আয়ারল্যান্ড প্রবাসীর আত্মকহনঃ “কিছু কথা থাক”

0
911
Mahfujul Haque
ছবিঃ শাহ্‌ নার্সারী, ঝিনাইদহ (লেখকের পূর্বপুরুষের নিবাসস্থল)

এই পর্বঃ “এইখানে তোর দাদীর কবর……”

[এই লেখাটি আবেগতাড়িত। সন্দেহ নেই। স্পর্শকাতরও বটে। কিন্তু তা একান্তই আমার নিজস্ব ভাবনা। চিন্তা ও চেতনা। তবে সত্যের কাছাকাছি থাকতে সর্বদা সচেষ্ট থেকেছি। ৩০ থেকে ৪০ বছর পূর্বের স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে আমাকে চিন্তার অনেক গভীরে যেতে হয়েছে। লেখাটির উদ্দেশ্য কাউকে আঘাত করা নয়। কিংবা কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও নয়। বহু বছর ধরে হ্রদয়ের গহীনে সুপ্ত থাকা কিছু কথা অবমুক্ত করলাম মাত্র। কেননা, আমি মনে করি, ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য পূর্বসূরীদের “কিছু কথা থাক”।]

ইদানিং আমার দাদীর কথা খুব মনে পড়ে। অনেক কারনেই। হয়তোবা বয়স বাড়ছে। তাই শেঁকড়ের কথা বেশী মনে পড়ছে। তাঁর কোনো ছবি আমার কাছে নেই। অন্তরের দৃস্টি দিয়ে আজ তাঁর কথা ভাবছি।

বুদ্ধি হওয়ার পর দাদীকে আমি দশ বছর ধরে দেখেছি। সাদা শাড়িতে লম্বা ঘোমটা টানা। ফর্সা, খর্বাকৃতি। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সত্তরোর্ধ একজন বৃদ্ধা।

ছোটবেলায় স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে প্রতি শীতে আমরা ঢাকা থেকে ঝিনাইদহ যেতাম। শহরের কাঞ্চননগরে আমার নানাবাড়ী। দাদাবাড়ী ঠিক তার পাশেই। আমরা পৌঁছামাত্রই দাদী খবর পেয়ে যেতেন। তারপর দেখতাম তিনি টুকটুক করে পায়ে হেঁটে হাজির। কখনো অবশ্য আমরা দুই ভাই প্রথমেই তাঁর বাড়ীতে গিয়ে তাঁকে সালাম করে আসতাম। এখনো খুব স্পষ্ট মনে পড়ে। প্রতিবারই তাঁর প্রথম বাক্য ছিলো, “ও পরদীপ, ও পরতাপ। আব্বা ভালো আছে? আব্বা ভালো আছে?” আমাদের দুই ভাইয়ের নাম প্রদীপ্ ও প্রতাপ। কিন্তু আমার দাদীর উচ্চারণে তা হয়ে যেতো ‘পরদীপ’ ও ‘পরতাপ’। আর আব্বা মানে আমার বাবা। দাদীর মেজো ছেলে।

শৈশবে বা কৈশোরে আমরা অনেক সময় পারিবারিক আবহে এমন কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। যার মর্মার্থ তখন আমরা বুঝিনা বা বুঝতে পারিও না। স্বভাবতই বয়সের কারনে। কিন্তু ঘটনাগুলোর ছাপ বা ছায়া থাকে মনে। কখনো বা অবচেতন মনে সৃষ্টি হয় কিছু দুঃখ বা ক্ষোভ।

আমার দাদীর একটি মাত্র ঘর ছিলো। দাদী সেই ঘরে একাই থাকতেন। অবশ্য তাঁর খাওয়া-দাওয়া ছিলো ছোটো চাচার বাড়ীতে। দাদীর এই ঘরটির অবস্থান ছিল উল্লেখ করার মতো। আমার বড় চাচার দোতলা বাড়ীর প্রাচীরের ঠিক শেষ সীমানায়। সেখানে যেতে হতো ছোট চাচার বাড়ীর ভিতর দিয়ে। কলতলা পেরিয়ে। কয়েক কদম কাঁচা হাঁটাপথ হেঁটে।

জরাজীর্ন, আলো বাতাসহীন পুরানো একটি পাকা ঘর। মাটি থেকে একটু উপরে। কিন্তু সামনে কোনো বাঁধানো সিঁড়ি ছিলো না। ছিলো এক খন্ড ইট বা পাথর। সেখানে পা দিয়েই তাঁকে ঘরে ঢুকতে হতো। যতোদূর মনে পড়ে, আসবাবপত্র বলতে সেই ঘরে ছিলো একটি মাত্র খাট বা চৌকি। বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা ছিলো কিনা আজ তা মনে পড়ছে না। দাদীর ঘর পেরিয়ে একটু কাঁচা উঠান। তার এক কোণে একটি কাঁচা শৌচাগার।

১৯৯২ সালের ২৭শে এপ্রিল প্রায় ৮৭ বছর বয়সে আমার দাদীর মৃত্যু হয়। আমি তখন বেইজিংয়ে পড়াশোনা করছি। ফলে তাঁর বিদায়বেলায় আমি সামিল থাকতে পারিনি। শুনেছি মাত্র কিছুদিনের অসুস্থতায় একাকী একটি ঘরে ঘুমের মধ্যেই তাঁর শান্তিময় মৃত্যু হয়। শহরের পৌর কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর শেষ ঠিকানার কোনো নামফলক বা স্মৃতিচিহ্ন নেই। উল্লেখ্য, আমার দাদার কবরেরও কোনো নিশানা বা অস্তিত্ত্ব নেই।

বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবেশে আজও দেখা যায়, বড় গৃহস্থ পরিবারের নিজস্ব পারিবারিক কবরস্থান রয়েছে। তার পাশেই হয়তো আছে মসজিদ, মাদ্রাসা, এমনকি এতিমখানা। কিন্তু আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যে এসবের কিছুই নেই।

আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন হরিণাকুন্ডু উপজেলার পারমথুরাপুর গ্রামে। কিন্তু আমার দাদার ভিটে বাড়ী ছিলো ষড়াবাড়িয়া গ্রামে। সেখানে আমি কোনোদিন যাইনি। যাবার সুযোগ হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা। কেউ আমাকে হাত ধরে নিয়ে যায়নি। বলেনি…,

“এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।”

(পল্লীকবি জসীমউদ্দীন-এর ‘কবর’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত)

এস, এম, মাহফুজুল হক
ডাবলিন
২৫শে জুলাই, ২০২০

Facebook Comments Box