একজন রকস্টারের ইসলামের সেবক হয়ে উঠার গল্প

0
492
জুনাইদ জামশেদ

উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ইসলামী সঙ্গীতশিল্পী জুনাইদ জামশেদ। বৈচিত্রময় জীবনের অধিকারী জুনাইদ জামশেদ জীবনের শুরুভাগে ছিলেন পাকিস্তানের পপ সম্রাট। ইসলামের ছোঁয়ায় জীবনের দিক পরিবর্তন করে হয়ে ছিলেন নাত সম্রাট। হামদ, নাতে কোটি মুসলিমের হৃদয়ে সত্যের আলোকে ছড়িয়ে দিতে গেয়েছিলেন আমৃত্যু।

১৯৬৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের করাচিতে জন্ম৷ বাবা জামশেদ আকবর খান ও মা নাফিসা আকবরের ৩ ছেলে ১ মেয়ের মাঝে তিনি ছিলেন প্রথম৷ বাবা ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ক্যাপ্টেন। সৌদি আরবে মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে তিনিও যোগ দিতে চেয়েছিলেন বাবার কর্মক্ষেত্রেই। পাইলট হবার স্বপ্ন ছিলো তার, কিন্তু দুর্বল দৃষ্টিশক্তি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তাতে। পদার্থ ও গণিতে ব্যাচেলর করবার পর জুনাইদ ঠিকই যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে, বেসামরিক ঠিকাদার হিসেবে।

রকস্টারের জীবন

চাকুরিকালে শিক্ষাকালীন অবকাশে তিনি শুরু করেন রক গানের কনসার্ট।এরপর শখের বশেই রাহেল হায়াত ও শাহজাদ হাসানের সঙ্গে ১৯৮৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেশাত্মবোধক গান ‘দিল দিল পাকিস্তান’ গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন দেশটির প্রথম পপ ব্যান্ড ‘ভাইটাল সাইন’৷ তাদের প্রথম হিট এ্যালবাম ‘দিল দিল পাকিস্তান’ এনে দেয় আকাশচুম্বী খ্যাতি। এই গানটিই ঘুরিয়ে দেয় তার জীবনের মোড়। পরিণত করে একজন শৌখিন সঙ্গীতশিল্পী থেকে পেশাদার শিল্পীতে। পেশওয়ার ও লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বিভিন্ন শো করছিলেন, তখনো তিনি লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্র-প্রকৌশলে অধ্যয়নরত। সময়টা ১৯৮৬ এর মাঝামাঝি। পরের বছরেই একই নামে বাজারে আসে তাদের অ্যালবাম। সেখান থেকে ‘দিল দিল পাকিস্তান’, ‘তুম মিল গায়ে’ দিয়ে দেশজোড়া খ্যাতি পান জুনাইদ ও তার ব্যান্ড। তারপর তো পড়া ছেড়ে পুরোদস্তুর গানেই মজে গেলেন জুনাইদ।

পরবর্তী দুই অ্যালবাম ‘ভাইটাল সাইন্স টু’ আর ‘অ্যাতবার’ এর জনপ্রিয়তা জুনাইদকে দেয় নতুন এক পরিচয়ের দিশা। ১৯৯৪ সালে পিটিভির ‘ঢুন্ডলে রাস্তে’ সিরিজটির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে জুনাইদ এবার নাম লেখালেন অভিনেতার খাতায়! অভিনেতা হিসেবে ছোট একটি ইনিংস খেলে জুনাইদ এবার মন দিলেন সলো গানের ক্যারিয়ারে। ১৯৯৮ সালে ব্যান্ড ছেড়ে এসে বের করলেন সলো অ্যালবাম ‘উস রাহ পার’ (১৯৯৯)। এই অ্যালবাম থেকে টাইটেল ট্র্যাকটি সহ ‘না তু আয়েগি’, ‘আঁখোঁ কো আঁখোঁ নে’, ‘ও সানাম’ বাজারে তুমুল জনপ্রিয় হয়। ২০০১ সালে বের হয় তার সর্বশেষ অ্যালবাম ‘দিল কি বাত’। ২০০৩ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এক জরিপে ‘সেরা ১০ সুর’-এর তালিকায় ৭,০০০ গানকে পিছে ফেলে জায়গা করে নেয় জুনাইদের ‘দিল পাকিস্তান’।

ভাগ্য সবসময় সুপ্রসন্ন থাকে না। জুনাইদের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটলো। এমনিতেই ব্যান্ড ছেড়ে দেবার পর কাছের অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো তার থেকে। উপরন্তু শেষ দুইমটি অ্যালবাম বাজারে তেমন কাটতিও পায়নি। কেবল ইউরোপ, আমেরিকায় কিছু শো করে দিন কাটছিলো জুনাইদের। কিন্তু ৯/১১ এর পর নিরাপত্তা আশঙ্কা ও ইসলামবিদ্বেষের কারণে জুনাইদ জামশেদের সব কনসার্ট বাতিল হতে থাকে পাশ্চাত্যে। জনপ্রিয়তার শিখর থেকে হুট করে এমন খাদেই পড়লেন জুনাইদ যে কোর্ট কর্তৃক তিনি দেউলিয়া পর্যন্ত ঘোষিত হলেন ২০০৪ সালে!

ধর্মীয় জীবনে পদার্পণ 

২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সঙ্গীতজগতকে বিদায় জানান তিনি৷ আসলে বিদায় জানানো বলা ঠিক হবে না, মেধাবী এই শিল্পী তার ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করে খ্যাতি ও ভবিষ্যতের বদলে ইমানকে বেছে নেন।

এই নাটকীয় পরিবর্তনের পর এই বদলের সিদ্ধান্তগ্রহণে তার কোনো আফসোস হয়নি৷ তিনি বলতেন, ”আমার আগের জীবনযাপনের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি এখন আর অবশিষ্ট নেই। আমার নতুন জীবন খুব সরল, পবিত্র এবং সুন্দর। আমি অনুভব করি, আপনি আপনার জীবনে আল্লাহর হুকুম ও রাসুলের তরিকার ওপর আমল করেন৷ তাহলে দুনিয়াতেই আপনার জীবন জান্নাতে পরিণত হবে”।

এরপরই মিডিয়ার লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান জুনাইদ। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রিটা শেষ করে তিনি কাজ করলেন কিছু কোম্পানিতে। সেখানে মন টিকাতে পারলেন না তিনি। কাছের এক বন্ধুকে নিয়ে তিনি এরপর খুলে বসলেন ফ্যাশন হাউজ ‘জে ডট’। শোনা যাচ্ছিলো তখন থেকেই তিনি বেশ করে ঝুঁকে পড়ছিলেন ধর্মকর্মের দিকে।

ব্যবসায় উন্নতির সাথে সাথে তিনি জড়িয়ে পড়েন তাবলিগ জামাতের সাথেও। রক গায়ক, খণ্ডকালীন অভিনেতা থেকে তিনি বনে গেলেন ইঞ্জিনিয়ার, ফ্যাশন ডিজাইনার এবং সর্বোপরি ধর্মপ্রচারক। তাবলিগের হয়ে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেবার পাশাপাশি তিনি শুরু করলেন নাত গাওয়া। এই নাত দিয়ে পুনরায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠলেন জুনাইদ জামশেদ। তবে পুনর্জীবনের এ অধ্যায়ে অবধারিতভাবেই শ্রোতা-ভক্তের ধরনটা বদলে যায়। কিন্তু কণ্ঠ তো রয়েছে আগের ন্যায় মধুময়ই, এ কারণে জুনাইদের গাওয়া ‘ইয়ে সুভা মদিনা’, ‘তুনে পুঁছি ইমামত’, ‘মুলতাজিম পার দুয়া’, ‘মেরে মাদাদ আল্লাহ’র মতো অসংখ্য নাত পায় মানুষের ভালোবাসা। বাংলায় গাওয়া ‘হে রাসূল’ ও ‘নবী মোর পরশমনি’-র কাভারও ইউটিউবের কল্যাণে পেয়েছে বেশ বাঙালি-শ্রোতাপ্রিয়তা। বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের জন্য প্রচুর দাতব্য কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন জুনাইদ। পূর্বের গ্ল্যামারের সাথে ধর্মের মিশেলে তার এই নতুন কারিশমাটিক ভূমিকা তাকে পরিণত করে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে। মাত্র বছর দশেকের ব্যবধানে একজন রকস্টারকে এভাবেই পৃথিবী চিনলো সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে।

জুনাইদ জামশেদ রকস্টার হিসেবে আগের ও ইসলামের সেবক হিসেবে পরের জীবন

বিতর্কিত জুনাইদ জামশেদ

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তার এক ভিডিও প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি বলেছিলেন, “মুহাম্মদ (স) এর স্ত্রী আয়েশা স্বামীর বাড়তি মনোযোগ কামনা করতেন, তাই তিনি একবার অসুস্থতার ভান করেছিলেন”। ব্যস, ব্ল্যাসফেমি আইনে নবীর (সা) স্ত্রীকে অবমাননার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয় সুন্নি তেহরিক নামক একটি সংগঠন। পরবর্তীতে বক্তব্য প্রত্যাহার ও ‘তওবা’ করে সে যাত্রায় মামলা থেকে পার পান জুনাইদ। তবে ভাগ হয়ে যায় আলেম সমাজ। জুনাইদের দীক্ষাগুরু হিসেবে পরিচিত তাবলিগের প্রধান মাওলানা তারিক জামিল ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন জুনাইদের জন্য। সবাইকে বোঝাতে লাগলেন, “এ ভুল অনিচ্ছাকৃত। আর রাসুলের আদর্শ হলো ক্ষমার আদর্শ, তাই জুনাইদকেও ক্ষমা করে দেওয়া উচিত।”

করুণ জীবনাবসান

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় স্ত্রী নাহিয়া জুনাইদকে নিয়ে তাবলিগের কাজে তিনি খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের চিত্রালে গিয়েছিলেন (উল্লেখ্য, জুনাইদের তিন পুত্র ও এক কন্যার জন্ম তার প্রথম স্ত্রী আয়েশা জুনাইদের গর্ভে)। ৭ ডিসেম্বর সেখান থেকে ইসলামাবাদ ফেরার পথে তাকে বহনকারী পিআইএ ৬৬১ বিমানটি একই প্রদেশের হাভেলিয়ানে বিধ্বস্ত হয়। সস্ত্রীক নিহত জুনাইদের দেহকে স্বাভাবিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এক্সরে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল দ্বারা সনাক্ত করতে হয়েছিলো তাকে। তার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়েছিলো তার অগণিত ভক্ত, যারা কেউ ভালোবেসেছিলো রকস্টার জুনাইদকে, কেউবা বেসেছিলো নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম গায়েন জুনাইদকে। এভাবেই ইতি ঘটেছিলো একটি বর্ণবহুল জীবনের, একটি বর্ণাঢ্য গল্পের।

মৃত্যু অবধি জুনায়েদ উর্দু গজল, হামদ-নাতের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের মনের স্থান লাভ করে আছেন৷ তিনি সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি নিয়মিত তাবলিগের কাজ করতেন। সঙ্গীত পরিবেশন ও বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্য তিনি অনেকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। সমাজসেবার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার সঙ্গে। আমরা দোআ করি মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন।

Facebook Comments Box