখার শেষে এসে শুধু একটি কথাই বলব ”দেশপ্রেম সবার আগে, এর কোনো বিকল্প নেই”। তবে অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিজের দেশপ্রেম জাহির করার পক্ষেও আমি নই। ক্রিকেট ক্রিকেটের জায়গায় আর রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় রেখে আসুন সামনের দিনগুলোতে আমরা এগিয়ে যাই ।
এস,এ,রব
পোর্টলিস্