এবারের বিশ্বকাপ ছিল পূর্বনির্ধারিত

0
487


আনিসুল হক
এবারের বিশ্বকাপের পাণ্ডুলিপিটা ছিল নিখুঁত। ২০ ডিসেম্বর ২০২২ বিবিসি যখন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ বিজয়ী বীরদের দেশে ফেরা দেখাচ্ছিল সরাসরি, তখন ভাষ্যকার বলছিলেন, এবারের চিত্রনাট্যটা সস্তা কমিকসকেও হার মানায়, এটা যদি কোনো কমিকসের লেখক লিখতেন, তবে সম্পাদকেরা সেটাকে অতি সস্তা, অতি অনুমিত বলে বাদ দিয়ে দিতেন। কোন অংশটা? বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রথম খেলায় আর্জেন্টিনা হেরে যাবে সৌদি আরবের কাছে। তারপর তারা একটার পর একটা ম্যাচে জিতবে, আর শেষ পর্যন্ত হবে চ্যাম্পিয়ন।
চিত্রনাট্যটা ছিল উত্থান-পতন, হাসি-কান্না, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ক্লাইমেক্সে ঠাসা। অক্সফোর্ড বলবে, এবার চ্যাম্পিয়ন হবে ব্রাজিল। ফাইনাল হবে বেলজিয়ামের সঙ্গে। আর ফিফার গেমসাইট বলবে, এবার চ্যাম্পিয়ন হবে আর্জেন্টিনা। এর আগের দুবারও ফিফা গেম যা বলেছিল, তা-ই হয়েছে। জার্মানি এবং ফ্রান্স চ্যাম্পিয়ন হবে, এই ছিল তাদের ভবিষ্যদ্বাণী। এবার তাদের পূর্বাভাস ছিল, চ্যাম্পিয়ন হবে আর্জেন্টিনা। ফিফা গেমের ভবিষ্যদ্বাণী কি আর বৃথা যায়?
এবারের বিশ্বকাপে শুধু যে স্ক্রিপ্ট ভালো লেখা হয়েছিল, তা নয়, এর বাস্তবায়নও হয়েছে ভালো। অ্যাক্টিং ভালো হয়েছে। অ্যাকশন হয়েছে অনবদ্য, তুলনারহিত। ক্যামেরুনের কাছে হারল ব্রাজিল, আর পরের ম্যাচেই কীভাবে তুলাধোনা করল দক্ষিণ কোরিয়াকে। দাঁড়ান। দাঁড়ান। এসবই তো পূর্বপরিকল্পিত, পূর্বনির্ধারিত। ক্লাইমেক্স থেকে আসবে অ্যান্টিক্লাইমেক্স। পরের ম্যাচেই হেরে যাবে ব্রাজিল, ক্রোয়েশিয়ার কাছে। তার আগে নেইমার এমন একটা গোল দেবেন, যা মনে হবে টুর্নামেন্টের সেরা গোল।
কিন্তু তাতে কী? আগে থেকেই তো ঠিক করা আছে, ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হবে না। কাজেই ডিফেন্স ছেড়ে ব্রাজিলিয়ানরা সবাই চলে যাবে খেলা শেষের তিন মিনিট আগে আক্রমণ করতে আর উল্টো গোল খেয়ে বসে থাকবে। তারপর টাইব্রেকার। ব্রাজিল পাঠাবে তরুণতম খেলোয়াড়কে। সে কোন দিকে মারবে, তা-ও পূর্বনির্ধারিত আর ক্রোয়েশিয়ান গোলকিপার কোন দিকে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তা আগে থেকেই জানেন। ব্যস। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মুখোমুখি সংঘাত এড়ানো গেল। বাংলাদেশে শতাধিক প্রাণ বেঁচে গেল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রয়ে গেল শান্তিপূর্ণ।
মরক্কোকে এগিয়ে নাও। কাতারে খেলা হচ্ছে। সৌদি আরব হারিয়ে রাখল চ্যাম্পিয়নদের। মরক্কো চলে গেল সেমিতে। কী উত্তেজনার ব্যাপার! পুরো আফ্রিকা জেগে উঠল, পুরো আরব দেশ জেগে উঠল। মরক্কোর খেলোয়াড়দের মায়েরা যাচ্ছেন গ্যালারিতে, খেলা শেষ করার পর তাঁরা ঢুকছেন মাঠে, খেলোয়াড়দের চুমু খাচ্ছেন। আহা, এ তো কাজী জহিরের সিনেমা অবুঝ মন–কেও হার মানায়।
আর আপস অ্যান্ড ডাউনস দেখুন। স্পেন দিচ্ছে সাত–সাতটা গোল, তারপর আউট। পর্তুগাল গর্জে উঠছে, তারপর বিদায়। কার বিদায়? না, রোনালদোর। তারপর সেকি কান্না! বীরের চোখের জল প্লাবন ডেকে আনল কোটি ভক্তের চোখে। ওদিকে নেইমারের কান্না কে দেখবে? কে মুছে দেবে তাঁর চোখের জল। স্ক্রিপ্টরাইটার এবার আনলেন একটা অনবদ্য চরিত্র। শিশু। ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়ের শিশুপুত্র ঢুকে গেল মাঠে। নেইমারের ভক্ত সে। নিরাপত্তাবলয় পেরিয়ে আলিঙ্গন করল সে নেইমারকে।
এত সুন্দরও একটা নাটক হয়! এত সুন্দর লেখা। এত সুন্দর তা চিত্রায়ণ। আমরা মুগ্ধ। বিস্মিত। মেসি নামের একজন আছেন। তিনি এই গ্রহের নন। তাঁর পা তো মাটিতে পড়ে না। তিনি ছোট ছোট পদক্ষেপে দৌড়ান। কিক করতে জায়গা লাগে কম। পাস দেন নির্ভুল। এই পৃথিবী একবারই পেয়েছিল তাঁকে, কোনো দিন পায়নি আবার। এত অসম্ভব সুন্দর খেলোয়াড় কি আর আসবে এই ধূলির ধরায়? বয়স হয়ে যাচ্ছে। তিনি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। কাজেই বিশ্বকাপ উঠবে তাঁরই হাতে। এটাও আগে থেকে নির্ধারিতই ছিল। বীরের হাতেই উঠতে হবে সোনার কাপ। সবাই এটা জানত। কিন্তু কাপটা তো আর না খেলে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া যায় না।
কাজেই দাও পেনাল্টি। কী? আর্জেন্টিনা পেনাল্টি পেয়ে জিতেছে? মেসির গোলগুলো বেশির ভাগ পেনাল্টির গোল? দাঁড়াও, সমালোচকদের মুখ বন্ধ করছি। আর্জেন্টিনা একটা পেনাল্টি পেল, তো ফাইনালের প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রান্স, মেসির প্রতিদ্বন্দ্বী এমবাপ্পে পেলেন দুটো পেনাল্টি। নিন। এবার সমালোচনা করুন। আর ফাইনাল মানে সেইরাম! ৭০ মিনিট আর্জেন্টিনা খেলল একা। মেসি দেখালেন তাঁর সেই খেলা, যা কেবল তিনিই দেখাতে পারেন। বল নিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণব্যূহ ভেঙে মাথা নিচু করে কারও দিকে না তাকিয়ে তিনি বলটা দিলেন একেবারে সঠিক খেলোয়াড়টিকে। গোল!
আপনারা ভাবছেন দুর্বল চিত্রনাট্য! ফ্রান্স কী করে খেলা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে? দাঁড়ান। দাঁড়ান। এ যে রোমহর্ষ নাটক! থ্রিলার! পেনাল্টি থেকে গোল শোধ। তারপর এমবাপ্পে নামের পৃথিবীর আরেক সেরা খেলোয়াড়ের সেই রকম দৌড়, সেই রকম কিক। ৯০ মিনিটে ২-২।
আর্জেন্টিনার ৫০০ কোটি সমর্থক তখন নখ কামড়াচ্ছেন। তারপর আর্জেন্টিনার গোল। কে দেবেন? না। মেসি। সেই গোলেও নাটকীয়তা আছে। ফ্রান্সের একজন জালের ভেতর তিন গজ পেছনে দাঁড়িয়ে সেটা ফিরিয়েও দিলেন। ৩-২। ফ্রান্স পেল আবার পেনাল্টি। এমবাপ্পে সোনার বুট পাবেন। কাজেই তিনি আরেকটা গোল করে বসলেন।
এবার টাইব্রেকার। কী নিখুঁত গল্প! এমবাপ্পে গোল করবেন, মেসি গোল করবেন। ফ্রান্সের কিক ঠেকিয়ে দেবে পৃথিবীসেরা গোলকিপার মার্টিনেজ। কোন দিকে মারতে হবে, কোন দিকে ঝাঁপাতে হবে, সবই তো আগে থেকে ঠিক করা। এত সুন্দর বিশ্বকাপ আমরা এর আগে দেখিনি!
এত উত্তেজনাকর ফাইনালও কি পৃথিবী এর আগে কখনো দেখেছে? কে লিখলেন এই চিত্রনাট্য? প্রযোজক ফিফা। ক্যামেরা চালিয়েছেন দক্ষ পেশাদার ক্যামেরাম্যানরা। কিন্তু লিখলেন কে? নির্দেশনা কার? যা ভাবছেন, তা-ই। এই চিত্রনাট্য লিখেছেন বিধাতা।
কেবল জগৎবিধাতার পক্ষেই এ রকম একটা চিত্রনাট্য লেখা সম্ভব এবং তা পরিচালনা করা সম্ভব। তবে ফরচুন ফেভারস দ্য ব্রেভস। বিধাতা অযোগ্যকে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরান না। ৩২টা দলের মধ্যে একটা টিম চ্যাম্পিয়ন হয়। তারা যোগ্য বলেই হয়। মেসির হাতে এত নাটকীয়তা শেষে কাপটা ওঠায় বলতে হয়, সোনার ছেলের হাতে সোনার কাপ, কে কার অলংকার?
মেসি বিশ্বকাপকে মর্যাদাবান করে তুললেন।
আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক

Facebook Comments Box